ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

অর্থনৈতিক দুর্বিপাকে ধুঁকছে ভেনিজুয়েলা

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ৪ মে ২০১৬

অর্থনৈতিক দুর্বিপাকে ধুঁকছে ভেনিজুয়েলা

ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্যোগের মধ্যে চলেছে দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্র ভেনিজুয়েলা। পর পর দু’বছর জরিপ প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গের হিসাবে ভেনিজুয়েলা বিশ্বের সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতির দেশ। গত বছরের শেষ দিকে যেখানে দেশটির মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ১৪১.৫ শতাংশ সেখানে এ বছর তা আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী ৭২০ শতাংশে পৌঁছবে। দেশটির মুদ্রা বলিভারের মূল্যমান অতি কম। এক ডলার কিনতে লাগে ৮০০ বলিভার। ভেনিজুয়েলার এই শোচনীয় অবস্থা কেন হলো? প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এজন্য দুটো বিষয়কে দায়ী করেছেন। এক. চোরাচালান। ভেনিজুয়েলার মুদ্রার দাম পড়ে যাওয়ায় সেখান থেকে গ্যাসোলিন, কমলা ও ডায়াপারের মতো সাধারণ পণ্যসামগ্রী অতি সহজেই সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র কলম্বিয়ায় পাচার হয়ে যাচ্ছে। দুই. ভেনিজুয়েলার অতিমাত্রায় ভর্তুকিপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ নিতে বাইরে থেকে চোরাপথে লোক পাচার হয়ে আসবে। তবে এর বাইরে আরেকটা সত্যও আছে। ভেনিজুয়েলার অর্থনৈতিক সমস্যার শুরু মাদুরোর পূর্বসূরী প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের সময় থেকে। দেশটির রফতানি আয়ের ৯৭ শতাংশ আসে তেল থেকে। কিন্তু তেলের দাম ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকায় তার রফতানি আয়ও ক্রমশ কমে আসছিল। তারপর তো তেলের দামে রীতিমতো ধস নামে। গত এক বছরের বেশি ভাগ সময় তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলার থাকায় ভেনিজুয়েলার বার্ষিক রফতানি আয় নেমে আসে ৩ হাজার কোটি ডলারে। এই অর্থ দিয়ে ৩ কোটি লোকের দেশের খরচ মিটানো চাট্টিখানি কথা নয়। এতদিন দেশটা কিভাবে চলেছে সেটাই এক আশ্চর্য ব্যাপার। প্রেসিডেন্ট মাদুরো গত বছর চোরাচালান দমনের পদক্ষেপ ঘোষণা করে প্রধান প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেন। তারপরও পণ্য পাচারের আর্থিক প্রণোদনা এতই বেশি যে সেটাকে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। পরিসংখ্যান বলে যে চোরাচালান ব্যবসা আগের পর্যায়ে ফিরে গেছে। আর এর মাধ্যমে ভেনিজুয়েলার পণ্য বাইরে বিশেষত কলম্বিয়ায় পাচার হয়ে যাচ্ছে। কলম্বিয়ার চোরাচালানকারীরা দুদেশের অভিন্ন সীমান্ত একটি নদীপথ দিয়ে ভেনিজুয়েলায় আসে। সেখানকার সীমান্তবর্তী ছোট শহর সান ফস্টিনোতে তাদের দালালরা আগে থেকেই পণ্য নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। সেই পণ্য হাতবদল হয়ে কলম্বিয়ায় চলে যায় এবং চড়া দামে বিক্রি হয়। এভাবেই রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিপ্রাপ্ত ভেনিজুয়েলার সুপার মার্কেট মেরকাল থেকে ৫৪ ডলারে কেনা ৬০ কেজি গরুর মাংস সীমান্তের ওপারে কুকুটা শহরে যখন পৌঁছে তখন সেই একই মাংস বিক্রি হয় ২শ’ ডলারে। মাদুরো সরকার এই চোরাচালানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেও সফল হচ্ছে না। কারণ সর্ষের মধ্যেই ভূত রয়ে গেছে। চোরাচালান যারা ঠেকাবে সেই পুলিশই ঘুষ খেয়ে চোরাচালানে সহায়তা করছে। প্রতি চালানে পণ্য ও মূল্য ভেদে ৩ থেকে ২৫ ডলার ঘুষ নিয়ে থাকে। এভাবে সান ফস্টিনো থেকে মালবোঝাই ছোট ছোট অসংখ্য ট্রাক রাতের অন্ধকারে কুকুটায় পৌঁছে। নদীর ওপর দিয়ে দুই শহরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী একমাত্র যে সেতুটির ওপর দিয়ে সেগুলো এতদিন পারাপার করে আসছিল সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট মাদুরোর নির্দেশে সেটি যান চলাচলের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে মালবোঝাই হোক বা না হোক কোন ট্রাক বা অপর কোন যান এই দুই শহরের মধ্যে আসা-যাওয়া করতে পারছে না। যারা হেঁটে সেতু পারাপার করছে তাদের কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখছে পুলিশ ও কাস্টমসের লোকজন। তথাপি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এত নজরদারির মধ্যেও চোরাচালান এক মুহূর্তের জন্য থেমে নেই। ঠিকই চলছে। যারা পুবদিক পাড়ি দিয়ে ভেনিজুয়েলার ইউবিনা শহরে আসছে সাধারণত তারা খালি হাতেই আসছে অথবা সঙ্গে করে আনছে একটা ব্যাকপ্যাক। যখন তারা ফিরে যাচ্ছে তখন সেই ব্যাকপ্যাকটাই মালপত্রে ঠাসা হয়ে বিশাল আকার ধারণ করছে। কারণ ওর মধ্যে বেবী ডায়াপার থেকে শুরু করে সিগারেট ও রান্নার তেল পর্যন্ত সমস্ত বেআইনী আমদানি পণ্যই আছে যা ভেনিজুয়েলায় কলম্বিয়ার তুলনায় অনেক সস্তা। ভেনিজুয়েলায় কাজ করতে আসা এসব বেশিরভাগ কলম্বীয় নাগরিক আগে বছরের পর বছর ভেনিজুয়েলাতেই বসবাস করত। গত বছরের শেষ দিকে চোরাচালানকারীর সন্ধানে নিয়োজিত তিনজন ভেনিজুয়েলীয় সৈন্যের হত্যাকা-ের পর মাদুরো চোরাচালান ও অভিবাসন উভয়ের বিরুদ্ধে অভিযান ঘোষণা করেন। হাজার হাজার কলম্বীয় নাগরিককে বহিষ্কার করা হয়। আরও ২০ হাজার প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যায়। পরে দুই সরকারের মতৈক্য অনুযায়ী স্কুলে পড়াশোনা বা চিকিৎসা নেয়ার জন্য ভেনিজুয়েলায় ফিরে আসতে দেয়া হয়। তবে রাতের বেলায় সীমান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ থাকে। কিন্তু যে দেশে আইনের শাসন দুর্বল সেখানে রাতের বেলায় স্রেফ কয়েকটা সেতু বন্ধ রাখলেই ভেনিজুয়েলা থেকে রফতানি নিষিদ্ধ পণ্য বাইরে পাচার ঠেকানো যাবে এমন চিন্তা করা কঠিন। তাই ভেনিজুয়েলা থেকে বিভিন্ন পথে ও উপায়ে কলম্বিয়ায় পণ্য পাচার যথারীতি চলছে। সেই সঙ্গে চলছে পুলিশের ঘুষবাণিজ্য। আর তাতে করে ঘনীভূত হচ্ছে ভেনিজুয়েলার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। এই বিশাল চোরাচালান শিল্পকে ধ্বংস করা চাট্টিখানি কথা নয়। সূত্র : টাইম
×