ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

হ্যামলেট কিংবা হায়দার ॥ সমস্যা চিনতে পারাই আসল

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৪ মে ২০১৬

হ্যামলেট কিংবা হায়দার ॥ সমস্যা চিনতে পারাই আসল

মূল থিম শেক্সপীয়রের বিখ্যাত ট্র্যাজেডি ‘হ্যামলেট’। এরকম ক্লাসিক একটি নাটককে ভিত্তি করে সমসাময়িক রাজনৈতিক সমস্যাকে এত গভীর থেকে তুলে আনা যায়, বিশাল ভরদ্বাজের ‘হায়দার’ চলচ্চিত্রটি না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না। উনিশ শ পঁচানব্বই সালে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ইনসার্জেন্সির পটভূমিতে হিলাল মীর নামে এক চিকিৎসক, তার স্ত্রী, পুত্র এবং ভাইকে যথাক্রমে ডেনমার্কের রাজা, রাণী, রাজপুত্র হ্যামলেট এবং রাজার ভাই ক্লাউডিয়াসের চরিত্রে কল্পনা করে কাহিনীর শুরু, বিস্তার এবং শেষ। ‘হ্যামলেট’ যাদের দেখা বা পড়া নেই তাদেরও ‘হায়দার’ দেখতে অসুবিধা হয় না। কারণ কাশ্মীরের ঐ সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ঘাত-প্রতিঘাত তাদের টেনে নেয়। কাশ্মীরের রাজনৈতিক সমস্যার পটভূমিতে নির্মিত এ চলচ্চিত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনী, জঙ্গী রাজনীতি এবং এ দুয়ের সমন্বয়ে সাধারণ মানুষের জীবনের বিপর্যয় যেভাবে শৈল্পিক নৈপুণ্যে উঠে এসেছে তা সত্যিই অভিনব। কাশ্মীরের মতো দ্বন্দ্ব সংক্ষুব্ধ রাজনৈতিক প্রতিবেশকে হ্যামলেটের ট্র্যাজিক আবহের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে একই সঙ্গে রাজনৈতিক বক্তব্য নির্ভর ও শিল্পোত্তীর্ণ চলচ্চিত্রের স্বাদ দিয়েছেন ভরদ্বাজ। নির্মাণ শৈলীও অসাধারণ। রাজনীতি, সমাজ ও জীবনকে সূক্ষ্মভাবে দেখার, বোঝার ও উপলব্ধি করার ক্ষমতা থেকেই এ ধরনের সৎ ও সাহসী শিল্পকর্ম নির্মাণ সম্ভব। আদর্শের নামে স্বার্থের রাজনীতির কাছে মাথা বিক্রি করে সৃজনশীল কাজ করা যায় না। সমাজ যখন সঙ্কটে পড়ে, রাজনীতির গতি হয় রুদ্ধ। মানুষের হয়ে কথা বলেন তখন শিল্পী সাহিত্যিক চলচ্চিত্রকাররা- যার যার নিজস্ব মাধ্যমে। পলিটিক্যাল থিয়েটার বা রাজনৈতিক নাটকের উদ্ভবই হয়েছিল বিশ্ব রাজনীতির সঙ্কটময় এক সময়ে। জার্মান নাট্যকার এরভিন পিসকাটর নাটকের জগতে নতুন এক ধারা সৃষ্টি করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে জার্মানির তখন দেউলে হওয়ার দশা। সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা সঙ্কট যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জনজীবনকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। পরাজিত রাষ্ট্র হিসেবে ক্ষতিপূরণের টাকা গুনতে গুনতে নিঃস্ব জার্মানি। জনগণের দুঃসহ অবস্থা পিসকাটরকে প্রতিবাদী নাট্যকারে পরিণত করেছিল। তাঁর সময়ে আরেক নাট্যকারও রাজনৈতিক বক্তব্য প্রধান নাটকের জন্য বিশ্বখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি বেট্রোল্ট ব্রেশ্ট। নাটকের মধ্য দিয়ে জনগণের কথা বলেছেন তাঁরা। