ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মানস ঘোষ

বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বেকায়দায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৪ মে ২০১৬

বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বেকায়দায়

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন-২০১৬ ইতোমধ্যে চমক সৃষ্টি করেছে এবং নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ১৯ মে চূড়ান্ত ফলাফলের আগে এর মাত্রা আরও বাড়বে। বর্তমান ভোটের হাওয়া কার জন্য হতাশা বয়ে আনবে যা আগাম বলা মুশকিল। তবে এটা সত্য যে, তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জী যে কিনা কিছুদিন আগেও ২০১১ সালের চেয়ে বিপুল বিজয় অর্জন করার ব্যাপারে অতি আত্মবিশ্বাসী এবং উৎফুল্ল ছিলেন, ‘নারদা ঘুষ’ কেলেঙ্কারি প্রকাশ ও উড়াল সেতু পতনের পর তার সময়টা একটু বিব্রতকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যে কংগ্রেস বাম জোটকে একসময় তিনি তৃণমূলের তুলনায় অবজ্ঞাভরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেটাই কিনা আজ তাঁর ক্ষমতার মসনদে চড়ার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে যে বিজেপি কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি তারাও এই সুযোগে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এমনকি কয়েকটি আসনে একপা দিয়েও রেখেছে। সেই কারণে মমতা প্রতিনিয়ত ভুলের মাসুল গুনে ভোটারদের আস্থা না হারানোর আকুতি জানিয়ে যাচ্ছে। ‘নারদা ঘুষ’ কেলেঙ্কারি নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত মমতার আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা এতই অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে যেÑ তিনি তাঁর বোধশক্তিও যেন হারাতে বসেছেন। ‘আসুন এবং আমাকে চড় মারুন, তবু ভগবানের দোহাই আমাকে চোরের কালিমা দেবেন না।’ ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী এবং একটি দলের নেত্রীর মুখ থেকে যখন এই কথা শোনা যায় তখন নির্দ্বিধায় বলা যায় ভোটের ওপর ‘নারদা ঘুষ’ কেলেঙ্কারির প্রভাব নিয়ে তিনি কতটা চিন্তিত। ‘আমি আপনাদের গৃহপরিচারিকার কাজ করতে রাজি আছি, কিন্তু ভগবানের দোহাই আমাকে চোর বলবেন না।’ ভোটারদের কাছে তাঁর আকুতি এমনই ছিল। তাঁর সমর্থকরা বলছেন, এটা মমতার রক্ষণাত্মক পরিকল্পনারই অংশ যাতে ‘নারদা ঘুষ’ কেলেঙ্কারির প্রভাব তাঁর নিজ নির্বাচনী আসন ভবানিপুরের ওপর না পড়ে। কারণ বিগত লোকসভা নির্বাচনে এই আসনে তৃণমূল বিজেপির চাইতে পিছিয়ে ছিল। বিগত কয়েক মাস যাবত ভাগ্যও মমতার সহায় হচ্ছে না। প্রথমে নারদা ঘুষ কেলেঙ্কারির পরপরই কাল্পনিক ভিডিওর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অপদস্থ করার ব্যর্থ চেষ্টা। যার ফলে তৃণমূল নেতৃবৃন্দের সাইবার ক্রাইম এ্যাক্ট এবং মানহানির মামলায় জড়াতে হয় যা মমতার ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে এক জটিল অবস্থার ঘুরপাকে আবদ্ধ হয়। যখনই ভিডিওর ব্যাপারটি ভাটা পড়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই তাঁর কর্মীরা বিরোধী শিবিরের দুটি ৪ বছরের শিশুকে লাঠি দিয়ে পেটায় যার মধ্যে একটি বাচ্চা সিপিআইয়ের (এম) পোলিং এজেন্টের। এর ক্ষোভ এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, শেষমেশ স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক দীনেশ ত্রিবেদী নির্যাতনের শিকার শিশুদের পক্ষ নিয়ে তার দলের সন্ত্রাসী বাহিনীকে এই কর্মকা-ের জন্য দায়ী করে। এ সবই মমতাকে এক গোলকধাঁধার মধ্যে নিয়ে যায় এবং নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলগুলো একে কাজে লাগিয়ে মাঠ গরম করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। প্রকৃতপক্ষে দলের এই বেহাল অবস্থার জন্য নিজেকেই দূষতে পারেন মমতা। যখন নারদা ঘুষ কেলেঙ্কারি প্রথম প্রকাশ পায় তখন মমতা একে বানোয়াট এবং তাঁর দলকে হেয় করার রাজনৈতিক চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দেন। পরবর্তীকালে