ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিজামীর রিভিউ শুনানি শেষ, রায় আগামীকাল

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৪ মে ২০১৬

নিজামীর রিভিউ শুনানি শেষ, রায় আগামীকাল

স্টাফ রিপোর্টার॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদ- প্রাপ্ত বদর বাহিনীর প্রধান, জামায়াতে ইসলামীর আমির, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে মৃত্যুদ- প্রাপ্ত আসামি মতিউর রহমান নিজামীর দ- থেকে খালাস চেয়ে (পুনর্বিবেচনার) রিভিউ আবেদনের ওপর উভয়পক্ষের শুনানি শেষ হয়েছে। বিচারের সর্বশেষ ধাপে শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য কাল ৫ মে বৃহস্পতিবার দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ মঙ্গলবার সকাল ৯টা ২১ মিনিট থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা রিভিউ শুনানির পর এ আদেশ প্রদান করেছে। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। জামায়াতে ইসলামীর আমির নিজামীর পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনিই প্রথম যুক্তি দেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার যুক্তি উপস্থাপন করেন। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিষয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছেন, একাত্তরের যুদ্ধের সময় মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমর্থক ছিল। হিটলারের যুদ্ধের সময় একজন রেজিস্ট্রারের নাম পাওয়ায় তাকেও মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিল, তাহলে তাকে (নিজামী) নয় কেন? মঙ্গলবার সকালে মতিউর রহমান নিজামীর দ- থেকে খালাস চেয়ে করা রিভিউ আবেদনের শুনানি চলাকালে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, বিচারে অভিযুক্তের মানবাধিকার যাতে ক্ষুন্ন না হয় এবং অভিযুক্ত যাতে আইনী অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সে বিষয় নিশ্চিত করা হবে। এর আগে রিভিউ শুনানিতে নিজামীর পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী আল বদরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না, তিনি ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন এবং পাকিস্তানকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করতেন। মূলত আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই বিচারপতি কথাগুলো বলেন। তিনি আরও বলেন, এ বিচার প্রক্রিয়া সারাবিশ্ব দেখছে। সকল হিউম্যান রাইটস (মানবতা) সংরক্ষণ করেই এ বিচার প্রক্রিয়া চলছে। একাত্তর সালে যদি রাজাকাররা পাক সেনাদের সহযোগিতা না করত তাহলে এক/ দুই মাসের বেশি টিকত না। এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- বহাল চেয়েছেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। অপরদিকে নিজামীর পক্ষে ন্যায়বিচার আশা করেছেন তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। সর্বোচ্চ আদালতে শুনানি করেন আসামিপক্ষে নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এ্যাটর্নি জেনারেলের নিজ কার্যালয়ে বলেন ‘শুনানিতে আসামিপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যে সমস্ত সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাকে (নিজামী) দ- দেয়া হয়েছে, তাদেরকে বিশ্বাস করা যায় না। এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়েও তাকে অভিযুক্ত করা যায় না’। ‘রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলেছি- তার যে বক্তব্য প্ররোচণামূলক বক্তব্য এবং এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তার আলবদরের ওপর প্রকাশিত লেখা, ১৯৭১ সালে যেটা প্রকাশিত হয়েছিল যার পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। তাছাড়া যারা সাক্ষী তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যখন একজন ডাক্তারকে ধরে নেয়া হয়, তার স্ত্রীকে তখন আলবদররা বলেছিলেন, মতিউর রহমান নিজামীর নির্দেশে তারা তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। এ সমস্ত বিষয় বিবেচনা করে তাকে আপীল বিভাগ মৃত্যুদ-ের রায় দিয়েছিলেন’। ফাঁসির রায় বহাল থাকবে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি তো আশাবাদী’। আসামিপক্ষ কোন কোন অভিযোগ থেকে খালাস চেয়েছিলেন- এ প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, তারা যাবজ্জীবন নিয়ে কোন বক্তব্য রাখেননি। তাদের সাবমিশনে যা বুঝলাম, মৃত্যুদ- থেকে অব্যাহতি চান’। মাহবুবে আলম বলেন, যা রায় (মৃত্য্যুদ-ের রায়) হয়েছে সঠিক রায় হয়েছে। এটার পুনর্বিবেচনার কোন প্রয়োজন নেই এবং কোন অবকাশ নেই। তাছাড়া পুনর্বিবেচনা যে প্রয়োজন এ মর্মে কোন যুক্তি তারা উপস্থাপন করতে পারেননি। তাই আমি মৃত্যুদ- বহাল চেয়েছি। অন্যদিকে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, তিনটি অভিযোগের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছি। যে তিনটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। আমরা বলেছি যে, তিনটি অভিযোগের পক্ষে যে সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রসিকিউশন থেকে দেয়া হয়েছে তা অত্যন্ত দুর্বল। এবং এ সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর কাউকে মৃৃত্য্যুদ- দেয়া যায় না। বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী ডাঃ আলীম ও আজহারের স্ত্রীর যে বক্তব্য (নিজামীর নির্দেশে ধরে নেয়া) এ কথাটি দীর্ঘ ৪০ বছরে বলেননি তারা। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তাকেও বলেননি। হঠাৎ করে শেখানো কথা বলা হয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে চরম দ- দেয়া যায় না। কি আশা করেন এমন প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, আমরা আশা করছি ন্যায়বিচার। সর্বোচ্চ আদালত যে বিচার করবে, সেটাই ন্যায়বিচার। তারপর ভবিষ্যত প্রজন্ম ও ইতিহাস বিচার করবে, এ বিচার সঠিক ছিল কিনা। কড়া নিরাপত্তা ॥ জামায়াতের এই শীর্ষ নেতার রিভিউ শুনানি ও ট্রাইব্যুনালে কিশোরগঞ্জের পাঁচ আসামির যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়ের দিন থাকায় সকাল থেকেই সুপ্রীমকোর্টের সব প্রবেশ পথে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা। ঢোকার সময় সবার পরিচয়পত্র দেখা হয়। সন্দেহ হলে করা হয় তল্লাশি। পরবর্তী পদক্ষেপ ॥ মৃত্যুদ- বহালের রায়ের পর যুদ্ধাপরাধী নিজামীর শেষ আইনী সুযোগ এই রিভিউ আবেদন। এ আবেদনে রায়ের কোন পরিবর্তন না হলে তার সামনে কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ থাকবে। এর আগে যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লা ও মোঃ কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন একদিনের মধ্যে শুনানি শেষে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা চাননি বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এরপর যুদ্ধাপরাধের দায়ে গত বছর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। তারা প্রাণভিক্ষার আবেদন করলেও রাষ্ট্রপতি তা নাকচ করে দেন বলে সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। নিয়ম অনুযায়ী, রিভিউ নিষ্পত্তির আগে দ- কার্যকর করা যাবে না। রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে সেই রায়ের অনুলিপি কারাগারে যাবে এবং কারাকর্তৃপক্ষ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করবে। বিচার পরিক্রমা ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাবনায় হত্যা, ধর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। চলতি বছর ৬ জানুয়ারি আপীল আংশিক মঞ্জুর করে সেই ফাঁসির রায়ই বহাল রাখে সর্বোচ্চ আদালত। ১৫ মার্চ সুপ্রীমকোর্ট সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করলে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে, পরদিন তা পড়ে শোনানো হয় যুদ্ধাপরাধী নিজামীকে। এরপর ২৯ মার্চ আপীলের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেন একাত্তরের বদরপ্রধান নিজামী। রিভিউ আবেদন ॥ গত ২৯ মার্চ সুপ্রীমকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় তার আইনজীবীরা রিভিউ আবেদন করেন। ৭০ পৃষ্ঠার মূল রিভিউ আবেদনের সঙ্গে মোট ২২৯ পৃষ্ঠার নথিপত্রে দ- থেকে খালাস চেয়ে ৪৬ টি যুক্তি (গ্রাউন্ড) তুলে ধরা হয়েছে। রিভিউ আবেদনে এ্যাডভোকেট অন রেকর্ড হলেন জয়নুল আবেদীন তুহিন। রিভিউ আবেদন করার পরের দিন ৩০ মার্চ তা দ্রুত শুনানির জন্য আবেদন জানায় রাষ্ট্রপক্ষ। ওই দিনই এ আবেদনের শুনানি নিয়ে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন মির্জা হোসেইন হায়দারের আদালত। নিয়ম অনুযায়ী, রিভিউ নিষ্পত্তির আগে তার দ- কার্যকর করা যাবে না। আর রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে সেই রায়ের অনুলিপি কারাগারে যাবে এবং কারাকর্তৃপক্ষ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আসামির ফাঁসি কার্যকর করবে। আপীল বিভাগের রায় ॥ এর আগে গত ১৫ মার্চ নিজামীর আপীলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। গত ৬ জানুয়ারি বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনাকারী ও উস্কানিদাতাসহ মানবতাবিরোধী তিন অপরাধের দায়ে নিজামীর মৃত্যুদ-ের রায় বহাল রাখে আপীল বিভাগ। ওই দিন সংক্ষিপ্ত রায় দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে)সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপীল বেঞ্চ। অন্য বিচারপতিরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এর আগে বুদ্ধিজীবী নিধনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে মৃত্যুদ- দেয় ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল যে অভিযোগে মৃত্যুদ- প্রদান করে ॥ ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রসিকিউশনের আনা ১৬ অভিযোগের মধ্যে আটটিতে নিজামীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর ঘটনায় নিজামীর ফাঁসির রায় আসে। আর অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে নিজামীকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদ-। আপীলে যে অভিযোগে মৃত্যুদ- প্রদান ॥ আপীলের রায়ে বলা হয়, যে আট অভিযোগে তিনি( নিজামী) ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন তার মধ্যে ১, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে তিনি খালাস পেয়েছেন। আর ২, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে তার দ- বহাল রয়েছে। এর মধ্যে ২, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ।
×