ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজস্বে কূটকৌশল- এক

তামাক কোম্পানির অপতৎপরতায় হুমকিতে এসডিজি

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ৪ মে ২০১৬

তামাক কোম্পানির অপতৎপরতায় হুমকিতে এসডিজি

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ তামাক কোম্পানির অপতৎপরতায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) হুমকির মুখে পড়েছে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণাকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। ইতোমধ্যেই বাজেটে কর না বাড়াতে নানা তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, প্রাক বাজেট আলোচনার নামে নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করা, অর্থ মন্ত্রালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘন ঘন বৈঠক, সংসদ সদস্যদের দিয়ে ডিও লেটার (আধা সরকারী পত্র) পাঠানো ইত্যাদি। ইতোমধ্যেই এগুলোর নমুনাও পাওয়া গেছে। অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান তামাকের কর বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, এসডিজির বাস্তবায়ন চাইলে এফসিটিসি অনুযায়ী তামাক পণ্যে অধিকহারে কর বাড়ানো উচিত। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি কমদামী সিগারেটে কর বাড়ালে বেশি রাজস্ব পাওয়া যাবে এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। কেননা বেশি দামী সিগারেটের ভোক্তা কম। সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় স্পীকারদের শীর্ষ সম্মেলন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, উন্নয়ন ও সুস্বাস্থ্যের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক বিদ্যমান। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি তামাকজনিত রোগ-বালাই এবং অসংক্রামক রোগের অব্যাহত প্রকোপ হ্রাসে এ অঞ্চলের ও এর বাইরের সংসদকে এসডিজি-৩ এ বর্ণিত সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করতে তাদের আরও তৎপর হতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তামাক নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত কনভেনশন এফসিটিসির বাস্তবায়ন বিশেষভাবে দুটি সুনির্দিষ্ট কারণে অপরিহার্য। প্রথমত, এফসিটিসি ছাড়া এসডিজির তৃতীয় উদ্দেশ্য সুস্থ জীবনযাপন এবং সব বয়সের মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তামাক একটি বড় বাধা। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে বলেন, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল করতে চাই। এই ইস্পিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমরা যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করছি সেগুলো হচ্ছে, প্রথম পদক্ষেপ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবহার করে একটি তহবিল গঠন করাÑ যা দিয়ে দেশব্যাপী জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী গ্রহণ করা যায়। দ্বিতীয় ধাপে আমরা তামাকের ওপর বর্তমান শুল্ক কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী শুল্ক নীতি গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেব। সর্বোপরি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করব। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর নড়েচড়ে বসেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গতানুগতিক তামাকের কর পদ্ধতি ভাঙতে ইতোমধ্যেই তৎপর হয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে দেয়া এক মতামতে তিনি উল্লেখ করেছেন সিগারেটে মূল্য স্তর তুলে দিন। দরকার হলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) সঙ্গে আলোচনা করুন। সনাতনী ধারণা বাদ দিতে হবে। মূল্য স্তর তুলে দেয়ার চিন্তাভাবনা বিষয়ে আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসকে. বশির উদ্দিন সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে জনকণ্ঠকে বলেন, এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে সিগারেট একটি কাঠামোগত শিল্প। হঠাৎ করেই মূল্য স্তর তুলে দেয়া ঠিক হবে না বরং এ বিষয়ে আরও ভালভাবে চিন্তা করে প্রয়োজনে গবেষণা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা এবং অর্থমন্ত্রীর শুভ উদ্যোগকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটকে প্রভাবিত করতে মাঠে নেমেছে তামাক কোম্পানিগুলো। কখনও এককভাবে আবার কখনও এ্যাসোসিয়েশনের নামে চলছে এ অপৎপরতা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (্এনবিআর) একাধিক সূত্র জানায়, প্রত্যেক অর্থবছরে বাজেটে সিগারেটের ওপর করারোপের ধরন কেমন হতে পারে তা জানতে প্রাক বাজেট আলোচনায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি রাজস্ব বোর্ডে লিখিত প্রস্তাব পাঠায় কয়েকটি সিগারেট কোম্পানি। এর মধ্যে একটি বহুজাতিক কোম্পানির প্রস্তাবকে অগ্রাধিকার দিয়ে সিগারেটের কর পদক্ষেপগুলো প্রণয়ন করে থাকে এনবিআর। তবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী এফসিটিসির আলোকে তামাকের ওপর করাারোপ করা হবে বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান। তিনি বলেন, বর্তমানে রাজস্ব আদায়ের তুলনায় হেল্থ কস্ট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই সকল মানুষের কথা চিন্তা করে এসডিজি বাস্তবায়নের স্বার্থে তামাক কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষিত হয় এ রকম কোন কাজ করা হবে না। সূত্র জানায়, ইতোমধ্যেই শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর সঙ্গে গত ২৯ মার্চ শিল্পমন্ত্রীর সম্মেলন কক্ষে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর একটি প্রতিনিধি দলের বৈঠক করার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে অজ্ঞাত কারণে সেটি আর হয়নি। তাছাড়া বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে গত ৪ এপ্রিল এবং ১৩ এপ্রিল অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর একটি প্রতিনিধি দল। শিল্প ও অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে শিল্পমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বিএটির বৈঠক অস্বাভাবিক না হলেও তা হবে এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩-এর নির্দেশনা অনুসরণ করে অর্থাৎ প্রকাশ্যে স্বচ্ছতার সঙ্গে গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে। সেটি না হওয়ায় বাজেটে হস্তক্ষেপের শঙ্কা প্রকাশ করেছে তামাকবিরোধী সংগঠনের নেতারা। এ বিষয়ে প্রগতির জন্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জোবায়ের জনকণ্ঠকে বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হচ্ছে উচ্চহারে করারোপ করা। সরকার, অর্থ মন্ত্রালয় ও এনবিআর যদি কর বাড়াতে চায় তখন তামাক কোম্পানিগুলো মরিয়া হয়ে ওঠে। টেকসই উন্নয়ন করতে চাইলে এফসিটিসি বাস্তবায়ন করতেই হবে। কেননা তামাক শুধু এসডিজির ৩নং গোলই নয়, সমস্ত লক্ষ্যকেই বাধাগ্রস্ত করতে পারে। প্রজ্ঞা প্রকাশিত জনস্বাস্থ্য সবার উপরে বাংলাদেশের তামাক মহামারী রুখতে তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন শীর্ষক এক গবেষণা বইতে বলা হয়েছে, বহুজাতিক কোম্পানি হিসেবে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ টিকিয়ে রাখার জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করতে একই ধরনের কৌশল অব্যাহতভাবে ব্যবহার করে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও তামাক কোম্পানির থাবা থেকে মুক্ত নয়। দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মকা-কে প্রভাবিত করে আসছে। আর এই প্রভাবিত করার উপায় হিসেবে তারা নানামুখী কৌশল অবলম্বন করে। যার মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের একত্রিকরণ, লবিং, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ, গবেষণায় অর্থায়ন ও বৈজ্ঞানিক পরামর্শক নিয়োগ, তথ্য বিকৃত করা, স্বার্থ হাসিলের জন্য বিভ্রান্তিমূলক ফ্রন্ট গ্রুপ তৈরি ও ব্যবহার, এনজিও ও এ্যাডভোকেসিতে জড়িতদের অর্থায়ন, মামলা-মোকদ্দমা, হুমকি প্রদান, জনসেবা ও কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচী, জনসংযোগ, চোরাচালান এবং আইনের ধারা অমান্য বা ভঙ্গ করা ও আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগানো। বলা হয়েছে বাংলাদেশে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ মূলত : নীতিকেন্দ্রিক, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তামাক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক আইন সংশোধনী ও করনীতি প্রণয়নকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে।
×