ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

পবিত্র লায়লাতুল মিরাজ মহামিলনের রাত

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ৬ মে ২০১৬

পবিত্র লায়লাতুল মিরাজ  মহামিলনের রাত

আমাদের প্রিয়নবী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের শিক্ষক স্বয়ং আল্লাহ জাল্লা শানুহু। তিনি তাঁকে যাবতীয় শিক্ষাদান করে একপর্যায়ে তাঁকে সৃষ্টির তাবত রহস্য প্রদর্শনের জন্য সমগ্র বিশ্বজগত পরিভ্রমণ করান, এমনকি তাঁর বিরাটত্ব, মাহাত্ম্য ও কুদরতের কেন্দ্র আরশে আজিমে নিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে মিলিত হন। এই অনন্য ঘটনা মিরাজ নামে পরিচিত। হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা আহমদ মুজতাবা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পঞ্চাশ বছর বয়সকালে মিরাজ সংঘটিত হয়। মাটির পৃথিবী থেকে মহাশূন্যের সকল স্তর অতিক্রম করে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর সঙ্গে তাঁর একান্ত সাক্ষাত ঘটে। এখানে উল্লেখ্য যে, চল্লিশ বছর বয়সে তিনি প্রথম ওহী লাভ করেন। প্রথম ওহীর প্রথম উচ্চারণ ছিল ‘ইক্্রা’ পাঠ কর। আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবকে সেই জ্ঞানের পূর্ণতা প্রদান করেন মিরাজের মাধ্যমে। মিরাজের কয়েকটি স্তর রয়েছে। যেমনÑ ১. কাবা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত বোরাকে চড়ে গমন। ২. বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে নূরের কুদরতি সিঁড়ি পেরিয়ে আসমানে গমন এবং একে একে সাত আসমান পরিভ্রমণ করে বায়তুল মামুর হয়ে সিদরাতুল মুনতাহা-সীমান্ত কুল বৃক্ষ পর্যন্ত উপনীত হওয়া। ৩. সিদরাতুল মুনতাহা থেকে রফরফ নামক কুদরতি যানে মহান আরশে উপনীত হওয়া এবং আল্লাহর দিদার লাভ। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : অতঃপর তিনি তাঁর নিকটবর্তী হলেন মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান হলো অথবা তারও কম। তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহী করবার তা ওহী করলেন (সূরা নাজম : আয়াত ৮-১০)। দিদার লাভকালে প্রিয়নবী হযরত রসূলুল্লাহ্্ আলায়হি ওয়া সাল্লাম মহা আনন্দ-আবেগে দেহ-মনের সমস্ত প্রেম, শ্রদ্ধা, ভক্তি, সম্মান ব্যক্ত করেন এই উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে : আত্তাহিয়াতু লিল্লাহি ওয়াসসালাওয়াতু ওয়াত্্তাইয়েবাতু, সমস্ত শ্রদ্ধা, ভক্তি, সম্মান, তাবত্্ ইবাদত ও পবিত্রতা আল্লাহর জন্য। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু এর জবাবে ইরশাদ করেন : আস্্সালামু আলায়কা আইয়্যুহান নাবীও ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহুÑ হে নবী সালাম, আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত আপনার প্রতি। এই সময় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের উম্মতের কথা মনে পড়ে গেল। তখন তিনি বলে উঠলেন : আস্্সালামু আলায়না ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস্্ সালিহীনÑ সালাম (শান্তি) বর্ষিত হোক আমাদের ওপর এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপর। তিনি আরও বললেন : আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুÑ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্্ ছাড়া কোন ইলাহ্্ নেই। জবাব এলো : ওয়া আশহাদু আন্œা মুহাম্মাদান আব্্দুহু ওয়া রসূলুহুÑ আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহম্মদ তাঁর বান্দা ও রসূল। এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, আরশে আজীমে যখন আল্লাহ্্ জাল্লা শানহু ও তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মধ্যে উপরিউক্ত সালাম ও সাক্ষ্য বিনিময় হচ্ছিল তখন ফেরেশতা জগতের সকল ফেরেশতা ও রূহগণ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে পাঠ করছিলেন : আল্লাহুম্মা সল্লে আলা মুহাম্মাদিউ ওয়া আলা আলি মুহাম্মদ। আমরা কোরআন মজীদে দেখতে পাই আল্লাহ্্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরুদ পাঠ করেন। ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই আল্লাহ্্র এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরুদ পেশ করেন। ওহে, তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমরাও নবীর প্রতি দরুদ পাঠ কর এবং তাঁকে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে সালাম জানাও। (সূরা আহযাব : আয়াত ৫৬)। সিহাহ্্ সিত্তা হাদিস শরীফের বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হযরত মুহম্মদুর রসূলুল্লাহ্্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এই ঘটনার রাতে কাবা শরীফের নিকটবর্তী শিবি আবিতালিবে হযরত উম্মে হানী রাদিআল্লাহু তাআলা আনহার গৃহে ঘুমিয়েছিলেন। গভীর রাতে আল্লাহর ফেরেশতা হযরত জিবরাইল আলায়হিস সালাম কয়েকজন ফেরেশতাসহ এসে তাঁকে কাবা শরীফের হাতীমে নিয়ে আসেন এবং তাঁর বক্ষ বিদারণ করে তাঁর কল্¦ মুবারককে আবে যম্্যম্্ দ্বারা ধৌত করে তা যথাস্থানে আবার লাগিয়ে দেন। তিনি এক অপূর্ব আসমানী শক্তির তেজোদীপ্ত আলোক ধারায় উদ্ভাসিত হন। এরই মাধ্যমে তাঁকে পার্থিব পরিবেশ থেকে মাধ্যাকর্ষণ স্তর ভেদ করে উর্ধ থেকে উর্ধলোকে এমনকি সৃষ্টি জগতের শেষ সীমা পাড়ি দিয়ে আরও উর্ধে গমনের উপযোগী করে নেয়া হয়। তাঁকে আসমানী পোশাক পরিধান করানো হয়। অতঃপর তাঁকে বুরাকে চড়ে এক নিমিষে জেরুজালেমে নিয়ে আসা হয়। এখানে বায়তুল মুকাদ্দিসে সকল নবী-রসূলের বিশাল জামআতে প্রিয় নবী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইমামতি করেন। তিনি যেসব নবীগণের ইমাম এবং রসূলগণের নেতা অর্থাৎ ইমামুন নাবীয়ীন এবং সাইয়েদুল মুরসালীন তা এখানে প্রমাণিত ও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তিনিই যে প্রথম নবী এবং সর্বশেষ নবী তাও স্পষ্ট হয়ে যায়। অতঃপর তাঁর উর্ধলোক সফর শুরু হয়। সঙ্গে ছিলেন হযরত জিবরাঈল আলায়হিস সালাম। মুহূর্তের মধ্যে প্রথম আসমানের প্রবেশদ্বারে উপনীত হলে আসমানের দ্বাররক্ষী ফেরেশতা তাঁদের পরিচয় জানতে চায়। হযরত জিবরাঈল আসলায়হিস্্ সালাম পরিচয় প্রদান করেন। