ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চা শিল্প

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৪ মে ২০১৬

চা শিল্প

পানীয় হিসেবে চা জনপ্রিয় করতে ব্রতী হয়েছিলেন শতবর্ষেরও আগে স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। বিজ্ঞাপনের কপি লিখেছিলেন ছড়ায়। যা শোভা পেত এক সময় দেশের বিভিন্ন রেলস্টেশন ও স্টিমার ঘাটে। আর ব্রিটিশ রাজের আনুকূল্য ও চা কোম্পানির বদান্যতায় মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগণ চায়ের স্বাদ উপভোগ করতে পারত বিনামূল্যে। সেই চা এখন যথেষ্ট মূল্য দিয়ে পান করতে হয়। চায়ের আবিষ্কার চীন দেশে হলেও তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অসমে প্রথম চা চাষের সূত্রপাত ঘটায় ১৯৩৫ সালে। তারও আগে ১৮৫৪ সালে অনুকূল আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। গত শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত রফতানিযোগ্য পণ্য হিসেবে পাটের পরেই ছিল চায়ের স্থান। নানা কারণে চা শিল্প তার গৌরব হারানোর পথে। এক দশক আগেও এদেশের চা রফতানি হতো, অর্জিত হতো বৈদেশিক মুদ্রা। সেই চা আমদানির খাতে এখন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। ওই সময়ে উৎপাদিত চায়ের ৮০ শতাংশ রফতানি হতো। এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ায় উৎপাদিত চায়ের ৯৬ শতাংশ দেশেই ব্যবহৃত হচ্ছে। চায়ের উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির চেয়ে ভোগ চাহিদার প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। ফলে চা রফতানিকারক দেশটি হয়ে গেছে আমদানিকারক। একদিকে চায়ের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে আশঙ্কাজনকহারে কমে যাচ্ছে চায়ের রফতানি বাণিজ্য। যে কারণে রফতানিকারক দেশগুলোর তালিকা থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ এখন আমদানিকারক দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। দেশী বাজারে চায়ের দাম বেশি হওয়ায় আমদানি বেড়েছে। বিশ শতকের সত্তর ও আশির দশকে জাতীয় অর্থনীতিতে চায়ের যে শক্তিশালী অবস্থান ছিল এখন আর তা নেই। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পেরে চা শিল্পে বর্তমান হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা তৈরি হয়েছে। উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে দেশে মাথাপিছু চায়ের চাহিদা। ফলে রফতানি কমে আমদানি বেড়েছে। বর্তমানে চায়ের বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অবদান নেই। অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন কমেছে। ক্রমান্বয়ে দেশ হারাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজার। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের চা ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ভারত প্রভৃতি দেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। বিপুল পরিমাণ চা আমদানি হলেও দেশীয় চায়ের বাজারে দাম কমছে না। চায়ের গুণগতমান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। কম দামে বিদেশী চা আমদানির ফলে কমে গেছে দেশীয় চায়ের চাহিদা, বিক্রি না হওয়ায় উৎপাদন পর্যায়ে চায়ের দাম কমেছে। বাগান মালিকরা অবশ্য পড়েছেন লোকসানের মুখে। চায়ের নিলামেও কমে গেছে দাম। ফলে দেশীয় উৎপাদনকারীরা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। শ্রমিকের মজুরি, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বেড়েছে। সেইসঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুতের খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। ফলে একদিকে বাড়ছে চায়ের উৎপাদন খরচ, পাশাপাশি দেশীয় বাজারে চাহিদা ও মূল্য হ্রাস পাওয়ায় এ শিল্পে কমে গেছে আয়। ব্যাহত হচ্ছে তাই চা শিল্পের সম্প্রসারণও। তুলনামূলক কম শুল্ক সুবিধার ফলে বিদেশ হতে নিম্নমানের চা আসছে। আমদানিকারকরা এসব নিম্নমানের চা দেশীয় ভাল চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে বাজারজাত করছে। কম মূল্যে চা আমদানিতে হারাতে হচ্ছে রাজস্ব। সীমান্তপথেও বেড়েছে চায়ের চোরাচালানি। দেশীয় চা শিল্পকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শ্রমঘন এই শিল্পকে দিতে হবে সুরক্ষা। যদিও দেশে চা উৎপাদনের যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পর বিদেশে রফতানি করাও সম্ভব। দেশীয় শিল্প বিকাশের স্বার্থে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে চা আমদানি নিরুৎসাহিত করা উচিত। সেই সঙ্গে দেশীয় এ শিল্পকে স্বল্প সুদে সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ করা প্রয়োজন। তা না হলে উৎপাদন হ্রাস পাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিনিয়োগ। চা শিল্পের হারানো অতীত ফিরিয়ে আনার জন্য এ খাতে নজর দেয়া এই মুহূর্তে জরুরী।
×