ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশী নৌ-ক্যাডেটদের কালো তালিকাভুক্ত করতে পারে আইএমও

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ৩ মে ২০১৬

বাংলাদেশী নৌ-ক্যাডেটদের কালো তালিকাভুক্ত করতে পারে আইএমও

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ মেরিন সেক্টরে মেরিন একাডেমির ক্যাডেটদের মতো মেরিন ফিশারিজ ক্যাডেটদের সিডিসি (কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট) দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ অবৈধ ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা বহির্ভূত বলে মেরিন একাডেমি ক্যাডেটদের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, আইএমও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের নিয়ম-কানুনকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে মন্ত্রণালয়ের স্বার্থান্বেষী একটি চক্র বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কাজে লিপ্ত রয়েছে। বিগত ২০০৮ সালের এ ধরনের সিডিসি দেয়া হয়েছিল মেরিন ফিশারিজ ক্যাডেটদের। কিন্তু আইএমও’র পক্ষ থেকে এ সংক্রান্তে কড়া নির্দেশ পাওয়ার পর ওইসব সিডিসি বাতিল করা হয়। বর্তমানে আবার ষড়যন্ত্রের বীজ বপন হয়েছে। বিষয়টি এখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। মেশিন ফিশারিজ ক্যাডেটদের সিডিসি প্রদানের প্রক্রিয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মেরিন সেক্টরে বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র দাবি করা হয়েছে। সূত্র জানায়, এমনিতেই সহস্রাধিক মেরিন ক্যাডেট ও ৫ শতাধিক মেরিন জুনিয়র অফিসার বেকার অবস্থায় রয়েছেন। বাংলাদেশের মেরিন সেক্টরের ইতিহাসে মেরিন ক্যাডেট ও অন্যান্য ক্যাটাগরির অফিসারদের বেকার থাকার ঘটনা এই প্রথম বলে জানানো হচ্ছে। তবে মেরিন একাডেমি কর্তৃপক্ষের মতে বেসরকারী মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠা বেড়ে যাওয়ায় বেকারত্বের মূল কারণ। যে কারণে বেসরকারী মেরিন একাডেমির ক্যাডেট প্রশিক্ষণ কার্যক্রম স্থগিত রাখার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে মেরিন একাডেমির কমানডেন্টের পক্ষ থেকে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে মেরিন একাডেমির প্রতিষ্ঠার লগ্ন থেকে প্রতিবছর ৫০ জন করে প্রশিক্ষণের জন্য ক্যাডেট ভর্তি করা হতো। মেরিন একাডেমির পাশাপাশি বেসরকারী মেরিন একাডেমিতে ২০১১ সালে ১শ’, ২০১২ সালে ৩শ’, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ৯শ’ করে এবং ২০১৫ সালে ৫শ’তে উন্নীত হয়। অভিযোগ রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন বা অবহিতকরণ ছাড়া এবং কোন ধরনের যাচাই-বাছাই বা ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়াই সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর ২০১১-২০১২ সালে ১৪টি বেসরকারী মেরিন একাডেমি অনুমোদন দেয়। এর আগে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারী খাতে আরও ৪টি মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। বেসরকারী খাতে যত্রতত্র মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর প্রতিবছর যে হারে পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা ছাড়াই ক্যাডেট বের হচ্ছে তাতে নৌ-সেক্টরে তাদের কর্মসংস্থান সংকুচিত হতে শুরু করে। এই অবস্থায় মেরিন ফিশারিজ একাডেমির ক্যাডেটদের সিডিসি দেয়ার প্রক্রিয়ার ঘটনাটি গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেরিন সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের মতে, ফিশারিজ একাডেমির ক্যাডেটদের ট্রেনিং দেয়া হয় ফিশিং ভেসেল বা মাছ ধরার ট্রলারে চাকরির জন্য। কিন্তু তাদের বাণিজ্যিক জাহাজে চাকরির জন্য সিডিসি প্রদান করা হয় তাহলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে আইএমও (ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন) এর কালো তালিকাভুক্ত হবে। যার ফলশ্রুতিতে কোন বাংলাদেশী মেরিনার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজে চাকরির লাভে সুযোগ হারাবে। আর