ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

উদ্ভট উটের পিঠে কি চলেছে স্বদেশ?

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ৪ মে ২০১৬

উদ্ভট উটের পিঠে কি চলেছে স্বদেশ?

আমার এক বন্ধু কবিতা আওড়াতে ভালবাসেন, বিশেষ করে শামসুর রাহমানের। বাংলাদেশে কবি শামসুর রাহমান একমাত্র কবি যিনি ১৯৫২ থেকে শুরু করে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নানা ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কবিতা লিখে গেছেন। খুব সম্ভব এরশাদ আমলে যখন ধর্ম নিয়ে ভ-ামি চূড়ান্ত পর্যায়ে চলছে তখন খবর ছাপা হলো, কয়েকটি উট আনা হয়েছে ঢাকায়। এবং বেশ কিছু ব্যক্তি উটের মূত্র সংগ্রহ করছে পবিত্র পানীয় হিসেবে পান করার জন্য। যেমন, আমরা হজে গেলে জমজমের পানি নিয়ে আসি। তারপর পবিত্র পানীয় হিসেবে অল্প অল্প করে খাই যেন ফুরিয়ে না যায়। তখন শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। বেশ কিছুদিন আগে আপীল বিভাগে একটি মানহানির মামলার শুনানি হয়। জনকণ্ঠে স্বদেশ রায়ের একটি লেখায় মাননীয় প্রধান বিচারপতি খুব ক্ষুব্ধ হন। ক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক ছিল, যদি প্রতিবেদনের পেছনে প্রমাণ না থাকত। স্বদেশ যে ইনফারেন্স টেনেছেন সেটি নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে কিন্তু যে প্রমাণগুলো ছিল সেগুলো স্বদেশ মনে করেছিলেন- সারকমেস্টেনশিয়াল এভিডেন্স যথেষ্ট। প্রধান বিচারপতি সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেননি। কিন্তু অভিযোগটা ছিল তাঁর বিরুদ্ধে এবং বিচারও করলেন তিনি যেটি আনপ্রিসিডেন্টেড। আসামি পক্ষের উকিলকে যথেষ্ট নাজেহাল হতে হলো এবং দেখলাম সমবেত আইনজীবীরাও বৈরী। তখন বুঝলাম ভেস্টেড ইন্টারেস্ট কাকে বলে! বিচারপতি বিরুদ্ধে অভিযোগ, অনেকে বলেছেন যাদের অধিকাংশ আইনজীবী যে, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র। কিন্তু যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনিই বিচারক হতে পারেন কিনা এবং সেটি ন্যাচারাল জাস্টিসের বিপরীত কিনা বা তাও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার পদক্ষেপ কিনা সেব প্রশ্ন কেউ তুলতে পারেননি, তুলতে চাননি। এসব শুনেটুনে আমার বন্ধু আওড়াল, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।’ নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে পুলিশ কমিশনার বেশ কিছু বাণী দিলেন যার মূল অর্থ ঘরে বসে থাকা বিধেয়। গানের কনসার্ট হতে হবে বৈশাখের তপ্ত দিনে দুপুর একটায়। হয়েছিলও প্রায় জনশূন্য অবস্থায়। ছোট দোকানিদের ব্যবসা মার খেয়েছিল কারণ, বাধানিষেধের কারণে অনেকের উৎসাহও মিইয়ে গিয়েছিল। বৈশাখে সবাই বেরোয় বিকেলে। এখন বলা হলো [বা যা বোঝানো হলো] বেরোতে হবে তপ্ত দুপুরে। এ যেন মাথা ব্যাথা হলে মাথা কেটে ফেলার আদেশ। প্যারিসে বোমা হামলার পরদিনই সব রেস্তরাঁ খোলা ছিল। এবং পুলিশ অপরাধীদের ধরেছিলও। সেটিই হচ্ছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রদান। আর এখানে ইংরেজী নববর্ষে বৈশাখে বা নববর্ষে অনেক রাস্তাঘাট বন্ধ, নাকি নিরাপত্তা, আমার বন্ধু ফের আওড়াল, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।’ আওয়ামী ওলামা লীগ নববর্ষ বন্ধে ফতোয়া দেয়। আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ওলামা লীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন নয়। পরদিন কাগজে ছবি বেরোয় আওয়ামী নেতা ওলামা লীগের ব্যানার ধরে আছেন। ওলামা লীগের এ ধরনের কথা বলা আর জঙ্গীদের হুমকির তফাৎ কি! তারা আওয়ামী লীগের না এটিই যেন বিশাল এক ব্যাপার। হ্যান্স এ্যান্ডারসেনের গল্পে আছে, রাজা উলঙ্গ হয়ে চলছেন কিন্তু তার ধারণা পরনে তার জাঁকালো পোশাক। আর শিশুরা তা দেখে হাসি-তামাশা করছে। ওলামা লীগের ব্যানার ধরে আছেন আওয়ামী লীগ নেতা এটি দেখে আমার বন্ধু আওড়াল- ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।’ থাক এ বৃত্তান্ত। কিন্তু এখন দেখছি এ কথা অনেকে বলছেন। এবং আফসোস করছেন, শেখ হাসিনা যে দিনরাত এত কষ্ট করছেন তা ভেস্তে যাচ্ছে বা যেতে পারে কাদের জন্য? তিনি কি এত অসহায় যে, চারদিকে যা ঘটছে তা তার মেনে নিতে হবে? অর্থনৈতিক এত উন্নয়নের পরও কেন মানুষ ক্ষুব্ধ থাকবে এ প্রশ্ন জাগছে অনেকের মনে। আমরা যারা এ সরকারকে সমর্থন করেছি এবং করছি, তাদের মনেও জাগছে নানা প্রশ্ন। আগে, এসব নিয়ে লেখালেখি হতো, নাগরিক সমাজের সচলতা বোঝা যেত। এখন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছাড়া আর কেউ লিখতে চান না। এটি সরকারের জন্য শুভ সংবাদ নয়। সরকারের জন্য শুভ সংবাদ হলো, তর্ক-বিতর্ক হবে, ক্ষোভ প্রশমন হবে, সমাজ প্রাণবন্ত থাকবে, নাগরিক সমাজের আলোচনা তুলে ধরবে গণতন্ত্র শেকড় গাড়ছে। বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য সজীব সমাজ, স্থবির সমাজ নয়। আমার এবং আমার বন্ধুদের মনে যেসব প্রশ্ন জাগছে তার জবাব খোঁজার চেষ্টা করছি এ নিবন্ধে। এখানে কারও সমালোচনা বা দোষ কীর্তন নয় বরং এ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো, খানিকটা নির্বস্তুক তাত্ত্বিক আলোচনা। ॥ দুই ॥ নীতি নির্ধারকদের মন কি এক রৈখিক? গত ৪০ বছর যে সব রাজনৈতিক দল, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী শাসন করেছে বাংলাদেশ, তারা খুব কম ক্ষেত্রে, তারা যে চিন্তা করেছে বা করছে তার বাইরেও যে চিন্তা থাকতে পারে এবং তা সামগ্রিক উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে, তা তাদের মনে হয়নি। এ ক্ষেত্রে এক ধরনের এ্যারোগেন্স তাদের মধ্যে কাজ করেছে। সামরিক গোষ্ঠী ক্ষমতায় এলে মনে করে, তারা ছাড়া সারাদেশের ব্লাডি সিভিলিয়ানরা অকম্মা, ধড়িবাজ এবং দুর্নীতিবাজ। রাজনীতিবিদরা দেশ ধ্বংসে ওস্তাদ। তারা ভুলে যায় যে, তাদের পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনও ব্লাডি সিভিলিয়ান। রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ভয়ে থাকে সুতরাং তারা দেশের এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছু বলে না, তোষামোদ করে। বিরোধী দলকে নাজেহালে বরং তারা মত্ত থাকে। সরকারে যারা থাকে তারা সব সময় এক ধরনের ‘ইমপিউনিটি’ পায় যা আবার সাধারণের প্রতি অবিচার। ১/১১-এর সময় দেখেছি, বিশেষ আদালতে এবং উচ্চ আদালতে ক্যাপ্টেন/মেজরদের লাফালাফি, তাদের নির্দেশে দ- প্রদান এবং অন্যায়ভাবে। বাঘা বাঘা ল’ইয়ার যারা শেখ হাসিনার মামলা করতে পারলে বর্তে যেতেন বা যে সব মক্কেল থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়েছিলেন আগে, তারা তখন শেখ হাসিনা বা সেই একই মক্কেলের মামলা নিতে রাজি হননি। আমরা নাম ধরে ধরে এসব নষ্টামির কথা বলতে পারি। এত প্রধান বিচারপতি এলেন তারপর, কই কেউ তো সেই সব বিচারপতি যারা অন্যায়ভাবে দ- দিয়েছে প্রহসনের বিচার করে তাদের কিছু বললেন না। তারা তো বিচার ব্যবস্থাকে নাজেহাল করেছিল। আস্থাহীন