ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাড়িও তৈরি হোক, কবিতাও লিখুক -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৫ মে ২০১৬

বাড়িও তৈরি হোক, কবিতাও লিখুক -স্বদেশ রায়

সৌভাগ্যবশত বলব না কপাল ফেরে বলব, কোন্্টা ঠিক হবে জানি না; কিছুকালের জন্যে কবি নির্মলেন্দু গুণের সহকর্মী ছিলাম। আমি প্রতিদিন অফিস যেতাম গুণদা সপ্তাহে কয়েকদিন আসতেন। সে সময়ে তাঁর সঙ্গে নানান কথা হতো। একদিন তাঁকে বলি, দাদা, ভালো কবিতা পাই না অনেকদিন। তিনি হেসে উত্তর দিলেন, তাঁর কবি বন্ধুরা এখন বাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত। সেদিন গুণদার কথা নিয়ে আমরা অনেকে বেশ হেসেছিলাম। মজা পেয়েছিলাম। তারপরে অফিস শেষে তখনকার অনেক কম ব্যস্ত ঢাকা শহরের এক সারি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচ দিয়ে রিক্সায় ফেরার পথে উপলব্ধি করি, আসলে কবিদের প্রকাশক্ষমতা সবকালেই বেশি। গুণদা এক লাইনে সমকালীন সমাজকে চমৎকার প্রকাশ করেছেন। যা প্রকাশ করতে গেলে আমাদের মতো সাধারণকে পুরো একটা বই লিখতে হতো। আসলে গুণদার ওই দিব্য দৃষ্টির ভেতর দিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দিয়ে চলা রিক্সায় গা এলিয়ে গোটা ঢাকার সমাজটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মনে হলো, অষ্টাদশ শতকের সেই কলকাতাকে দেখতে পাচ্ছি। যেখানে বাড়ি তৈরি হচ্ছে, বাবুরা বিকেলে ছাদে পায়রা ওড়াচ্ছেন, সন্ধে হলে গন্ধওয়ালা রুমাল নিয়ে বাইজীপাড়ায় যাচ্ছেন। আর বারো মাসে তেরো পার্বণ হচ্ছে সহস্র কড়ি খরচে। না বানপ্রস্থ নিয়ে অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগে কলকাতায় কোন আকাক্সক্ষা ওঠেনি। তখন কেবল কর্মযোগ, কেবল রাজসিক যোগ। কলকাতার সমাজে বানপ্রস্থের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে। কলকাতার ওই ঊনবিংশ শতাব্দীর বানপ্রস্থের জোয়ার ঢাকার ত্রিশ ও চল্লিশ থেকে শুরু করে ষাটের দশক অবধি ছিল। তাদেরই শেষ সাক্ষী হিসেবে এখনও ড. আনিসুজ্জামান, ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ড. এনামুল হক আর সর্বকনিষ্ঠদের ভেতর ড. মুনতাসীর মামুন, জাফর ইকবাল এঁরা আছেন। আর বেশিরভাগই বাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত। অবশ্য কিছু কিছু মানুষ যদি একটি সমাজ থেকে বানপ্রস্থে না যায়, সারাজীবন সংসারের কর্মযোগে ব্যস্ত থাকে তাহলে ওই সমাজে বিশ্বামিত্রও হয় না, বশিষ্ঠ হয় না, জাবালিও হয় না। এমনকি তারও চার হাজার বছর পরের চার্বাক ও কৌটিল্যও হয় না। সমাজে বিশ্বামিত্র যেমন থাকে তেমনি বশিষ্ঠও থাকে। বিশ্বামিত্র যেমন রাজকুল ঋষি তেমনি বশিষ্ঠও ক্ষত্রিয় থেকে ঋষিতে উন্নীত হন নিজ চেষ্টায়, একজন যোদ্ধা যখন জ্ঞানচর্চার ভেতর দিয়ে মুণিতে (জ্ঞানী) উন্নীত হন, তা শুধু তাঁর নিজের জীবনের বিপ্লব নয়, একটা সমাজ বিপ্লবের অংশ। সমাজে প্রকৃত বিপ্লব কিন্তু এভাবেই হয়, অস্ত্র দিয়ে সমাজে কোন বিপ্লব করা যায় না। অস্ত্র দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিপ্লব