ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির ৪ কর্মকর্তা ফেঁসে যাচ্ছেন

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৪ মে ২০১৬

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির ৪ কর্মকর্তা ফেঁসে যাচ্ছেন

বিভাষ বাড়ৈ ॥ দশ লাখ টাকা ঘুষ দাবির ঘটনায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের লিখিত অভিযোগে ফেঁসেই যাচ্ছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অভিযুক্ত কর্মকর্তারা। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নির্দেশে মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তাকে ‘আপাতত কাজ থেকে বিরত’ রাখার পর এক অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। ইতোমধ্যেই কমিটি কাজও শুরু করেছে। দুর্নীতির প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসাইন বলেছেন, দুর্নীতি করতে চাইলে বদলি হয়ে যান। এদিকে মঙ্গলবার ইউজিসির অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, রবিবার বিদেশ সফরে যাওয়ার আগে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বলে গেছেন ‘ঘটনা সত্য হলে আমি এসে দুর্নীতিবাজ কাউকে এখানে (মন্ত্রণালয়) দেখতে চাই না’। শিক্ষা সচিব মোঃ সোহরাব হোসাইনকে মন্ত্রী দ্রুত এ্যাকশন নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসাইন। মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ওই বৈঠকে হুঁশিয়ারি দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে শিক্ষা সচিব বলেন, দুর্নীতি করতে চাইলে বদলি হয়ে যান। এখানে সামান্যতম অনিয়ম, অনাচার ও দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। অধিদফতর, শিক্ষা বোর্ড, প্রকল্প অফিস, দফতর, সংস্থাসহ মাঠ পর্যায়ের অফিসে কোন রকম দুর্নীতির প্রমাণ পেলে সাসপেন্ড করে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিয়ম ও সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে, ব্যত্যয় হলে কঠোর ব্যবস্থা। শিক্ষা সচিব বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, বিষয় খোলা, এমপিওভুক্তি, প্রকল্প অনুমোদন, নিয়োগ, বদলি প্রভৃতি কাজ সরকারী নিয়মে হয়। কোন কাজে টাকা লাগে না এই বার্তা সবাইকে পৌঁছে দিতে হবে। দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করা হবে বলে মন্তব্য করে সচিব আরও বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রতারক চক্রের অর্থ দাবির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে সচিব বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারও বিরুদ্ধে প্রতারক চক্রের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন কাজের ‘ছুতোয়’ কেউ অর্থ দাবি করলে তাকে থানায় সোপর্দ করারও অনুরোধ জানিয়েছেন শিক্ষা সচিব। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সচিবালয় গেট, বিভিন্ন দফতর-অধিদফতরসহ অন্য অফিসে একটি করে অভিযোগ বাক্স স্থাপনেরও নির্দেশ দিয়েছেন সচিব সোহরাব হোসাইন। জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগের যুগ্ম প্রধান স্বপন কুমার ঘোষ ও উপ-প্রধান ওমর মোঃ ইমরুল মহসিন ‘মধ্যবর্তী মূল্যায়নের জন্য সম্মানী হিসেবে’ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন বলে উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ ফায়েকুজ্জামান অভিযোগ করেন। ‘ঘুষ’ দাবির অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষামন্ত্রী ও সচিবকে প্রথমে মোবাইল ফোনে, পরে লিখিতভাবে এ অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফায়েকুজ্জামান। মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত দুই কর্মকর্তাকে কাজ থেকে ‘আপাতত বিরত’ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি অভিযোগ তদন্তে একজন অতিরিক্ত সচিবকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উপাচার্য অভিযোগ করেছেন তাদের দু’জন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগের, দু’জন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পরিকল্পনা শাখার। ইউজিসির অভিযুক্তরা হলেন, নাসিমা রহমান ও আতাউর রহমান। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অনুবিভাগের একজন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একজন এবং বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের (আইএমইডি) একজন আছেন এ তালিকায়। শিক্ষা সচিব মোঃ সোহরাব হোসাইন বলেছেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির একটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার বিশ্বাস অভিযোগ তদন্ত করে যত দ্রুত সম্ভব প্রতিবেদন দেবেন। তিনি বলেন, প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে দুই কর্মকর্তাকে তাদের নিজ মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হবে। বাকিদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানা গেছে, ৮৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। জুনে সমাপ্ত হওয়ার কথা প্রকল্পটি। এর অধীনে একটি চার তলা একাডেমিক ভবন, একটি চার তলা ছাত্র হল, একটি ছয় তলা ফাউন্ডেশনের ছাত্রী হলের চার তলার একাংশ, আরেকটি ছাত্রী হলের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার সম্প্রসারণ, অতিথি ভবন কাম ক্লাবের একাংশ, প্রশাসনিক ভবনের তিন তলার একাংশ, সেন্ট্রাল সায়েন্স ল্যাবের তিন তলার একাংশ এবং শারীরিক শিক্ষা বিভাগের একটি অংশ নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রথমে প্রকল্পের বাজেট ছিল ৮০ কোটি ১০ লাখ টাকা। যা পরে সংশোধন করে ৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা বাড়ানো হয়। প্রকল্পের বিবিধ খরচ প্রথমে ৫৫ লাখ থাকলেও পরে তা বাড়িয়ে ৭০ লাখ টাকা করা হয়। অভিযুক্ত এসব কর্মকর্তা শুক্রবার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ভবন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনে যান। তখন তারা অর্থ দাবি করেন এবং অর্থ না দিলে প্রকল্পের বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিবেদন তৈরি, এ খাতে বরাদ্দ ১৬ কোটি টাকা ছাড় না করা এবং ভবিষ্যতে আর কোন প্রকল্প না দেয়ার হুমকি দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিষয়টি ওইদিনই মোবাইল ফোনে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবকে জানান। এর পরই তোলপাড় শুরু হয়। উপাচার্য বলেন, প্রকল্পের দুই মাস বাকি থাকতে মধ্যবর্তী মূল্যায়ন হওয়াটা স্বাভাবিক বিষয় নয়। সম্মানী বাবদ যে ১০ লাখ টাকা ধরা হয়েছে সে ধরনের কোন অভিজ্ঞতা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। স্বপন বাবুর সঙ্গে শুক্রবার আমার আলোচনা হয়েছে যে, বিষয়টি নিয়ে সচিব মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলে টাকা দেয়ার ব্যবস্থা নেব। সচিব মহোদয়ের নির্দেশনা মোতাবেক এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। তাদের দাবি অনুযায়ী ১০ লাখ টাকা দেবেন কি না সে বিষয় নির্দেশনা চেয়ে শিক্ষা সচিবকে চিঠিও পাঠাবেন বলে জানান ফায়েকুজ্জামান। ওই কর্মকর্তারা শিক্ষামন্ত্রী ও সচিবকে না জানিয়ে প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাবে (আরডিপিপি) মধ্যবর্তী মূল্যায়ন বাবদ বিবিধ খরচ থেকে ১০ লাখ টাকা সম্মানী হিসেবে দেয়ার বিষয়টি কৌশলে যুক্ত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা উন্নয়ন দফতরের পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল মান্নানকে ফোন করে তারা ১০ লাখ টাকা ‘রেডি’ রাখতেও বলেন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে জানান, এই টাকা না দিলে প্রকল্পের শেষ কিস্তির ১৬ কোটি টাকা ছাড় করবেন না। এছাড়া সামনে অন্য প্রকল্পও আটকে দেবেন। স্বপন কুমার ঘোষ আরডিপিপিতে সম্মানী নেয়ার বিধান যুক্ত করার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, এটা আমরাই লিখেছিলাম। কারণ ৫০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট করতে হবে। কমিটির লোকের জন্য এই সম্মানীটা রাখা ছিল। ছয় বছর মেয়াদী প্রকল্প শেষ হওয়ার দুই মাস আগে মধ্যবর্তী মূল্যায়ন যৌক্তিক কি না জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর দিতে রাজি হননি। সম্মানী চাওয়ার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে আরেক কর্মকর্তা ইমরুল বলেন, মিডটার্ম ইভালুয়েশন অন্য মিটিংয়ের মতো মিটিং না, এটা রিপোর্ট বেইজড। এই রিপোর্ট প্রণয়ন করতে ৭-১০ দিন সময় লাগবে। সেই কারণে এটার অনারিয়াম হিসেবে রাখা হয়েছিল। এদিকে দশ লাখ টাকা ঘুষ দাবি সংক্রান্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. নাসিমা রহমান ও একই বিভাগে সিনিয়র সহকারী পরিচালক মোঃ আতোয়ার রহমানকে পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে মঙ্গলবার। একই সঙ্গে অভিযোগের বিষয় খতিয়ে দেখতে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতার হোসেনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্য হলেনÑ ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউসুফ আলী মোল্লা। কমিটির সদস্য-সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন রিসার্চ সাপোর্ট এ্যান্ড পাবলিকেশন ডিভিশনের পরিচালক মোঃ সামছুল আলম। কমিটিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
×