এতে করে দেশ হারাবে মোটা অংকের রেমিটেন্স। উল্লেখ্য, দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা প্রায় ১৪ ভাগ যোগান দেয় এই মেরিনাররা। উল্লেখ্য, মেরিন ফিশারিজ ক্যাডেটদের এসটিসিডব্লিউ-এফ অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আইএমও’র রেগুলেশন অনুসারে এসটিসিডব্লিউ-এফ কনভেনশন অনুযায়ী প্রশিক্ষিত ফিশারিজ ক্যাডেটদের সিডিসি প্রদানের সুযোগ নেয়। শুধু এসটিসিডব্লিউ-২০১০ অনুযায়ী প্রশিক্ষিত ক্যাডেটদের সিডিসি প্রদানের সুযোগ রয়েছে। আইএমও’র এসটিসিডব্লিুউ হোয়াইট লিস্ট অন্তর্ভুক্ত থাকার জন্য আইএমও’র কার্যনির্বাহী কাউন্সিলের সদস্যপদ রক্ষার জন্য কনভেনশনটি প্রতিপালনে বাংলাদেশ বাধ্য। ফিশারিজ ক্যাডেটদের সিডিসি দিয়ে কনভেনশনের শর্তে ব্যত্যয় ঘটালে বাংলাদেশ আইএমও’র কাছে কালো তালিকাভুক্ত হওয়া তবে সময়ের ব্যাপার। যা একাধারে বাংলাদেশের মেরিটাইম সেক্টরকে বহির্বিশ্বের কাছে বিতর্কিত করে ব্যাপকভাবে ভাবমূর্তি নষ্ট করে। সূত্র জানায়, ইউরোপিয়ান কমিশনভুক্ত ২৭ দেশের বাণিজ্যিক জাহাজের বিশাল বহরসহ সব দেশের জাহাজ বহরে বাংলাদেশের অফিসার এবং নাবিকদের চাকরির জন্য এমসা (এসটিসিডব্লিউ কনভেনশন ও ইউরোপীয়ান কমিশন)-এর শর্ত মেনে চলতে বাধ্য। ওই শর্ত ভঙ্গ করে মেরিন ফিশারিজদের সিডিসি প্রদান করলে বাংলাদেশ ইউরোপীয়ান ইউনিয়নসহ অন্যান্য সদস্য দেশের স্বীকৃতি হারাবে। ২০০৮ সালে এ ধরনের সিডিসি প্রদান করার পর ইউরোপীয়ান মেরিটাইম সেফটি এজেন্সির প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ পরিদর্শনে এসে সুনির্দিষ্টভাবে বলে যায় যে, এদেশের শিপিং অথরিটি যেভাবে ফিশারিজ ক্যাডেটদের সিডিসি দিচ্ছে তা এসটিসিডব্লিউ কনভেনশনের যে রিকোয়ারম্যান্ট আছে তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয়ের ঘটনার পর সাগর থেকে মৎস্য ও বিভিন্ন সম্পদ আহরণ তথা ব্লু ইকোনোমির মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে সম্ভাবনার যে দ্বার উন্মোচন হয়েছে এ জাতীয় নীতি বিরুদ্ধ ঘটনা তা ধ্বংস করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। সূত্র জানায়, মেরিন ফিশারিজ একাডেমিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচের মাধ্যমে শর্ত পূরণ করে যে কোন উপায়ে সিডিসি প্রদানের ব্যবস্থা করা হলে তা হবে একদিকে সরকারী অর্থের অপচয়, অন্যদিকে মেরিন সেক্টরে বিশৃঙ্খলা ও ফিশিং সেক্টরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নেয়ার শামিল। দেশে বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক মানের মেরিন একাডেমি রয়েছে। অন্যদিকে আরও ৪টি সরকারী মেরিন একাডেমির নির্মাণাধীন যা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে ২০১৭ সাল থেকে। এ অবস্থায় এখন থেকে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল খাতে মেরিন একাডেমিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্যাডেটদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে সরকার পক্ষ থেকে উদ্যোগী তৎপরতা গ্রহণ করা না হলে দেশে ক্যাডেট উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে সত্য। কিন্তু তারা বেকারত্বের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। সূত্রমতে, মেরিন ফিশারিজ ক্যাডেটদের যদি কোন ফিশিং জাহাজে চাকরি নেন তবে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাসপোর্ট এবং সংশ্লিষ্ট দেশের ভিসাই যথেষ্ট। এক্ষেত্রে সিডিসির কোন প্রয়োজন নেই। তাছাড়াও আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী ফিশিং জাহাজে স্কিপার বা চীফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ২৪ মাস চাকরি সম্পন্নকারী ফিশিং ভেসেল কর্মকর্তাদের সিডিসি গ্রহণ ও সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজে চাকরিপ্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে। তাই বাণিজ্যিক জাহাজের সুযোগ দেয়ার নামে ফিশিং ভেসেলের জন্য প্রশিক্ষিত ফিশারিজ ক্যাডেটদের ক্যাডেট অবস্থায় সিডিসি প্রদান করে এদেশকে আইএমও’র কালো তালিকাভুক্ত করার পথে এগিয়ে দেয়ার সঙ্গত কোন কারণ থাকতে পারে না বলে সূত্রের অভিমত।
×