ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এনজিও সিএইচসিপি’র ৬ কোটি টাকা আত্মসাত

প্রকাশিত: ০০:৫৪, ৩ মে ২০১৬

এনজিও সিএইচসিপি’র ৬ কোটি টাকা আত্মসাত

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বেসকারী সংস্থা (এনজিও) কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রজেক্ট (সিএইচসিপি) থেকে ৬ কোটি টাকা আত্মসাতসহ একাধিক অনৈতিক কর্মকান্ডের প্রমাণ পাওয়ার পরেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন সংস্থার চেয়ারম্যান, নির্বাহী পরিচালক ও অর্থ সমন্বয়কারী। তাদের দুর্নীতির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে দাতা সংস্থার অর্থ। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের ২৯টি অফিসে কর্মরত দু’শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। সিএইচসিপি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে সংস্থাটির যাত্রা শুরু হয়। পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার কাঠিরা গ্রামে স্থাপিত প্রধান কার্যালয় থেকে। পর্যায়ক্রমে সংস্থার কার্যক্রম দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় ২৯টি শাখা অফিসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পরার পড় এর প্রধান কার্যালয় নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থার একাধিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, শুরুতে আর্থ সামাজিক উন্নয়নে কাজ করলেও পর্যায়ক্রমে উন্নয়ন প্রকল্প বাদ দিয়ে ১৯৮৪ সাল থেকে দাতা দেশ জার্মানী (ইজেডই) সরকারের অর্থ সহায়তায় মাইক্রো ক্রেডিটের কাজ শুরু করা হয়। যা ছিল সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূত। দাতা সংস্থা তাদেরকে হেলথ কেয়ার প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দিতো। প্রয়োজনে মহিলাদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে বিনা সুদে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প চালুর নির্দেশনা দিয়েছিলো। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদ সবকিছু বাদ দিয়ে দাতা দেশের অর্থ মাইক্রো ক্রেডিটে ব্যবহার করে। ফলে দাতা সংস্থাকে কাগজে কলমে দেখানো হতো হেলথ প্রকল্পে সকল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। সূত্রমতে, দুই বছর মেয়াদী কমিটি নবায়নের কথা থাকলেও তা একটানা ২১ বছর চেয়ারম্যানের পদ আগলে রেখেছেন দুর্নীতিবাজ সুধীর অধিকারী। তার সরাসরি মদদে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ডাঃ সঞ্জীব কুন্ডু ও অর্থ সমন্বয়কারী জেমস মহানন্দ মন্ডল সংস্থার টাকা লুটপাটের মহোৎসবে মেতে ওঠেন। সর্বশেষ সংস্থার তাঁত, সেলাই, পাটের কাজ ও শো-রুমসহ বেশকিছু আয়মুখী প্রকল্পের পণ্য বিক্রি ও দেশ-বিদেশে কাজের লভ্যাংশ “পল্লী শ্রী” নামক হিসেবে ব্যাংকে জমা রাখেন। ওই হিসেবে ছয় কোটি টাকা জমা হয়। পরবর্তীতে ওই ছয় কোটি টাকা সংস্থার চেয়ারম্যান সুধীর অধিকারী আত্মসাত করার চেষ্টা করেন। ওইসময় বাঁধা হয়ে দাঁড়ান তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক ডাঃ নেলী সাহা। ফলে তাকে (নেলী সাহা) চাকুরিচ্যুত করা হয়। পরবর্তীতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কোন অনুমোদন না নিয়েই “পল্লী শ্রী” নাম মুছে দিয়ে পুরো ছয় কোটি টাকা আত্মসাত করেন চেয়ারম্যান, নির্বাহী পরিচালক ও অর্থ সমন্বয়কারী। সূত্রে আরও জানা গেছে, অর্থ সমন্বয়কারী মহানন্দ মন্ডলের বিরুদ্ধে সংস্থায় কর্মরত নারী কর্মকর্তাদের যৌণ হয়রানির একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এ কারনে তার বিরুদ্ধে ঢাকার বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে। ওইসব মামলার ব্যয়ভার বাবদ প্রায় দুই লাখ টাকা মহানন্দ অফিস থেকেই নিয়েছেন। নারী কর্মকর্তাদের কাছে টানতে মহানন্দ বেতন বৃদ্ধি এবং পদোন্নতির লোভ দেখাতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও তার কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ঢাকার আরবান