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে যায়। ফেরেশতারা তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা জানান। এখানে তাঁর সাক্ষাত পরিচয় হয় হযরত আদম আলায়হিস্্ সালামের সঙ্গে, দ্বিতীয় আসমানে সাক্ষাত হয় হযরত ঈসা ও ইয়াহ্্ইয়া আলায়হিস্্ সালামের সঙ্গে, তৃতীয় আসমানে সাক্ষাত হয় হযরত ইউসুফ আলায়হিস্্ সালামের সঙ্গে, চতুর্থ আসমানে সাক্ষাত হয় হযরত ইদরীস আলায়হিস সালামের সঙ্গে, পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আ.) এর সঙ্গে, ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা কলীমুল্লা আলায়হিস সালামের সঙ্গে, সপ্তম আসমানে হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামের সঙ্গে। সব নবী-রসূলের সঙ্গে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় হয়। সপ্তম আসমানে ফেরেশতাদের কাবা বায়তুল মামুরে তিনি অসংখ্য ফেরেশতাদের তওয়াফ করতে ও সালাত আদায় করতে দেখেন। এখানে যে ফেরেশতা একবার সালাত আদায় করেন তাঁর দ্বিতীয়বার সালাত আদায়ের সুযোগ ঘটে না। এই বায়তুল মামুরের ঠিক নিচ বরাবর পৃথিবীতে কাবা শরীফ অবস্থিত। এখান থেকে তিনি সিদ্্রাতুল মুন্্তাহার নিকট উন্নীত হন। সিদ্্রাতুল মুন্্তাহা বা সীমান্ত কুল বৃক্ষের নিকট এসে হযরত জিবরাঈল আলায়হিস সালাম তাঁকে বললেন : এটাই আমার শেষ সীমানা; এই সীমানা অতিক্রম করলে আমি পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাব। এখন শুধু আপনি আর আপনার রব্। সিদরাতুল মুনতাহা থেকে তিনি রফরফে চড়ে ৭০ হাজার নূরের পর্দা পাড়ি দিয়ে স্থান-কালের উর্ধে লামাকান ও লাযামানে উপনীত হন। তিনি নিকট থেকে নিকটতর হলেন। নূর আর নূরের আতিশয্যে তিনি একাকার হয়ে গেলেন, আল্লাহ্্র দিদার লাভ করলেন। বিস্ময় ও আনন্দে নৈকট্য ও পরিপূর্ণতার অপূর্ব অনুভবে অভিভূত হয়ে গেলেন। আল্লাহ্্র যা ওহী করবার ছিল তা ওহী করলেন। কালামে মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তাঁর দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। তিনি তো তাঁর রবের মহান নিদর্শনসমূহ দেখলেন। (সূরা নাজম : আয়াত ১৭-১৮)। মিরাজ শরীফের মাধ্যমে প্রিয়নবী হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম জানা-অজানা, প্রকাশ্য ও গোপন তাবত জ্ঞানের নিদর্শন সরেজমিনে অবলোকন করেন এবং আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহুর কুদ্্রতের সীমা-পরিসীমা প্রত্যক্ষ করে শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ মকামে উন্নীত হন। আল্লাহ্্ শানুহু উম্মতে মুহম্মদীকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করে দেন। এই পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের মরতবাও নির্ধারণ করে দেন দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাতের সমান। বলা হয়েছে : আস্্সালাতু মিরাজুল মুমিনীতÑ সালাত (নামাজ) হচ্ছে মুমিনের জন্য মিরাজ। আমরা সালাতে বসা অবস্থায় যে আত্তাহিয়াতু পাঠ করি সেটা মিরাজকালে আল্লাহ ও তাঁর হাবীবের মধ্যে কথোপকথনেরই বাক্যসমূহ। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল সশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায়। আল্লাহ্্ এই মহাসফরের মাধ্যমে তাঁর হাবীব রসূলুল্লাহ্্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে যেমন সর্বজ্ঞানের অধিকারী করেন তেমনি তিনি যে সরওয়ারে কায়েনাত বিশ্বজগতের নেতা তা সর্বত্র জাহির করে দেন। আল্লাহ্্ হচ্ছেন রব্বুল আলামীন আর তাঁর হাবীব হচ্ছেন রহমাতুল্লিল আলামীন-এটা সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পবিত্র মিরাজের রাত রব্বুল আলামীনের সঙ্গে রহমাতুল্লিল আলামীনের দিদার লাভের রাত, এ এক মহামিলনের রাত। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×