ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ

সুপারসনিক যাত্রী বিমান কি ফিরে আসবে

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ৪ মে ২০১৬

সুপারসনিক যাত্রী বিমান কি ফিরে আসবে

এক সময় লন্ডন-প্যারিস-নিউইয়র্কের মধ্যে সুপারসনিক যাত্রী বিমান কনকর্ড চলাচল করত। ব্রিটেন-ফ্রান্সের যৌথ মালিকানাধীন কনকর্ড কোম্পানির সেই বিমান ছিল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক বিস্ময়। এটি চলত শব্দের গতিকে ছাড়িয়ে। লন্ডন থেকে নিউইয়র্কে যেতে সময় লাগত মাত্র ৩ ঘণ্টা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যবসায় লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে যান কনকর্ড। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ১৪টি কনকর্ড বিমান চলত। এর প্রচ- শব্দে ডেভন ও কর্নওয়ালের জানালার কাঁচ ঝনঝন করত। ছাদের টাইলস খসে পড়ত। বিমানের পরিবহন খরচ ছিল অত্যধিক। যাত্রীভাড়া ছিল অসম্ভব বেশি। প্রচুর তেল খেত কনকর্ড। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সরকারকে এই কোম্পানির পেছনে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হতো। ২০০০ সালে প্যারিসে কনকর্ড বিমানের এক ভয়াবহ দুর্ঘটনাও ঘটে। সবকিছু মিলে কনকর্ড চালানো আর ব্যবসায়িকভাবে সম্ভব হয়নি। ২০০৩ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। কনকর্ডের প্রচ- শব্দ একটা বাড়তি ঝামেলাও ছিল। সেই ঝামেলা থেকে বেঁচে যায় মানুষজন। কিন্তু সেই কনকর্ডের অর্থাৎ সুপারসনিক যাত্রী বিমানের আবার ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে তার আগে শব্দপ্রাচীর ভেদ করার সময় যে প্রচ- আওয়াজ হয় সেটা কমাতে হবে এবং সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। নাসার ইঞ্জিনিয়াররা মনে করেন, শব্দপ্রাচীর ভেদ করার সময় যে সনিক বুম হয় সেটা কমিয়ে আনার একটা উপায় তারা খুঁজে পেয়েছেন। মার্কিন বিমান কোম্পানি লকহীড সনিক বুমের তীব্রতা কমানোর এক পরীক্ষামূলক প্রকল্পে নাসাকে নিয়োগ করেছে। সবকিছু ঠিকমতো চললে লকহীড ২০১৯ সালে পরীক্ষামূলকভাবে এমন বিমান তৈরি করে চালিয়ে দেখবে যে যাত্রী নিয়ে ওটা সুপারসনিক গতিতে ছুটে যাওয়ার সময় সনিক বুমকে এমন শব্দে রূপান্তরিত করা যাবে কিনা যাতে দূরে কোথাও মৃদু ধাক্কার শব্দ বলে মনে হয়। কনকর্ডের, জেট জঙ্গীবিমানের ও মহাকাশ খেয়াযান থেকে বড় যে সনিক বুম হয় তা একটি শকওয়েভের কারণে সৃষ্টি হয় না। বিমান শব্দের গতির চেয়ে বেশি গতিতে ছুটে চলার সময় এর বিভিন্ন অংশ থেকে বেশ কিছু শকওয়েভ বিকিরিত হয় এবং সেগুলোর মিথস্ক্রিয়া থেকেই উৎপন্ন হয় সনিক বুম। বলাবাহুল্য শব্দের গতি হচ্ছে সমুদ্র সমতলে ঘণ্টায় ৭৭০ মাইল। একে বলে ম্যাক ১। বিমান এই গতির নিচে থাকলে এর সামনে বাতাসের মলিকুলগুলো দুপাশে