ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিলেটে চার জেলায় বোরো ঘরে তুলতে পারেনি কৃষক

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৪ মে ২০১৬

সিলেটে চার জেলায় বোরো ঘরে তুলতে পারেনি কৃষক

কাওসার রহমান ॥ এবার পাহাড়ী ঢলে তলিয়ে গেছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কৃষকের স্বপ্ন। বাম্পার বোরোর ফলনও ঠিকমতো ঘরে তুলতে পারেনি। গত ৬ এপ্রিল থেকে সিলেটের চার জেলায় শিলাবৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে হাওড় রক্ষা বাঁধ ভেঙে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এক লাখ ৫২ হাজার কৃষক। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ভাটিবাংলা খ্যাত সুনামগঞ্জ অঞ্চলের কৃষক। তাদের এ মুহূর্তে সরকার থেকে প্রণোদনা দেয়া না হলেও আগামী খরিফ মৌসুমে এসব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে প্রণোদনার আওতায় আনা হবে বলে জানা গেছে। শুধু দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই নয়, এপ্রিলের প্রথমার্ধের শিলাবৃষ্টিতে সারাদেশেই উঠতি বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিলেট ও ঢাকা বিভাগেরও উঠতি বোরো ধান শিলাবৃষ্টি ও বন্যার পানিতে তালিয়ে গেছে। ফলে পুরো ধান ঘরে তুলতে পারেনি কৃষক। আধাপাকা ধান কেটে ঘরে তুলতে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। ফলে বাম্পার ফলন হলেও দেশের সবচেয়ে বড় ফসল বোরোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলেও বোরো নিয়ে কৃষকের স্বপ্ন দুলছে কালবৈশাখীর দোলায়। এই দুই অঞ্চলও আধাপাকা সোনালি ধানে ভরে গেছে। চিরসবুজের বুকে এ যেন প্রকৃতির সোনালি রঙের আলপনা। কিন্তু আবহাওয়ার বিরূপ আচরণে কৃষকের বুক দুরুদুরু করছে। শিলাবৃষ্টি ও কালবৈশাখীর আশঙ্কা কৃষকের মনে সংশয় সৃষ্টি করেছে। বড় ধরনের একটি কালবৈশাখীই কৃষকের স্বপ্ন ভেঙে তছনছ করে দিতে পারে। তাই অনেক কৃষক আধাপাকা বোরো ধানই কোমর বেঁধে কাটতে নেমে পড়েছেন। তবে ধান কাটতে গিয়ে শ্রমিক সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। কৃষি শ্রমিকের মজুরিও অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা হলো বাড়তি মজুরি দিয়েও কৃষিশ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এবার (২০১৫-১৬ অর্থবছর) ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে এক কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন বোরো ফসলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে আবাদ হয়েছে ৪৬ দশমিক ৮৫ লাখ হেক্টর জমিতে। মূলত ধানের দাম না পাওয়ায় কৃষক অন্য ফসলে চলে গেছে। এজন্য এবার বোরো আবাদ কমে গেছে। প্রায় এক লাখ ৫৫ হাজার হেক্টর হ্রাস পেয়েছে বোরো আবাদ। তা সত্ত্বেও কৃষি কর্মকর্তারা বোরোর বাম্পার ফলন নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু সেই আশাবাদে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অকালবন্যা ও শিলাবৃষ্টি। অবশ্য এ মাসের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ পূর্বাভাস দিয়েছে, বাংলাদেশে এক কোটি ৮৬ লাখ টন বোরো উৎপাদিত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বোরো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের পূর্বাভাসই সঠিক হতে যাচ্ছে। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার হাকালুকির পাড়ের কৃষক ছনর আলী এবার ১২ কেদার (৩ একর ৪ শতক) জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছিলেন। ফলনও ভাল হয়েছিল। কিন্তু পাহাড়ী ঢলে ৮ কেদার (২ একর ৪০ শতক) ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে তাড়াহুড়ো করে ৪ কেদার (১ একর ২০ শতক) জমির ধান কেটে ঘরে তুলতে পেরেছেন। তিনি বলেন, তার মতো আরও অসংখ্য কৃষকের মাথায় হাত উঠেছে পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট আগাম বন্যায়। অনেকের বোরো ফসল এখন পানির নিচে। আর তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক কৃষক কাঁচা ধান কেটে ঘরে তুলছেন। এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ১২ কেদার (৩৬০ শতক) জমিতে বোরো করেছিলেন হাকালুকি পারের আরেক কৃষক এমরান হোসেন। কিন্তু অকালবন্যায় তলিয়ে গেছে তার আট কেদারের (২৪০ শতক) ফসলি জমি। কোনমতে চার কেদারের (১২০ শতক) ধান তুলতে পেরেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতি এক কেদার (৩২ শতক) জমিতে ধান মিলে আট হাজার টাকার। এর বিপরীতে প্রতি কেদারে খরচ হয় প্রায় ছয় হাজার টাকা। আর পরিশ্রম তো আছেই। তিনি