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টির পথিকৃৎ আমেরিকান চলচ্চিত্রকার ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ। রাষ্ট্র ও সমাজের আরেক সঙ্কট কালকে ধরেছেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘বার্থ অব এ নেশন’ চলচ্চিত্রে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে দু’জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার এ্যাডভেঞ্চারকে কেন্দ্র করে কাহিনী আবর্তিত হলেও চলচ্চিত্রকারের দৃষ্টিতে ওই সময়ের সামাজিক রাজনৈতিক সঙ্কটই আসলে এ চলচ্চিত্রের মূল উপজীব্য। চলচ্চিত্র বিস্তৃত ক্যানভাসে জীবনের বহুমাত্রিকতাকে ধরতে পারে। যদি পেছনে থাকে সৃজনশীল চলচ্চিত্রকারের শৈল্পিক ও অনুসদ্ধানী চোখ। কাহিনী নির্মাণের অসংখ্য উপাদান ছড়িয়ে আছে আমাদের দেশে। আমাদের চারপাশে। কিন্তু এ নিয়ে কাজ হয় না প্রায় কোনো মাধ্যমেই। পুরোটাই কি সৃজনশীলতার অভাব? নিশ্চয়ই নয়। এদেশের শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের বড় এক অংশ সুবিধাবাদী রাজনীতির স্রোতে এমন ভাবে গা ভাসিয়েছেন যে তাদের পক্ষে দলীয় ধ্বজা তুলে ধরা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব নয়। তরুণদের অনেকের মধ্যেও এ প্রবণতা প্রকট। যে যেই দলের অনুগত সে দলের সুপ্রীম পাওয়ার কে খুশি রাখতেই তাদের প্রতিভা খরচ হয়। এতে অল্প পরিশ্রমে বেশি লাভ। নগদ অর্থসহ আরাম আয়েশের জীবনযাপনের নিশ্চয়তা জোটে। কঠিন কোনো প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় না। আরাম আয়েশের জীবন সহজেই অর্জন করা যায় বলে পরিশ্রম বিমুখ হওয়ার প্রবণতা তৈর হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেসব নাটকীয় উপদান মাঝে মাঝেই ক্লাইমেক্সে পৌঁছে যায় তা নিয়েও ডকুমেন্টরি, ডকুফিকশন স্যাটায়ার ইত্যাদি নির্মিত হতে পারে। এই যে প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও রহস্যময়ভাবে মানুষ খুন হচ্ছে- এও তো নাটক-চলচ্চিত্রের বিষয় হতে পারে। অথবা দু’হাজার তেরো থেকে পনেরো পর্যন্ত রাজনীতির নামে দেশে যা হয়ে গেল তাও তো ‘বিষয়’ হতে পারতো। খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলে আমরা কেবল পেট্রোলবোমায় পোড়ার পরিসংখ্যান পড়েছি। বার্ন ইউনিটে নতুন রোগীর সংযোজন ও মৃত্যুর খবর পড়েছি। এই অহেতুক মৃত্যু কেন বরণ করতে হবে সাধারণ মানুষকে? রাজনৈতিক রেষারেষির বলি খেটে খাওয়া মানুষ কেন হবে? এই মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে সমস্যার গভীরে যাওয়া এবং এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করার সৎ প্রচেষ্টা থেকে বেরিয়ে আসতে পারত রাজনৈতিক ব্যাধির গভীরতম কারণ। উপার্জনক্ষম যে মানুষগুলো দগ্ধ হচ্ছে তাদের পরিবারগুলোর কি হচ্ছে, কিভাবে তারা ক্ষমতার রাজনীতির পাঁকে পড়ে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হচ্ছে তা নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি হতেই পারতো। কিন্তু কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে এরকম কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এর কারণও ওই পক্ষ বিপক্ষের রাজনীতি। টিভি চ্যানেলের মালিক যে দলের সমর্থক বা সক্রিয় নেতা সে চ্যানেলের সব প্রোগ্রাম ওই রাজনৈতক দলের মতাদর্শের অনুগামী হতে হবে। শিল্প সংস্কৃতির জগতে এই বিভাজন আশঙ্কাজনকভাবে স্থবির করে দিচ্ছে