ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চুরি অপরাধ নয়!

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ৬ মে ২০১৬

চুরি অপরাধ নয়!

‘আশ্রয়হীন ও ক্ষুধার্তের চুরি করা অপরাধ নয়’-এই মর্মে ইতালির সর্বোচ্চ আদালতের রায়টি মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। ঘটনা হয়ত সামান্য, তবে এতে রয়েছে অসামান্য দ্যোতনা ও ব্যঞ্জনা। ঘটনাটি ২০১১ সালের। ইউক্রেন বংশোদ্ভূত রোমান অস্ত্রিয়াকভ ইতালির জেনোয়ার একটি সুপার মার্কেট থেকে ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে সামান্য দু’টুকরো পনির, এক প্যাকেট সস ও রুটি সংগ্রহ করেন। পকেটে পর্যাপ্ত পয়সা না থাকায় তিনি কেবল রুটির দাম পরিশোধ করতে সমর্থ হন। বাকি পণ্য লুকিয়ে রাখেন। জনৈক ক্রেতা ঘটনাটি দেখে ফেলে গোচরীভূত করেন মার্কেট কর্তৃপক্ষের। পকেটস্থ খাদ্যপণ্যের মূল্য ছিল ৪ দশমিক ৭১ মার্কিন ডলার। রোমান অস্ত্রিয়াকভকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। ২০১৫ সালে নিম্ন আদালতের রায়ে তাকে দ- দেয়া হয় ৬ মাসের জেল ও ১০০ ইউরো জরিমানা। অতঃপর সরকারী কৌঁসুলি রোমান অস্ত্রিয়াকভের সাজা কমানোর অভিপ্রায়ে আপীল আবেদন করেন সুপ্রীমকোর্টে। তিনি বলেন, অস্ত্রিয়াকভ চুরি নয়, চুরির চেষ্টা করেছিলেন মাত্র। তাছাড়া তিনি চুরি করে দোকানের বাইরে যাননি। শুনানি শেষে সর্বোচ্চ আদালত এক ঐতিহাসিক বিবেচনায় নিম্ন আদালতের রায়টিই বাতিল করে দেন। এক্ষেত্রে আদালতের সুচিন্তিত পর্যবেক্ষণ হলো, রোমান অস্ত্রিয়াকভ চুরি করেছিলেন বাঁচার জন্য। তার থাকার কোন জায়গাও নেই। তাই এক্ষেত্রে চুরিটা অপরাধ হতে পারে না। মানব সভ্যতার ইতিহাস ও অগ্রগতি মূলত সংগ্রামের আলোকে বিরচিত। অজস্র ও অগণিত মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষা-জ্বালা ও যন্ত্রণার ঘর্মাক্ত-ক্লেদাক্ত বন্ধুর পথে মানুষকে এগিয়ে যেতে হয়েছে ও হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের এই নিরন্তর সংগ্রামী পথচলা আজও, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শেষ হয়নি। আদৌ কোন দিন শেষ হবে কিনা, কে জানে! ইউক্রেনের দুর্ভাগ্যতাড়িত রোমান অস্ত্রিয়াকভ তারই একটি ক্ষুদ্র নিদর্শন মাত্র। তিনি ছিলেন আশ্রয়হীন ও ক্ষুধার্ত। জীবন-জীবিকার অনিবার্য তাগিদে পাড়ি দিয়েছিলেন বিদেশ বিভুঁইয়ে। পথে বেরিয়ে পড়লেও জঠর জ্বালা তার পিছু ছাড়েনি। আর তাই নিতান্ত বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর তাগিদে তিনি সামান্য রুটি, সস ও পনির চুরি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। হ্যাঁ, আইনের দৃষ্টিতে এটি চুরিই, সাজার যোগ্য অপরাধও। অন্তত মানব বিরচিত পেনাল কোডে তাই লেখা আছে। তবে বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালত বোধকরি মানুষের বিবেক, যা শুধু মস্তিষ্ক নয়, বরং হৃদয় দ্বারাও পরিচালিত। সর্বোচ্চ আদালতের বিজ্ঞ বিচারকম-লী নিশ্চয়ই হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন, নিরাশ্রয় হতভাগ্য রোমান অস্ত্রিয়াকভ চুরি করেছিলেন নিতান্তই বেঁচে থাকার অনিবার্য তাগিদে। আর তাই এটি কোন অপরাধের পর্যায়ে গণ্য হতে পারে না। প্রচলিত পেনাল কোডের বাইরে এই যে রায়, এটাই মানুষের মেধা ও সৃজনশীলতার চূড়ান্ত বহির্প্রকাশ। এখানেই নিহিত মানবতা ও মানবাত্মার বিজয়গাথা। মানুষ তার সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় ঘোষণা করেছে, ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও, আশ্রয়হীনকে আশ্রয় এবং তৃষ্ণার্তকে জল। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সেই ঘোষণাই আরও বেশি প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যবহ হয়ে উঠেছে। তথাকথিত উন্নত সভ্যতা সৃষ্ট যুদ্ধ বিগ্রহ-সংঘাত-সংঘর্ষে বিশ্ব পরিস্থিতি বর্তমানে টালমাটাল। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া-ইরাক-লিবিয়া থেকে লাখ লাখ শরণার্থীর ঢল নেমেছে ইউরোপ-আমেরিকায়। সে অবস্থায় ইতালীয় সুপ্রীমকোর্ট ইইউকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আশ্রয়হীন ও ক্ষুধার্তের প্রতি যথাযথ কর্তব্যটি।
×