করা যায়, কিন্তু ওই বিপ্লবে সমাজ পরিবর্তন হবে কি হবে না তার কোন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। সমাজ পরিবর্তনের জন্যে প্রতিটি মানুষের নিজের জীবনে বিপ্লব ঘটাতে হয়। আমরা শেখ মুজিবের জীবনের রাষ্ট্রবিপ্লবের সংগ্রামের অংশ দেখি কিন্তু তাঁর নিজেকে পরিবর্তনের বিপ্লবের সংগ্রাম কিন্তু দেখি না। সামগ্রিকভাবে সমাজ নেতাকে বা তাঁর মতো ঋষিকে বুঝতে হলে তাঁর জীবনের ভেতরের বিপ্লবটিও বুঝতে হবে। যাক সে আলোচনা এ ক্ষুদ্র পরিসরে নয়, এ কাজ আবার কোন ব্যস বা মাইকেল জন্মালে মহাকাব্য লিখে করতে পারেন বা কোন রাসেল বা রুশো জন্ম নিলে তারা করতে পারবেন। আমাদের মতো সাধারণের নয়। যাহোক, রাষ্ট্রবিপ্লবের মধ্য দিয়ে কোন রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে বা ইতিহাসের পরিক্রমায় কোন রাষ্ট্র তার প্রবাহিত পথে, সমাজকে অবশ্যই পরিবর্তন অর্থাৎ এগিয়ে চলার পথ করে দিতে বাধ্য থাকে। এটা রাষ্ট্রের কর্তব্য। রাষ্ট্র কখনই নিজে সমাজ বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে না। রাষ্ট্র নিজে এ কাজে অংশগ্রহণ করতে গেলে অন্য রকম শিকলে আটকা পড়ে যায় সমাজ, যাকে বলা যেতে পারে রাষ্ট্রীয় শিকল। আর যাই হোক রাষ্ট্রীয় শিকল কখনও সমাজের গলায় পরানো উচিত নয়। সমাজ কখনই গৃহপালিত নয়, সমাজ স্বয়ম্ভু- স্বাধীন। রাষ্ট্রকে শুধু লক্ষ্য করতে হয়, নিশ্চিত করতে হয়, সমাজে বিশ্বামিত্রের পাশাপাশি বশিষ্ঠ, জাবালি এমনকি ওই পথ পরিক্রমায় চার্বাক ও কৌটিল্য নির্বিঘেœ বাস করতে পারছে কিনা! কথা বলতে পারছে কিনা নির্বিঘেœ। স্বাভাবিক সমাজে ঋষির খাবার বলে যে খাবার চিহ্নিত তাই বিশ্বমিত্র খেতেন। জাবালির প্রিয় ছিল কুক্কুট (মোরগ বা মুরগি) মাংস। তিনি তাই খেতেন। ওই সমাজ তাকে কখনই বাধা দেয়নি। এমনকি, রাম যখন বনবাসে যান পিতৃসত্য পালনের স্বার্থে, সবাই যখন তাকে ধন্য ধন্য করে। জাবালি এসে কিন্তু রামকে বলেন উন্মত্ত। তিনি রামকে বলেন, রাম ভুল করছে। রামের গতিপথ আটকে জাবালি তাকে বলেন, “রাম! তুমি অতি সুবোধ, সামান্য লোকের ন্যায় তোমার বুদ্ধি যেন অনর্থদর্শিনী না হয়। দেখ, কে কাহার বন্ধু? কোন্ ব্যক্তিরই বা কোন্্ সম্বন্ধে কি প্রাপ্য আছে? জীব একাকী জন্ম গ্রহণ করে এবং একাকী বিনষ্ট হয়। অতএব মাতা-পিতা বলিয়া যাহার স্নেহাসক্তি হইয়া থাকে তাহারা উন্মত্ত। ... দেখ জন্ম বিষয়ে পিতা নিমিত্ত মাত্র বলিয়া নির্দিষ্ট হন, বস্তুত মাতা ঋতুকালে গর্ভে যে শুক্রশোনিত ধারণ করেন, তাহাই জীবোৎপত্তির উপাদান। এক্ষণে রাজা দশরথ যেস্থানে যাইবার গিয়াছেন, ইহাই মনুষ্যের স্বভাব। কিন্তু বৎস! তুমি স্ববুদ্ধিদোষে বৃথা নষ্ট হইতেছ। যাহারা প্রত্যক্ষসিদ্ধ পুরুষার্থ পরিত্যাগ করিয়া কেবল ধর্ম লইয়া থাকে, আমি তাহাদিগের নিমিত্ত ব্যাকুল হইতেছি, তাহারা ইহলোকে বিবিধ যন্ত্রণা ভোগ করিয়া অন্তে মহাবিনাশ প্রাপ্ত হয়। লোকে পিতৃদেবতার উদ্দেশে অষ্টকা শ্রাদ্ধ করিয়া থাকে। দেখ ইহাতে কেবল অন্ন অনর্থক নষ্ট হয়। কারণ কে কোথায় শুনিয়াছে যে মৃত ব্যক্তি আহার