জানান, এক কেদার হালচাষ এক হাজার, সার ও বীজ আরও এক হাজার, পানি সেচ এক হাজার, ধানের চারা রোপণ আট শ’ ও ধান কাটানো চারজন শ্রমিকের রোজ এক হাজার ছয় শ’ টাকা ব্যয় করতে হয়। আর ধান মাড়াইয়ের খরচ তো আছেই। তবে, এমরান হোসেন খেত করে কিছু ধান পেলেও চার কেদার করে ধানে কাস্তে লাগাতে পারেননি হাকালুকিপারের বাজারঘাটের বাসিন্দা শামীম আহমদ। চৈত্রে পাহাড়ী ঢলে ক্রমশ পানিতে ডুবছে কৃষকের স্বপ্নের বোরো ফসল। কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড়ী ঢলের কারণে হাওড়াঞ্চলের পানি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এতে তলিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার হেক্টর ধানিজমি। ফলে কৃষক বাড়তি মজুরি দিয়ে শ্রমিককে কাজে লাগাচ্ছেন। তবে অনেকে সময়মতো শ্রমিক না পেয়ে পড়েছেন বিপাকে। কেউবা নৌকার অভাবে কাটা ধান, পারাপার করতে পারছেন না। ফলে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন কৃষক। সিলেটের পারাইরচক হাওড়ের আব্দুল মালিক বলেন, জমিতে আধাপাকা ধান। এরই মধ্যে প্রবল বর্ষণে ধানিজমি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকদের দ্বিগুণ টাকা দিয়ে কাজে আনতে হচ্ছে। উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি এবং বর্ষণজনিত কারণে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার হাইজদিয়া বাঁধের কিছু অংশ ভেঙ্গে যাওয়ায় হাওড় এলাকার কয়েক শ’ হেক্টর জমির আধাপাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিবছরের মতো এবারও সুনামগঞ্জ জেলার ৪২টি হাওড়ের ফসল রক্ষার জন্য হাওড় রক্ষাবাঁধ নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করে। ২০৯ কিমি বাঁধের কাজ হয়, ব্যয় হয় ৩২ কোটি টাকা। কিন্তু ধান কাটার আগ মুহূূর্তে ধর্মপাশা, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, দিরাই জগন্নাথপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে, কোন কোন স্থানে বাঁধ উপচে হাওড়ে পানি প্রবেশ করে। এতে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। হাওড়ে পানি প্রবেশ করার মুহূর্তে প্রশাসন দ্রুত কৃষকদের ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য মাইকিং করে। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার দরুন এবং ধান কাটার শ্রমিকের অভাবে কৃষক ধান ঘরে তুলতে পারেনি। অবশ্য কোন কোন স্থানে ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টার’ ও ‘রিপার’ দিয়ে কৃষি বিভাগ ধান কেটে তুলতে কৃষককে সহায়তা করে। ইতোমধ্যে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান সুনামগঞ্জ জেলার পানিতে তলিয়ে যাওয়া কয়েকটি হাওড় এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি কৃষকদের অবশিষ্ট ধান কেটে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষকের পাশে আছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, এবার বিভাগের চার জেলায় ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৭০৬ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। এর মধ্যে সিলেটে ৭৯ হাজার ৫৪৫ হেক্টর, মৌলভীবাজারে ৫২ হাজার ৩৩৬ হেক্টর, হবিগঞ্জে ১ লাখ ১৩ হাজার ২০ হেক্টর ও সুনামগঞ্জে ২ লাখ ২০ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমি রয়েছে। এরমধ্যে অকালবন্যা আর শিলাবৃষ্টিতে এ বিভাগের ৫০ হাজার ১২ হেক্টর ধানিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এক লাখ ৫২ হাজার ৩২৭ কৃষক। জানা যায়, সরকার তাৎক্ষণিক ক্ষতিগ্রস্তদের কোন ক্ষতিপূরণ না দিলেও আগামী খরিফ মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে প্রণোদনার আওতায় আনা হবে। এ প্রসঙ্গে সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষ্ণ চন্দ্র হুড় জানান, অকালবন্যায় যেসব জমি সম্পূর্ণরূপে পানির নিচে তলিয়ে গেছে বা শিলাবৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত, কেবল সেসব কৃষককে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সিলেটে বিভাগের সাত লক্ষাধিক কৃষকের মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এমন কৃষকের সংখ্যা এক লাখ ৫২ হাজার তিন শ’ ২৭ জন। এরমধ্যে সিলেটে ৫৬ হাজার ৯১৫, মৌলভীবাজারে দুই হাজার ৫৮০, হবিগঞ্জে ২০ হাজার ৫৭০ ও সুনামগঞ্জে ৭২ হাজার ২৬২ জন। আর পানিতে তলিয়ে যাওয়া ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত জমি ৫০ হাজার ১২ হেক্টরের মধ্যে সিলেটে নয় হাজার ৯৫৪, মৌলভীবাজারে ৬১৪, হবিগঞ্জে দুই হাজার ১৭ এবং সুনামগঞ্জে ৩৭ হাজার ৪৩৬ হেক্টর।
×