ঘুষের টাকাকে নির্বাচনী খরচের জন্য অর্থ সাহায্য বলে অজুহাত দাঁড় করায়। নিজের এমন তথ্য ভোটারদের কাছে যে মোটেই ধোপে টেকেনি তা আঁচ করতে পেরে নিজের ভাবমূর্তি রক্ষায় তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। ‘যদি এই লজ্জাকর ঘটনা তৃণমূলের মনোনয়নের পূর্বেই ঘটত তাহলে আমি জড়িত নেতাদের কিছুতেই দলের টিকেট দিতাম না’ বলে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এটা নিতান্তই নেতৃবৃন্দের মাঝে কোন্দল সৃষ্টি করার নোংরা রাজনীতি, কারণ নারদা ইতোমধ্যেই তার বিশ্বস্ততা ও সততার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে?’ দুষ্কৃতকারীদের ব্যথা প্রশমিত করতে তিনি বলেন, ‘যাদেরকে এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়ানো হয়েছে রাজনীতিতে টিকে থাকতে তাদের ঘুষের দরকার নেই; কারণ তারা নিজেরাই একেকজন ধনকুবের।’ কিন্তু মমতার সকল প্রয়াস যখন একের পর এক মুখ থুবড়ে পড়ে তখন তিনি বলেন, ‘আমি যদি চোর হই আমাকে ভোট দেবেন না।’ তাঁর ক্রমশ পরিবর্তিত বিতর্কিত অবস্থান সত্যকে আড়াল করার নামান্তর মাত্র। বিরোধী দলগুলোর প্রচারে তা জনগণের মস্তিষ্কে এমনভাবে গেঁথে যায় যে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অত সহজ হবে না। ২০১৩ সালের একটি ভিডিও, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে রাজনাথ সিং নরেন্দ্র মোদিকে মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছেন। তাতে রাজনাথের জায়গায় প্রকাশ কারাতের ছবি বসিয়ে মমতা নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনেন। ভিডিওটির মাধ্যমে মমতা মুসলিম ভোটারদের দেখাতে চেয়েছেন, বিজেপির সঙ্গে মার্কসবাদী কংগ্রেসের সখ্য। পরিণতিতে বিজেপি তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির তালগোল প্রশমিত হবেই হবে, এমন সময় তৃণমূল কর্মী দ্বারা নিষ্ঠুর শিশু নির্যাতনের খ—গ এসে পড়ে মমতার সামনে। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল ক্যাডার নির্যাতিত শিশুর বাবার কাছ থেকে জোরপূর্বক লিখিয়ে নেয় যে, পারিবারিক কলহের জের ধরে বাচ্চাদের মারা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় বিধায়ক দীনেশ ত্রিবেদী বলেন, ‘নির্যাতিত শিশুরা নগ্ন রাজনীতির শিকার এবং দোষীদের শাস্তি হওয়া উচিত।’ ত্রিশূলের এই আঘাত মমতাকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে দেয়। যারা ২০১১ সালে সিপিআইকে (এম) ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদে মমতার অগ্রদূত ছিল সেই সিঙ্গুরপুর কৃষকদের শনিবারের র‌্যালিতে নীরব অভিবাদনই প্রমাণ করেÑ কত দ্রুত ভোটারদের অবস্থান তৃণমূল থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। টাটা কর্তৃক গাড়ি নির্মাণের কারখানা তৈরির জন্য ভূমি অধিগ্রহণের যে ইস্যু কাজে লাগিয়ে সিঙ্গুরপুর কৃষকদের মন জয় করেছিল সেই কারখানা সিঙ্গুর থেকে গুজরাটে পাঠালেও কৃষকদের ভূমি ফেরত দেয়নি মমতা। সিঙ্গুরের অর্থনৈতিক অবনতির জন্য আজ তারা মমতাকেই দুষছে। আজকের দিনে কৃষকরা বলছে, ‘আমরা টাটাকে সিঙ্গুরেই চাই। আমরা চাকরি চাই। মমতা আমাদের ভুল পথ দেখিয়েছে। মমতার জন্য সবচেয়ে দুঃসংবাদ হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নির্বাচন কমিশন তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছে এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়ার সকল প্রস্তুতিই নিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বিধানসভা ভোটের চতুর্থ দফা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব ছিল না। প্রথম তিন দফা ভোট কারচুপি ও রাজনৈতিক হানাহানির মধ্যে শেষ হয় যার ফলাফল ১২টি লাশ। মমতা কমিশনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রচ-ভাবে তার সকল কৌশল ব্যবহার করেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বিগত পঞ্চায়েত ও নাগরিক ভোটের মতো প্রহসনের নির্বাচন দিতে একদমই নারাজ। লেখক : পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় সিনিয়র সাংবাদিক
×