ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দন ॥ ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিম্নতম মূল্যস্ফীতি, উচ্চতম রিজার্ভ

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ৬ মে ২০১৬

অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দন ॥ ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিম্নতম মূল্যস্ফীতি, উচ্চতম রিজার্ভ

একটা সুখবর দিয়ে আজকের কলামটি শুরু করতে চাই। সুখবরটি হচ্ছে : মূল্যস্ফীতি হ্রাস। ‘বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস’ (বিবিএস) এর তথ্য উদ্ধৃত করে বুধবারের কাগজগুলো যে খবর ছেপেছে তাতে দেখা যাচ্ছে এপ্রিল মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। উল্লেখ্য, মূল্যস্ফীতির হার গত কয়েক মাস ধরেই হ্রাস পাচ্ছে। যেমন ৬ শতাংশের নিচে মূল্যস্ফীতি গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই। এ কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করছি এ কারণে যে, এবারই প্রথম মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মূল্যস্ফীতির ওপর তার বাজেট অঙ্গীকার রাখতে সক্ষম হবেন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় তিনি বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতির হার ছয় শতাংশের নিচে থাকবে। দেখা যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির হার নিচু হওয়ার বড় কারণ এই মুহূর্তে চালের দাম হ্রাস। সাদা চোখেও দেখা যাচ্ছে অন্য জিনিসপত্রের দাম নড়াচড়া থাকলেও চালের দাম স্থিতিশীল। এবার আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়। মূল্যস্ফীতি যেমন ছোট আকারে হলেও বেড়েছে, তেমনি মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। ‘বিবিএস’-এর তথ্যে দেখা যাচ্ছে এপ্রিল মাসে জাতীয় মজুরি হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ যে হারে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে মানুষের মজুরি। এটা বড় একটা ইতিবাচক দিক। কারণ মূল্যস্ফীতি ভীতি উদ্রেককারী একটা বিষয়। কিন্তু এর পাশাপাশি যদি মানুষের আয় বাড়ে তাহলে ক্ষতি নেই। বাজারে চালের দাম কেজিপ্রতি ধরা যাক দশ টাকা। কিন্তু মানুষের হাতে যদি দশ টাকা না থাকে তাহলে চালের নিম্ন দামে কার লাভ? অতএব বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে মূল্যস্ফীতির হার ও মজুরি বৃদ্ধির হার এই উভয়ই। অবশ্য এখানে একটা ফাঁক আছে। যারা বেকার তাদের কোন আয় নেই, আবার সবার আয় সমান নয়। কিন্তু হিসাবটা হয় গড়ের। গড়ের হিসাবের এই ফাঁকে কিছু লোকের ভোগান্তি হবেই। সরকারের উচিত হচ্ছে এই দিকে নজর দেয়া। অর্থমন্ত্রী, তার মানে সরকার আরও একটা কৃতিত্বের দাবি করতে পারবেন ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাকালে। সাত শতাংশ ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করা ছিল আমাদের একটা স্বপ্ন। পাঁচ, পাঁচ, ছয়, ছয় শতাংশ করতে করতে আমরা সাত ছুঁতে পারছিলাম না। