ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা ॥ মদদদাতাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা

সিঙ্গাপুর ফেরত ৫ জঙ্গী ৭ দিনের রিমান্ডে

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৫ মে ২০১৬

সিঙ্গাপুর ফেরত ৫ জঙ্গী ৭ দিনের রিমান্ডে

শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গী সম্পৃক্ততায় সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানোর পর ঢাকায় গ্রেফতার হওয়া ৫ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা করেছে পুলিশ। সন্ত্রাস দমন আইনে তাদের ঢাকা মহানগর আদালতে পাঠিয়ে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানানোর পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুগত অভিহিত হওয়ার অভিযোগে সিঙ্গাপুরে আটক হওয়া অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে জিহাদি কর্মকা-ে অংশ নেয়ার স্বপ্ন দেখতেন। জিজ্ঞাসাবাদ করে খুঁজে বের করার চেষ্টা হচ্ছেÑ সিঙ্গাপুরে জঙ্গী সম্পৃক্ততায় উদ্বুদ্ধকরণ এবং দেশে ফেরত আসার পর সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা, গুপ্তহত্যার তালিকা তৈরি, জঙ্গী সংগঠন সংগঠিত করতে দেশে ও বিদেশে তাদের মদদ দিয়েছে কারা? তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ সূত্রে এ খবর জানা গেছে। অপরদিকে সিঙ্গাপুরে গ্রেফতারকৃত ৮ বাংলাদেশীকে সিঙ্গাপুরের ইন্টারন্যাল সিকিউরিটি আইনে দুই বছর আটক রাখার আদেশ দিয়েছে সিঙ্গাপুর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের দূতাবাস ও সিঙ্গাপুর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে সাধারণ শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা, নিরাপত্তা ও দেশের ভাবমূর্তি যাতে ক্ষুণœ না হয় সে প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে। ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, সিঙ্গাপুর পুলিশ বলছে জঙ্গী সন্দেহে আটককৃতরা জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। বাংলাদেশে তারা জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা করেছিল বলে সংবাদ প্রকাশিত হয় সিঙ্গাপুরের সংবাদমাধ্যমে। সিঙ্গাপুরের সংবাদমাধ্যম স্ট্রেইট টাইমসের খবরে বলা হয়Ñ এরা জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুগত। সেখানে তারা চরমপন্থী ধারণা ও মতামত নিয়ে আলাপ-আলোচনা করত। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বইপত্রও বিনিময় করত তারা। সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর জন্য তারা সিঙ্গাপুরে থাকা বাংলাদেশী জাতীয়তার লোকজনকে প্রভাবিত করার চেষ্টাও করছিল। আটককৃতদের মধ্যে একজন গোপন বৈঠকের সাথী না হলেও তার কাছে চরমপন্থায় জড়িত থাকার আলামত পাওয়া গেছে। সিঙ্গাপুরের সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে ফিরে এসে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদি কর্মকা-ে অংশ নেয়ার ইচ্ছা ছিল তাদের। তাদের কাছে বিভিন্ন জিহাদি সরঞ্জাম পাওয়া গেছে বলে সিঙ্গাপুর পুলিশের দাবি। সিঙ্গাপুরে আটককৃতরা দীর্ঘদিন থেকে নজরদারিতে ছিল। গোপন তথ্যের ভিত্তিতেই গ্রেফতার করা হয় তাদের। সিঙ্গাপুর সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছেÑ সিঙ্গাপুরে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করত আটক বাংলাদেশীরা। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও ইরাক-সিরিয়ায় সক্রিয় জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতাদর্শকে সমর্থন করে সপ্তাহে একবার বৈঠকে মিলিত হতো তারা। তারা সশস্ত্র জিহাদ নিয়ে আলোচনা করত গোপন বৈঠকে। দেশে ফিরে কিভাবে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা যায়, তারা বৈঠকে তা নিয়েও আলোচনা করত। ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর ॥ সূত্র জানায়, সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানো ৫ বাংলাদেশীকে ঢাকায় গ্রেফতারের পর বুধবার তাদের ঢাকার মহানগর আদালতে পাঠিয়ে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। আদালতে হাজির করার আগে তাদের বিরুদ্ধে রামপুরা থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মুনছুর আলী। শুনানি শেষে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মহানগর হাকিম আলী মাসুদ শেখ। গ্রেফতার হওয়া ৫ বাংলাদেশী হচ্ছেনÑ মোঃ মিজানুর রহমান ওরফে গালিব হাসান (৩৮), মোঃ রাহা মিয়া পাইলট (২৯), মোঃ আলমগীর হোসেন (৩১), মোঃ তানজিমুল ইসলাম (২৪) ও মোঃ মাসুদ রানা ওরফে সন্টু খান (৩১)। সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানোর পর মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর বনশ্রী এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। জামিন নাকচ ॥ সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আসা পাঁচজনের আইনজীবী রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিনের আবেদন করেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতকে বলেন, তারা সবাই বৈধভাবে সিঙ্গাপুরে ছিলেন। মাঝে মধ্যে দেশেও এসেছেন। তারা কোন ধরনের জঙ্গী কর্মকা-ে যুক্ত নন। পুলিশের রিমান্ড আবেদনে বলা হয়Ñ ওই পাঁচ বাংলাদেশী জঙ্গীগোষ্ঠী আনসার আল ইসলামের নামে সদস্য সংগ্রহ করছিলেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে তথ্যের জন্য তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। শুনানি শেষে অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আলী মাসুদ শেখ জামিন নাকচ করে পাঁচজনকে সাত দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। জঙ্গী সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেননি ॥ সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ৮ বাংলাদেশীর আটকের ঘোষণায় বলা হয়Ñ তারা ইসলামিক স্টেট ইন বাংলাদেশের (আইএসবি) সদস্য। সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানো পাঁচজনকে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর বনশ্রী থেকে গ্রেফতার করে বুধবার আদালতে যে রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়েছে তাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুরে আটক বাংলাদেশীদের জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে কোন অভিযোগ করেননি। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের ও রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার সময়ে তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গী সম্পৃক্ততার অভিযোগ ছিল না। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত অন্যান্য দেশের লোকজনও জঙ্গী সম্পৃক্ততায় জড়িত আছে বলে অভিযোগ আছে। অন্যান্য দেশের লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে মটিভেটেড হয়ে জঙ্গী সম্পৃক্ততায় জড়িত হয়েছে কিনাÑ সে বিষয়গুলোও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সিঙ্গাপুরে দুই বছরের আটকাদেশ ॥ সিঙ্গাপুরের ইন্টারন্যাল সিকিউরিটি আইনে সেখানে গ্রেফতার হওয়া ৮ বাংলাদেশীকে দুই বছর আটক রাখার আদেশ দিয়েছে সিঙ্গাপুর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ। সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তারা গ্রেফতার হওয়া আট বাংলাদেশী নাগরিক ইসলামিক স্টেট অব বাংলাদেশ (আইএসবি) নামের একটি সংগঠন তৈরির পরিকল্পনা করছিল বলে তদন্তে পেয়েছে। এরপর গত মাসের শেষের দিকে তাদের গ্রেফতার করে তারা। নাশকতার পরিকল্পনাকারী ওই বাংলাদেশী নাগরিকরা প্রায় ১০ বছর ধরে সিঙ্গাপুরে শ্রমিকের কাজ করে আসছে। এর মধ্যে তারা বেশির ভাগ সামুদ্রিক কারখানা ও স্থানীয় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করত। তবে তারা নির্দিষ্ট কোন কোম্পানিতে কাজ করত না বলেও জানিয়েছে সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ। সিঙ্গাপুরগামী জনশক্তির তথ্য দিতে হবে ॥ সিঙ্গাপুরে বসে বাংলাদেশে নাশকতার পরিকল্পনাকারী ৮ বাংলাদেশীকে গ্রেফতারের পর প্রবাসী বাংলাদেশীদের নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে সিঙ্গাপুরে। সেখানে চলছে আলোচনা ও সমালোচনা। বাংলাদেশী শ্রমিকদের ওয়ার্ক পারমিট দেয়ার আগে আরও তথ্য সংগ্রহ করার তাগিদ দিয়েছে একাধিক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান এ ধরনের মতামত দিয়েছে সেখানকার দ্য স্ট্রেইট টাইমসকে। শ্রমিকের বাবা-মায়ের নাম, পারিবারিক অতীত কেমন ছিল ও নিজের জেলা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য প্রয়োজন হবে। তবে গত বছরের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশী শ্রমিকদের এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে সিঙ্গাপুরে। গত বছরের নবেম্বর ও ডিসেম্বরে সিঙ্গাপুরের নিরাপত্তা বাহিনী ২৭ বিপথগামী বাংলাদেশী শ্রমিককে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। আরও আটজন বাংলাদেশী বিপথগামীকে গ্রেফতার করে ২ বছরের আটকাদেশ দিয়েছে তারা। প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় এ তথ্য জানায় দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সিঙ্গাপুর সরকারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ এর আগে চার মাসের ব্যবধানে গত জানুয়ারিতে ২৭ বাংলাদেশীকে সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠিয়েছিল জঙ্গী সম্পৃক্ততার অভিযোগে। তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়ার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ॥ সিঙ্গাপুরে আটক বাংলাদেশীরা আইএস সদস্য কিনাÑ সেটা এখনও নিশ্চিত নয়, নিশ্চিত হতে আরও তদন্তের প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামান। গত দুই দিনে গণমাধ্যমের সঙ্গে এ ধরনের মন্তব্য করে তিনি বলেন, দুই দেশের নিরাপত্তা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে, তথ্য আদান-প্রদান চলছেÑ এটাই সর্বশেষ পরিস্থিতি।
×