করিতে পারে। যদি একজন ভোজন করিলে অন্যের শরীরে উহার সঞ্চার হয়, তবে প্রবাসীর উদ্দেশে এক ব্যক্তিকে আহার করাও, উহাতে কি ওই প্রবাসীর তৃপ্তি লাভ হইবে? কখনই না। যে সমস্ত শাস্ত্রে দেবপূজা, যজ্ঞ, দান ও তপস্যা প্রভৃতি কার্যের বিধান আছে, ধীমান মনুষ্যেরা কেবল লোকদিগকে বশীভূত করিবার নিমিত্ত সেই সকল শাস্ত্র প্রস্তুত করিয়াছেন”। (হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনুবাদিত বাল্মীকি রামায়ণ)। জাবালিরও চার হাজার বছর পরে চার্বাক ছিলেন, তিনিও তার বিবেচনা মতো কথা বলেছেন। তিনিও পৃথিবীর এই সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পর্ক, এই সাক্ষাত দেবতা পিতা-মাতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, পিতাই বা কে, মাতাই বা কে, আবার সহোদরাও বা কে, দেহের সঙ্গে যেখানে আত্মার সম্পর্ক নেই। সেখানে কার জন্য এ পৃথিবীতে বেদনাভার নেবে? যুগে যুগে ইতিহাসের পরিক্রমায় এ রকম নানান মতের মানুষ সমাজে থাকে। কেউ কৈশোর বা তারুণ্যে থাকে। আবার কেউবা বানপ্রস্থে যাবার পরে, স্থিত মাথায় চিন্তা করে নিজের জীবনে, নিজের চিন্তায় পরিবর্তন আনে। বানপ্রস্থে যে সকলকে যেতে হয় তা কিন্তু নয়, সমাজের কিছু অংশ গেলেই চলে; যেমন দীর্ঘ রাস্তায় কিন্তু প্রতি ইঞ্চিতে বাতি জ্বালার প্রয়োজন পড়ে না। কয়েকটি উজ্জ্বল বাতি জ্বলে উঠলেই অন্ধকার চলে যায়। তাই যারা বাড়ি তৈরি করছে তারা বাড়ি তৈরি করুক, অন্তত কয়েকজন বানপ্রস্থে গেলে চলে। আর সেই বানপ্রস্থ তো আর জঙ্গলে চলে যাওয়া নয়। জাবালিও কিন্তু জঙ্গলে যাননি, তিনি নিরিবিলি পরিবেশে তাঁর জ্ঞান চর্চা করার জন্যেই চিত্রকুট পর্বতে বাড়ি করেছিলেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন করেছিলেন। সবাইকে যে শান্তিনিকেতন বা চিত্রকুট পর্বতে বাড়ি তৈরি করতে হবে তাও কিন্তু নয়। রবীন্দ্রনাথের ওই অসংখ্য বন্ধন মাঝে মুক্তির স্বাদ নেবার চরিত্রটি গঠন করলে হলো। যাকে রামকৃষ্ণ অতি সহজ ভাষায় বলেছেন, পাঁকে থাকো, পাঁকাল মাছের মতো, গায়ে যেন পাঁক না লাগে। আবার রাজহাঁসের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, জলে থাকো রাজহাঁসের মতো, যেই তুমি ডাঙ্গায় উঠলে অমনি ডানা ঝেড়ে ফেলো। এক ফোঁটা পানি রেখো না। তাই সংসারের লোভ-লালসা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ সবকিছুর মধ্যে আমাদের থাকতে হয়। তারপরেও জীবনে একটা বানপ্রস্থের দরকার আছে। সেটা সারাদিনের একটা নির্দিষ্ট সময় হোক, যখন চিন্তা ও চর্যা সুস্থ হয়, সমাজ না হোক নিজের জীবনটাকে পরিবর্তন করা যায়- যাতে বাড়িও তৈরি হয় আবার কবিতাও থাকে। নইলে কবিতাশূন্য সমাজে যত বড় বাড়ি হোক না কেন, তাকে তো বস্তিই মনে হবে। আর ওই বাড়িতে এক সময় কবিতাশূন্য অন্ধকারের জীবরা বাস করবে। তাই একে ঠেকাতে হবে। এ কাজটি নিজেকেই করতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু বিশ্বামিত্রর পাশাপাশি যেন জাবালিও নিরাপদে থাকতে পারে, অপগ- বালখিল্যদের দ্বারা যেন জাবালি আক্রান্ত না হয়। [email protected]
×