সৃজনশীলতাকে। অবশ্য এদেশের গণতন্ত্রেরও সীমাবদ্ধতা অনেক। ভারতের গণতন্ত্র কর্পোরেট পুঁজিনির্ভর হয়ে পড়লেও ওদেশে এখনও খোলামেলা বা স্বাধীন মত প্রকাশের পরিসর অনেক বড়। তাই হায়দারের মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়। এ চলচ্চিত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে আমাদের দেশে তা সম্ভব নয়। কোনো সৃজনশীল নির্মাতার পক্ষে এ ঝুঁকি নেয়া কঠিন। বিভিন্ন বাহিনী বাংলাদেশে যেভাবে সাধারণ মানুষের প্রায় গায়ে গায়ে লেগে আছে তাতে অনেক ঘটনারই অন্তরালের আসল কারণ নিয়ে কাহিনী নির্মাণ বেশ কঠিন। এও এখানকার এক বড় বাস্তবতা। সৃজনশীলতা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা। যেকোনো দেশে সুস্থ রাজনীতি চর্চার বিকল্প নেই। বাংলাদেশের এখনকার রাজনীতি বিপজ্জনক পথে হাঁটছে। এরকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় নেমে আসা অস্বাভাবিক নয়। রাজনীতিবিদরা পথ হারিয়েছেন, শিল্প সংস্কৃতির জগতের মানুষদের দায় তাই এখন অনেক বেশি। যদিও সুস্থ রাজনীতির বিকাশ ছাড়া সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব নয়। তবু গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারার বাইরে দাঁড়িয়ে যতটা সম্ভব সাংস্কৃতিক কর্মকা- বাড়ানো প্রয়োজন। এদেশের রাজনীতিকরা জনগণের জন্য রাজনীতি করেন- এ গাঁজাখোরি গপ্পো মানুষ আর বিশ্বাস করে না। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির নগ্ন বহির্প্রকাশে লজ্জিত হওয়ার বোধটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন রাজনীতিবিদরা। কিন্তু এত কিছুর পরেও জনগণ জাগছেন না কেন? বার বার এ প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে তারপরও সয়ে যাচ্ছে সবাই সবকিছু, কেন? এর উত্তর খুব সোজা নয়। সাধারণভাবে এটুকু বলা যায়, রাষ্ট্রক্ষমতা কারা নিয়ন্ত্রণ করবে তা নির্ধারণের জন্য পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন নির্বাচন খেলা একটা হয় ঠিকই এবং তাতে দেশীয় খেলোয়াড়রা অংশও নেন কিন্তু হার-জিত নির্ধারিত হয় ক্ষমতার উচ্চ মার্গীয় অন্য জায়গা থেকে। পৃথিবী বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো কিভাবে চলবে, কারা চালাবে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে ওখান থেকেই। দেশীয় রাজনীতির মাঠের ক্লাউনদের লম্ফঝম্প না থাকলে জনগণের দৃষ্টি বিভ্রম ঘটানো সহজ হয় না। এতে এক শ’ ভাগ ক্ষতি দেশের মালিক জনগণের। পরিকল্পনার নিখুঁত বুনটে দুই জোটে মানুষকে এমনভাবে বিভক্ত করা হয়েছে যে একেই মনে হচ্ছে চূড়ান্ত। এ দৃষ্টি বিভ্রম ঘটানো হয়েছে জনগণের কথা বলার সত্যিকারের নেতৃত্ব যাতে গড়ে না ওঠে সেজন্য। যারা মেহনতী মানুষের মুক্তির আদর্শের বড় বড় বুলি কপচে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়েছেন তাদের অনেকে এখন নগ্নভাবে ক্ষমতার রাজনীতির লেজ ধরে পুঁজির পা চাটছেন। জনগণের সামনে দাঁড়ানোর লিডারশিপের জায়গা একেবারে শূন্য। এখন প্রয়োজন স্বচ্ছ দৃষ্টির নতুন নেতৃত্বের। যাঁরা পর্দার সামনের এবং পেছনের খেলা দেখতে, বুঝতে এবং তা থেকে বেরোনোর সত্যিকারের সদিচ্ছা ও উপায় বের করবেন।
×