করে তুলেছিল। মন্তেষ্কু লিখেছিলেন, সব স্বৈরাচারের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জুডিসিয়াল টির‌্যানি। সেই সময় ব্যারিস্টার রফিকুল হক ছাড়া কারও মাজায় তো জোর দেখলাম না ঐ ধরনের আদালত অবমাননার বিরুদ্ধে কিছু বলতে। কিন্তু আমরা মুখ খুললেই আদালত অবমাননা। এমনকি বর্তমান জোট সরকারও এসব ক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ‘ইমপিউনিটি’ কাকে বলে! এ এক দুষ্টচক্র যা থেকে সরকারের তিনটি অঙ্গের একটিও বেরোতে পারছে না। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, এমনকি যারা কমিউনিস্ট পার্টি করেন, তারাও বারবার বলেন, গণতন্ত্র ছাড়া একটি দেশ চলতে পারে না। অন্তরে তারা এ কথা কতটা বিশ্বাস করেন জানি না। যারা তীব্রভাবে দল করেন তারাও করেন কিনা সন্দেহ; কারণ কোন দলে নেতা-নেত্রীর বক্তব্যে ইয়েস ভোট ছাড়া কিছুই পড়ে না। হয়ত ব্যতিক্রম খানিকটা কোথাও থাকতে পারে। কিন্তু তা ব্যতিক্রমই, সাধারণ ঝোঁক নয়। শিক্ষকদের বেতন নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠল তখন দেখেছি। স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে শিক্ষকদের আর নেতারা ভাবছেন, প্রধানমন্ত্রী ক্ষুণ্ণ হচ্ছেন না তো? প্রধানমন্ত্রী শেষ মুহূর্তে তাদের বাঁচিয়ে দিলেন। না হলে, ৩৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিতেও জোটপন্থী শিক্ষকরা ভোটে জিততেন না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তরুণ শিক্ষকরা যারা এখন মেজরিটি তারা এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন নেতাদের প্রতি যে, সাধারণ নির্বাচনে তার প্রভাব পড়ত। গণতন্ত্রের কথা বললে, সাধারণ মানুষের কথা বলতে হয় এবং তা বললে ভোটের প্রশ্ন আসে। ভোটের প্রশ্ন এলে তখন আদর্শটাদর্শ খুব একটা কাজ করে না। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে তখন দেখেছি ইনকিলাবিদেরও তুষ্ট করতে যদিও কমনসেন্স বলে, কোন ইনকিলাবিকে মন্ত্রী করার প্রতিশ্রুতি দিলেও সে ভোট দেবে না নৌকায়। ভোটের সময় রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য স্বাভাবিকভাবে হয় যে কোনভাবে জেতা, আদর্শ তখন ব্যাকফুটে। এখন তো রাজনীতি ঔপনিবেশিক আমলের রাজনীতি নয় যে, আদর্শ প্রধান হবে। ফ্রি মার্কেট ইকোনমিতে ভোটও ফ্রি মার্কেটের পণ্য। তখন সমঝোতা করতে হয় বিভিন্ন স্বার্থের সঙ্গে এবং এক সময় এমন হয় যে, কে কোন আদর্শের রাজনীতি করে তা গৌণ হয়ে পড়ে। প্রশ্নটা তাই জাগছে, বর্তমান রাজনীতিতে কি আদর্শ গৌণ? তাহলে বিএনপি জোট আর আওয়ামী জোটে তীক্ষè পার্থক্যটি কী হবে? কেননা, ফ্রি মার্কেট ইকোনমিতে তো দুটি দলই বিশ্বাসী। আদর্শ এ পরিপ্রেক্ষিতে স্রেফ মুখের বুলি, কার্যে তা পরিণত হয় না। হলে, উলেমা লীগ নেতারা এ ধরনের দেশের স্বার্থবিরোধী কথা বলেও নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতে পারতেন না। তখনই প্রশ্নটা ওঠে, যারা আদর্শের কথা বলে তাদের ঘোরাফেরা সীমিত, তারা হুমকির সম্মুখীন নিয়ত। বর্তমান সরকারের আদর্শ বিরোধীরা নয়। চিহ্নিত বিএনপি-জামায়াত না হলে, সব ঠিক হ্যায়। কিন্তু যারা ঐসব কথা বলে তাদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের তফাৎ কী? এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে না। সেই কবিতাটা মনে পড়ছে- ‘মাথায় কতো প্রশ্ন জাগে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার’- প্রশ্নগুলো জাগছে গত কয়েক মাস বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে চাপান-উতোর, প্রশ্নও তর্ক-বিতর্ক নিয়ে। আদালত অবমাননা, প্রধান বিচারপতির নানা নির্দেশ ও মন্তব্য, বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি, ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচন, বিএনপি-জামায়াত থেকে স্বতন্ত্র ও আওয়ামী বিদ্রোহী চেয়ারম্যানদের গরিষ্ঠতা, অর্থনৈতিক প্রবদ্ধির হার, জয়কে হত্যা প্রচেষ্টা ও শফিক রেহমানের গ্রেফতার, মুক্তমনা যাদের অনেককে ব্লগার হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাদের এবং প্রকাশকদের হত্যা ও হত্যা প্রচেষ্টা, পুলিশ কর্তাদের বিভিন্ন বক্তব্য- এসব নিয়ে তো বটেই রাস্তা মেরামতির নামে ভোগান্তি নিয়েও অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। আচ্ছা মগবাজারের ফ্লাইওভারের ভুল পরিকল্পনার জন্য যে কোটি কোটি টাকা গচ্চা গেল তা কার দোষে? এ নিয়ে কেউ কেন কিছু বললেন না? ‘ইমপিউনিটি’ কাকে বলে? এ সব নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বা সমালোচনা হলে সরকার পক্ষ তার কোন গুরুত্বই দেয় না। প্রায় সব কিছুর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এবং ষড়যন্ত্রের দায় দেয়া হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের ওপর। তবে, সব পক্ষের অসহিষ্ণুতা বেশি দেখা যাচ্ছে রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায়। সরকারের কোন নীতির সমালোচনা করলে বা আলোচনা করলে, যে করছে, তাকে তকমা দেয়া হয় সরকারবিরোধী বলে। সরকারবিরোধী হলে ষড়যন্ত্রের দায় তার ওপরও পড়ে। এ প্রশ্ন সরকার বা সরকারী দল মানতে নারাজ যে, সরকার বা দলের সমর্থক হয়েও সমালোচনা করা যায়, এ স্পেসটুকু নাগরিকরা অবশ্যই দাবি করতে পারেন। কিন্তু সামরিক-বেসামরিক যারাই ক্ষমতায় থাকেন, দেখেছি তারা নিশ্চিত আনুগত্য বা এ্যাবসলিউট লয়ালিটি চান। অভিজ্ঞতা বলে, এ দেশে এ্যাবসলিউট আনুগত্য একবারই দেখা গেছে ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর প্রতি। কিন্তু, তারপর তা থাকেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যারা তাঁর সঙ্গে ছিলেন, ছিলেন ঘনিষ্ঠ, যাদের উচ্চাসনে বা নীতি নির্ধারণে বসিয়েছিলেন তারা কি এ্যাবসলিউট লয়ালিটি দেখিয়েছিলেন? শেখ হাসিনা ২০০১ সালে যখন ক্ষমতা হারালেন তখন থেকে আবার ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত কি নিশ্চিত আনুগত্য পেয়েছিলেন। একই কথা খাটে বিএনপি ক্ষমতা হারানোর পর খালেদার ক্ষেত্রেও। আদর্শের বিষয়টা যখন মানুষ দেখে কার্যকরভাবে মানা হচ্ছে তখন নিশ্চিত আনুগত্য খানিকটা নিশ্চিত হয়। ঐ বিষয়ে শিথিলতা দেখা দিলে দলের নেতাকর্মী, সরকারের মানুষজন সুবিধাবাদী হয়ে ওঠে। আমি মেধাবী আলোচক বা লেখক নই দেখে, মূল কথা বোঝাতে অনেক বাগাড়ম্বর করতে হচ্ছে। কিন্তু মূল বিষয়টি অল্প কথায়ও বলা চলে, যেমনটি বলেছেন ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ইউরোপে আধুনিকতার শুরু ধরে নিতে পারি, যখন ধর্ম ও রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলো। ‘তাকে প্রতিহত করার জন্য অনুমোদিত ধর্মমত অথবা সার্বভৌম রাষ্ট্রশক্তির বিরোধী লেখা বা বক্তৃতাকে কঠোরভাবে দমন করার চেষ্টা হলো। সেখান থেকেই বাক্স্বাধীনতার অধিকারের আধুনিক ইতিহাস শুরু। এ অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে লড়াই হয়েছে অনেক। তা সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীজুড়ে [এবং এখনও] রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিষয়ে কথা বলা বা লেখার স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়েছে যতটা, তা লঙ্ঘিত হয়েছে অনেক বেশি। অধিকাংশ রাষ্ট্র, তা ফ্যাসিবাদী হোক আর সমাজবাদী হোক, সেনাশাসিত হোক অথবা একদলীয় হোক, নিজের ক্ষমতা কায়েম রাখার জন্য বিরোধী জনমতের প্রচার বন্ধ করতে সচেষ্ট থেকেছে। তাদের পক্ষ থেকে যুক্তি হলো, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এমনটা করা জরুরী। নইলে অরাজকতা গ্রাস করবে দেশকে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও তাদের অনুমোদিত তত্ত্ব বা আচারের বিরুদ্ধবাদী মতকে স্তব্ধ করার জন্য প্রায়শই রাষ্ট্রশক্তির সাহায্য নিয়ে এসেছে।’ [জনপ্রতিনিধি] এর বিপরীতে জন স্টুয়ার্ট মিলের অন লিবার্টির বা বাক্স্বাধীনতার পক্ষে জোর সওয়ালের কথা সবার জানা। কিন্তু, এখন প্রশ্ন উঠেছে, এই স্বাধীনতা কি হবে সীমাহীন, না তারও একটা সীমা থাকে? যেসব ঘটনার কথা আগে উল্লেখ করলাম সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগছে, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কি এক? ব্যক্তির সমালোচনা করার অর্থ কি প্রতিষ্ঠানকে সমালোচনা করা? প্রতিষ্ঠানগুলো কি এতই দুর্বল যে, ব্যক্তির সমালোচনার কারণে মিং ফুলদানির মতো [এতই ভঙ্গুর যে], মাটিতে পড়লে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে? রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে কি কেউ বড়, কেউ ছোট না সব সমান? এসব বিষয় পরিষ্কার হওয়া উচিত। না হলে বিভ্রান্তি বাড়বে, তার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভ। আমাদের মনে রাখা দরকার আমরা কেউ অজেয় নই, অমরও নই। এতসব ঘটনার মধ্যে যে দুটি বিষয় নিয়ে সবাই আলোচনা করছেন তা হলো আদালত ও প্রতিদিনের খুন বিশেষ করে ‘ব্লগার’ খুন। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এত বিচারপতি এসেছেন, গেছেন কিন্তু আমরা মনে রেখেছি দু’তিনজনকে। তাঁরা এখনও কোন না কোনভাবে স্মরিত। যেমন মাহবুব মোর্শেদ, আবু সাঈদ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান। তাদের কোন রায় আমার পড়া নেই, কিন্তু উচ্চ আদালতের কথা এলে তাদের মনে পড়ে। তাদের মানুষ যতটা না বিচারক হিসেবে, তার চেয়েও বেশি মনে রেখেছে জনস্বার্থ দেখার কারণে। এরা তিনজন শুধু প-িত নন, বিদগ্ধ, বিনয়ী এবং উঁচুমানের বিচারপতি হিসেবে পরিচিত। এঁদের এজলাসে কাউকে কখনও আদালত অবমাননার জন্য ডাকা হয়নি। কারণ তারা জানতেন, আদালত একটি প্রতিষ্ঠান। বিচারক একজন ব্যক্তি যিনি ফেরেশতা নন। বিচারকের সমালোচনা আদালতের সমালোচনা নয়। তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা বোধ ছিল না, কারণ তারা জানতেন যে, তাদের পদে তারা যোগ্য। হীনম্মন্যতা বোধ তখন জাগে যখন ব্যক্তি অনুভব করে তার যে পদে যাওয়ার কথা নয় সে পদ তিনি পেয়েছেন যেভাবেই হোক। এ জন্য ব্রিটেনের লর্ড ডেনিংয়ের একটি রায়ের পর যখন পত্রিকায় লেখা হলো যে লর্ড ডেনিং একটি গাধা, তিনি তখন মুচকি হেসেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন যে, তিনি গাধা নন। আর যে ব্যক্তি খবরটি করেছেন তিনি ক্ষুব্ধ। কিন্তু বিচারপতি তো বিচারপতি আসনে বসে কিছু করতে পারেন না। লর্ড ডেনিং যদি গাধা হতেন তাহলে বিলক্ষণ চটতেন এবং আদালত অবমাননার জন্য তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেন। (চলবে)
×