প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প ব্যবস্থাপক উপজাতি সম্প্রদায়ের রুথ সেবিকা রাকসামকে চাকুরিচ্যুতসহ অসংখ্য নারী কর্মকর্তাকে হয়রানিমূলক বদলি এবং চাকরিচ্যুত করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, মহানন্দ নিজের ধর্ম গোপন রেখে নিজেকে মুসলমান দাবি করে মুসলিম পরিবারের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। পরবর্তীতে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ওই নারীকে মহানন্দ তালাক দিয়েছেন। এছাড়া মহানন্দ নিজে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সংস্থার বিভিন্ন শাখায় কয়েক লাখ টাকার জাল রেভিনিউ ষ্টাম্প সরবরাহ করতেন বলেও প্রমান পেয়েছেন তদন্ত কমিশন। অভিযোগে আরও জানা গেছে, মহানন্দের অর্থ আত্মসাতে মদদ না দেয়ায় হরিবাড়ি প্রকল্পের সদর শাখা ব্যবস্থাপক সাইদুর রহমান, ভরাডোবা শাখা ব্যবস্থাপক খগেন্দ্র নাথ সমদ্দার, বরিশালের আগৈলঝাড়ার কাঠিরা শাখা প্রকল্প ব্যবস্থাপক জগদীশ সানা, সংস্থার কর্মী ফিলিপ মালাকার, খগেন্দ্র নাথ সরকার, দীপক ও লিটন বাড়ৈসহ ১২ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যার মদদদাতা ছিলেন, চেয়ারম্যান ও নির্বাহী পরিচালক। সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী চাকুরিচ্যুতরা ক্ষতিপূরনের টাকা পাবেন। কিন্তু মহানন্দ ওই টাকা সংস্থা থেকে উত্তোলন করে সমুদয় টাকা আত্মসাত করেছেন। বিষয়টি জানতে পেরে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে দাতা সংস্থা দুর্নীতিবাজ পরিচালক সুধীর অধিকারীকে সংস্থার পদ থেকে সরে যেতে বলেন। কিন্তু তিনি সরে না যাওয়ায় তারা (দাতা সংস্থা) ফান্ড দেয়া বন্ধ করে দেন। ফলশ্র“তিতে যেকোন মুহুর্তে সংস্থাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকায় ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মিরপুর শাখা ব্যবস্থাপক লরেন্স বাড়ৈকে আহবায়ক করে গঠন করা হয় সিএইচসিপি নয় সদস্য বিশিষ্ট রক্ষা কমিটি। ফলে গত ৯ নভেম্বর অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুত করা হয় লরেন্স বাড়ৈকে। চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি তিনি সুনির্দিষ্ট ১০টি ঘটনা উল্লেখ করে লরেন্স বাড়ৈ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহা-পরিচালককে নির্দেশ দেন। এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কেএম আব্দুস সালাম ওই সংস্থার পরিচালক-১ গোলাম মেজবাহ উদ্দিনকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। তদন্ত কর্মকর্তা ৬ কোটি টাকা আত্মসাত ও তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কর্মরত নারী কর্মকর্তাদের যৌণহয়রানিসহ সুনির্দিষ্ট ১০টি অভিযোগের বাইরেও তথ্য প্রমানে আরও বিস্তার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে গত ২৯ ফেব্র“য়ারি ছয় পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদন দাখিলের পর আজো ওই তিন কর্মকর্তা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। ফলে বিপাকে পড়েছেন দেশের ২৯টি অফিসে কর্মরত দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা মাইক্রো ক্রেডিট চালিয়ে রাখলেও বেতন বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ ব্যাপারে পরিচালক সুধীর অধিকারীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। সিএইচসিপি রক্ষা কমিটির আহবায়ক লরেন্স বাড়ৈ জানান, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মদদ না দেয়ায় দু’শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। দুর্নীতিবাজদের সরিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দাতা সংস্থার নিকট থেকে ফান্ড এনে এ কার্যক্রমকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে সরকারের প্রতি তিনি দাবি করেন। তৎকালীন এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কেএম আব্দুস সালাম জানান, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগতপন্থায় ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
×