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার হিসাব করা হয়েছে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ। গরিবের ম্যাট্রিক পাসের মতো। ছোটবেলায় গল্প শুনেছিলাম একটা। গরিবের ছেলে ম্যাট্রিক পাস করেছে। প্রতিবেশী ধনী ঈর্ষায় বলছেÑ হতে পারে, তবে ও চাকরি পাবে না। চাকরি পাওয়ায় বলে, বেতন পাবে না। তাও যখন হলো ধনী প্রতিবেশীর ঈর্ষা যায় না। এবার তিনি বললেন, বেতনের টাকা বাজারে চলবে না। বর্তমান বিশ্বের ধনী দেশ, তাদের প্রতিনিধি এবং এ দেশীয় বশংবদদের একই আচরণ। না, সাত শতাংশ ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধিÑ হতেই পারে না। অথচ তাদের বলা উচিত ছিল, ধন্যবাদ। তোমরা এখন অসাম্য দূর করার চেষ্টা কর। মানুষের জীবন ধারণের মানোন্নয়নের চেষ্টা কর। না তা হওয়ার নয়। কৃতিত্ব তো তারা আরও দিতে পারত। সারা জীবন শুনেছি তারা বলেছে, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বেশি বেশি হলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়ে। কই, তা তো সত্য হচ্ছে না। আমাদের রিজার্ভ দিন দিন বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে। আগে বলা হত ‘রিজার্ভের’ পরিমাণ হতে হবে তিন মাসের আমদানির জন্য যত দরকার তত পরিমাণ ডলার। এখন বলে ছয় মাসের সমান। দেখা যাচ্ছে, আমাদের ডলার আছে সাত-আট মাসের আমদানির সমপরিমাণ। এই যে শক্তি তার প্রশংসা করতে এত কার্পণ্য কেন বুঝি না। এবার একটা ভিন্ন বিষয়। কাগজে দেখলাম বাংলাদেশ ব্যাংক ‘পর্যবেক্ষক’ (অবজার্ভার) দিয়ে ১৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। এর মধ্যে ১৩টি ব্যাংক এবং দুটো হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ১৩টি ব্যাংক হচ্ছে : সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), সাতটি সরকারী ব্যাংক বাদে আছে ছয়টি বেসরকারী ব্যাংক যথা : বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। এদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটো হচ্ছে : পিপলস লিজিং এ্যান্ড ফিনান্সিয়েল সার্ভিসেস এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়েল ফাইন্যান্স কোম্পানি। তালিকাটার দিকে একটু নজর দিলে বোঝা যাবে ‘পর্যবেক্ষকের’ তত্ত্বাবধানে পড়েছে সরকারী খাতের বৃহত্তম ব্যাংক সোনালী ব্যাংক। আবার বেসরকারী খাতের বৃহত্তম ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকও ‘পর্যবেক্ষকের’ তত্ত্বাবধানে। ভিন্নভাবে দেখলে বলা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এই মুহূর্তে দেশের ব্যাংকিং খাতের মোটামুটি এক-তৃতীয়াংশ ব্যাংক ব্যবসা। কমই বললাম, মনে হয় বেশিই হবে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ ব্যাংক যদি নানা কারণে ও নানাভাবে এবং নানা মাপকাঠিতে ‘অসুস্থ’ ব্যাংক হয় তাহলে আর রইল কী? এটা খুব বিপজ্জনক খবর নয় কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন আছে একটা। এই ব্যাংকগুলো একদিন, দুইদিন ‘অসুস্থ’ হয়নি যার জন্য ‘ডাক্তার বাংলাদেশ ব্যাংক’কে সার্বক্ষণিক চিকিৎসায় লাগতে হয়েছে। তাহলেই প্রশ্ন, বাংলাদেশ ব্যাংক পূর্ববর্তী সময়গুলোতে কী করল? তাদের নজরদারি, খবরদারি কোথায় ছিল? বাংলাদেশ ব্যাংক নজরদারি, খবরদারি যাতে ‘পুলিশের’ মতো করতে পারে তার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক স্ট্রেংদেনিং প্রজেক্টের’ অধীন বহু টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় দিয়েছে। সেই টাকায় কত প্রশিক্ষণ হয়েছে। এর অধীনে কত সব বিভাগ করা হয়েছে, গালভরা নাম দেয়া হয়েছে। একেকটা নাম শুনলে পিলে চমকে যায়। না জানি কত বড় ও মহৎ কাজ বিভাগটি করে। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে ১৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘শোয়া’ অবস্থায় থাকে কিভাবে? আরও কথা আছে। মাঝখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় বিদেশী সাহায্যের টাকায় সরকারী ব্যাংকে ব্যাংকে নানা নামের ব্যাংকার নিয়োগ দেয়া হলো। ‘শ্রেষ্ঠ’ সব ব্যাংকার নিয়োজিত হলেন লাখ লাখ টাকা বেতন-ভাতায়। তাদের কাজ ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ‘মানুষ’ করা। তিন-চার-পাঁচ বছর তারা চালালেন। কই কোন উন্নতি নেই কেন? এই যে উন্নতি হয় না, হচ্ছে নাÑএর দায়-দায়িত্ব কার? আজকে এই প্রশ্নটা রেখে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি। নিবন্ধের শেষে আরেকটা সুখবর। খবরটি চীন থেকে আগত। দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তাদের সমীক্ষা মতে চীন তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজার থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে। সরে গিয়ে তারা কোথায় যাবে সেটা আমাদের বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে চীন তৈরি পোশাকের বাজার থেকে সরে গেলে বাংলাদেশ কী কী সুবিধা পেতে পারে। বলা হয়েছে, পোশাকের দর-দাম, মান, লিড টাইমে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রেই পোশাক রফতানি বাড়বে প্রায় ১৪ শতাংশ। বলা হয়েছে তৈরি পোশাক উৎপাদন এক শতাংশ বাড়লে কর্মসংস্থানের পরিমাণ বাড়বে দশমিক তিন থেকে দশমিক চার শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের খবর হচ্ছে, চীনে পোশাক তৈরির খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা চীন থেকে ভিয়েতনাম ও কম্পোডিয়ার দিকে চলে যাচ্ছে। ভীষণ সুখবর। খবরটির কেন্দ্রে হচ্ছে সস্তা শ্রম। বাংলাদেশে শ্রম সস্তা। মজা হচ্ছে বিশ্বের টাকাওয়ালারা যেখানে শ্রমের দাম নেই অথবা কম সেখানেই বিনিয়োগ করে। ঐ দেশের কপালে কী ঘটল সেটা তাদের বিবেচ্য নয়। আবার এটাও ঠিক কোন দেশেই চিরদিন শ্রমকে সস্তা রাখা যায় না। এটাই উন্নয়নের ধর্ম। সেই ধর্ম মোতাবেক বাংলাদেশের সস্তা শ্রম কোন স্থায়ী ঘটনা নয়। অতএব, অনেকেরই ধারণাÑ শুধু সস্তা শ্রমকে সামনে রেখে এগোলে ফল পাওয়া যাবে না। পোশাকের গুণগতমানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। হাই কোয়ালিটি পোশাক তৈরি করতে হবে। শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। শ্রমিকের কারিগরি দক্ষতা বাড়াতে হবে। অবশ্য এসব নিয়ে কথা হচ্ছে অনেক দিন থেকে। বস্তুত পোশাক ব্যবসা বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্রে। সর্বত্রই পোশাক ব্যবসায়ীদের বিচরণ। এই ফাঁকেই তারা একটা কাজ করতে পারেন। এই ব্যবসার বয়স হয়েছে। এখন এই ব্যবসার সত্যি সত্যি ‘ভ্যালু এডিশন’ কত। তারা শুধু রফতানির কথা বলেন। একশ’ টাকা রফতানির বিপরীতে তারা কাপড়, সুতা, রং, বাটন, বক্রম, কেমিক্যাল ইত্যাদি কত টাকার আমদানি করেন? রফতানির বিপরীতে ‘রিটেনশন কোটা’ কত? কত শ্রমিকের চাকরি হয়েছে এবং তাঁত শিল্প থেকে কত শ্রমিকের চাকরিচ্যুতি হয়েছে। পোশাক ব্যবসায় বস্ত্র শিল্পে কতটুকু লাভ-লোকসান হয়েছে। একটা সার্বিক জরিপ হওয়া দরকার। এতে আমরা বুঝতে পারব আমাদের কোনদিকে যাওয়া দরকার। আমরা ম্যানুফেকচারিং খাতের শিল্প বাদ দিয়ে শুধু পোশাক তৈরিতেই ব্যস্ত থাকব কী-না এই প্রশ্নের উত্তরও দরকার। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×