তরঙ্গের আকারে সরে যায় ঠিক যেমন নৌকা পানিতে চলার সময় তরঙ্গ তৈরি হয়। কিন্তু বিমান যখন শব্দের গতিকে ছাড়িয়ে যায় তখন এর সামনে বাতাসের মলিকুলগুলো অত দ্রুত সরে যেতে পারে না বরং বিমানের বিশেষ বিশেষ স্থানে পুঞ্জীভূত হয়। এতে নিমেষের মধ্যে চাপের পরিবর্তন ঘটে এবং তার ফলেই শকওয়েভ সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে থাকে বিপুল পরিমাণ সাউন্ড এনার্জি বা শব্দগত শক্তি। প্রথম শকওয়েভটা ঘটে বিমানের নাকে। অন্যগুলো ডানার সামনের প্রান্তে ও ইঞ্জিনের নালীগুলিতে। বায়ুচাপের দ্রুত পরিবর্তন আবার স্বাভাবিক বায়ুম-লীয় পর্যায়ে ফিরে গেলে বিমানের পেছনের অংশে একটা রিকম্প্রেশন শক সৃষ্টি হয়। এই শকওয়েভগুলো বিমানের গা থেকে বিকিরিত হয়ে সরে গিয়ে পুঞ্জীভূত হয় এবং প্রধান দুটো শকওয়েভ সৃষ্টি হয়। সে কারণেই সুপারসনিক জেট মাথার ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়শই আমরা দুটো ‘বুম’ শব্দ শুনি সনিক বুমের সর্বোচ্চ চাপ দুটি প্রবক্ষে তোলা হলে ইংরেজী ‘এন’ আকৃতির মতো দেখাবে। নাসা এখন বিভিন্নভাবে সুপারসনিক জেটের ডিজাইনে এমন পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে যাতে সনিক বুমের ‘এন’ তরঙ্গের আকারটা ঈষৎ বদলে গিয়ে ইংরেজী বর্ণ ‘ইউ’র আকৃতি ধারণ করে। তাতে শব্দের তীব্রতা বেশ কমে আসবে। নাসা এর আগে একটি সংশোধিত এফ-৫ জেট জঙ্গীবিমানে পেলিকোনের নাকের আদলে প্রসারিত নাক লাগিয়েছিল যাতে সনিক বুমের আওয়াজ কম হয়। তাছাড়া কম্পিউটার সনিক বুম সিমুলেটর ব্যবহার করেও দেখা হয়েছে কোন্ ধরনের শব্দ মানুষের কাছে কম বিরক্তিকর হবে। নতুন যে ডিজাইনটি করা হয়েছে তালো একটি এক আসনের এক ইঞ্জিনের জেট বিমান। স্বভাবতই এর বৈশিষ্ট্য হলো লম্বা ও সরু ত্রিকোনাকার নাক। এতে বিমানের সামনের সৃষ্ট শকওয়েভের আকৃতি বদলে যাওয়ার এবং তা ছত্রখান হয়ে পড়ার কথা। অন্য বৈশিষ্ট্য হলো ওপরের ডানায় যুক্ত ইঞ্জিনের আকার এমনভাবে বদলে দেয়া যাতে তা ওখানে গড়ে ওঠা শকওয়েভের তীব্রতা কমিয়ে দেয়। শব্দের উৎপাত আরও কমানোর জন্য বিমানটি কনকর্ডের গতির চেয়ে কম গতিতে উড়বে। বলাবাহুল্য কনকর্ডের গতি ছিল ম্যাক ২ বা ঘণ্টায় ১৫৪০ মাইল। পরীক্ষামূলক এই নিশানের কারণে যে সনিক বুম হবে তার তীব্রতা কনকর্ডের চাইতে ৩০ শতাংশ কম হবে। সেই শব্দ মাটিতে থাকা মানুষের কাছে সহনীয় হবে। বিমানটির পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের সময়ই প্রমাণ হবে মানুষের প্রতিক্রিয়া কী হবে। কথা হয়েছে এই পরীক্ষায় সৃষ্ট সনিক বুম যদি মানুষের সহনীয় হয় তাহলে কী আবার সুপারসনিক গতিতে মানুষ বিমান ভ্রমণ করতে পারবে? সেই কনকর্ডের মতো বিমান সার্ভিস কি আবার ফিরে আসবে? এ প্রশ্নের জবাব একমাত্র ভবিষ্যতই দিতে পারে। সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট
×