ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মে দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী

উৎপাদন বাড়াতে মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক চাই

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩ মে ২০১৬

উৎপাদন বাড়াতে মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক চাই

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পণ্যের গুণগতমান নিশ্চিত করার জন্য শিল্পকারখানায় শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, শ্রমিকের মূল্যই বর্তমান সরকারের কাছে সবচেয়ে বড়। তাদের হাতেই দেশের অর্থনীতি সচল থাকে। শ্রমিকদের কারণেই দেশ উন্নত হয়। তাই শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। রবিবার বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মহান মে দিবস উপলক্ষে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে রমজান মাসেও আন্দোলনরত শ্রমিকদের হত্যা করা হয়েছিল। সারের দাবিতে আন্দোলন করা ১৮ শ্রমিককে লাশ হয়ে ঘরে ফিরতে হয়েছিল। কিন্তু এখন দেশে সে অবস্থা নেই। দেশের শ্রমজীবী মানুষ এখন নিয়মিত বেতন-ভাতা, মজুরি পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, দেশ এখন সবদিক থেকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে বিদ্যমান উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে লক্ষ্য অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা সম্ভব হবে। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছি। আমরা বিজয়ী জাতি। বিশ্ব সভায় আমরা মাথা উঁচু করে চলতে চাই। আর মাথা উঁচু করে চলতে হলে কারও কাছে ভিক্ষা চেয়ে নয়, কারও কাছে হাত পেতে নয়। নিজেদের শ্রম, নিজেদের মেধা দিয়েই আমাদের দেশকে গড়ে তুলতে হবে। তিনি জাতির পিতার ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সকলকে একযোগে কাজ করে যাওয়ারও আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, উৎপাদন বাড়াতে হলে মালিক-শ্রমিকের একটা সুন্দর সুসম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। এই কর্মপরিবেশ গড়ে তোলা একান্তভাবেই জরুরী। মালিকদের মনে রাখতে হবে যে, শ্রমিকের উৎপাদনমুখী কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হলে শ্রমিকরা আনন্দের সঙ্গে কাজ করবে। এতে উৎপাদন ও পণ্যের গুণগতমান বৃদ্ধি পাবে। পক্ষান্তরে বেশি লাভবান হবে মালিকরাই। শ্রমিকরা যে কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, সেই কারখানা যাতে টিকে থাকে এবং সেটা যেন ভালভাবে চলে সেটার কিছু দায়িত্ব নেয়ার জন্য শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, উভয়পক্ষেরই দায়িত্ব রয়েছে। এই দায়িত্ববোধটা সকলের মাঝে থাকতে হবে এবং মালিক-শ্রমিক একটা সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। শ্রমিকদের কল্যাণে গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, এখন প্রবাসে যে শ্রমিকরা যান তাদের কল্যাণের জন্য সরকার বহুবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের স্মার্ট কার্ড দেয়া হচ্ছে। যেখানে সকল তথ্য থাকে। তাদের অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। তারা কোথায় কাজ করবে, বেতন কত পাবে, আদৌ তারা বেতন পাচ্ছে কি-না, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এসব বিষয় তদারকির ব্যবস্থাও আমরা নিয়েছি। অতীতে বিদেশে জনশক্তি রফতানির দুরবস্থার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অতীতে শ্রমিকদের কল্যাণের কোন রকম উদ্যোগই ছিল না। কোন রকম পার (সীমান্ত) করতে পারলেই তারা ভাবত বিরাট একটা কাজ করে ফেলেছি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর প্রবাসের শ্রমিকদের কল্যাণে বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী এ দেশে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, জাতির পিতার সকল আন্দোলন-সংগ্রামে, সকল উদ্যোগেই শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার পেয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি স্বাধীন দেশ গড়তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একাগ্রতার কথা স্মরণ কওে শেখ হাসিনা বলেন, একজন মা যেমন তার রুগ্ন শিশুকে পরিচর্যা করে, তেমনি বঙ্গবন্ধুও ধ্বংসপ্রাপ্ত শিল্পকারখানা একের পর এক গড়ে তুলে শ্রমিকের কর্মসংস্থান করেছিলেন। তিনিই প্রথম পহেলা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে সরকারী ছুটি ঘোষণা করেন। পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক অধ্যায়ের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতাকে হত্যার পর লাভজনক নয় এই কথা বলে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। পরের সরকারগুলোর আমলেও কারও কারও প্রেসক্রিপশনে এ দেশে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু মাথা কেটে ফেলা কোন সমাধান নয়। আমরা মনে করি কারখানা খোলা রেখেই দেশের উন্নয়ন হবে। তৈরি পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে সরকারী উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বেতন বাড়ানোর জন্য তিনিই ছিলেন শ্রমিকপক্ষের ’বার্গেনিং এজেন্ট’। ’৯৬ পরবর্তী তাঁর সরকারের প্রচেষ্টায় এবং ২০০৯ সালের বিশেষ উদ্যোগের ফলে শ্রমিকদের মজুরি কয়েক দফায় বেড়ে বর্তমানে পাঁচ হাজার তিন শ’ টাকা হয়েছে। এজন্য মালিকপক্ষের অনেক দাবিও সরকার মিটিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশকে উন্নত করতে হলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা চালু করতে হবে, শ্রমিকদের স্বার্থও দেখতে হবে। কারণ তাদের শ্রমেই তো দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকদের মূল্য আওয়ামী লীগের কাছে অনেক বেশি। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তাঁর সরকার এগিয়ে চলছে। তিনি বলেন, আমরা অনেক বন্ধ কারখানা চালু করেছি। অনেক কারাখানার যন্ত্র পুরাতন হয়ে গেছে। সেগুলো দিয়ে ভাল উৎপাদন করা সম্ভব নয়, সেগুলো চালু করতে যা যা করা দরকার আমরা করছি। সারাদেশে প্রায় এক শ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার সরকারী উদ্যোগের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী যত্রতত্র শিল্পকারখানা গড়ে না তুলে এসব অঞ্চলে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার জন্য শিল্পোদ্যোক্তাদের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, যত্রতত্র জমি কিনে শিল্প গড়ে না তুলে সারাদেশে অন্তত এক শ’ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। সেখানে বিনিয়োগ করুন। শিল্পাঞ্চলে জলাধারসহ পরিবেশবান্ধব সব বিষয় থাকা এবং শ্রমবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে। শ্রমিকদের উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি, যেন শ্রমিকরা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ন্যূনতম সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থার জন্য সরকারী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় খাতের শ্রমিকদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্দিষ্ট করেছি। আমাদের শতভাগ রফতানিমুখী শিল্পের জন্য কল্যাণ তহবিল গঠন করা হচ্ছে। মোট রফতানিমূল্যের দশমিক ৩ ভাগ অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে এই তহবিলে প্রদান করা হবে। এজন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর অধীনে একটি বোর্ডও গঠন করা হবে। জনগণের কল্যাণ করাই তাঁর সরকারের লক্ষ্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে লক্ষ্য নিয়েই তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে। উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আজকের বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। পরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শ্রমিক-কৃষক তারা এ দেশের মানুষ। তাদের জন্যই আমার এই রাজনীতি। আমার কাছে দাবি-দাওয়া করার প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই জানি কার কী সমস্যা। আর সে সমস্যাগুলোর কথা চিন্তা করেই আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নেই। জীবন-জীবিকার জন্য সকলকেই কষ্ট করতে হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা কথা মনে রাখতে হবে- এই দেশটা আমাদের। দেশটাকে আমাদের গড়ে তুলতে হবে। দেশটাকে উন্নত করতে হবে। সমৃদ্ধশালী করতে হবে। তবেই সকলে ভাল থাকতে পারবেন। ভবিষ্যত বংশধররা আরও ভাল থাকবে। আমাদের বাংলাদেশ উন্নত হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর আমরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করি। তখন আমরা ৮০০ টাকা থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে ২০১০ সালে এসে আমরা তিন হাজার টাকা ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করে দেই। ২০১৩ সালে সেটা বাড়িয়ে করি পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। আমি নিজে মালিকপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষি করে এটা করেছি। আমি ছিলাম বার্গেনিং এজেন্ট। মালিকপক্ষকে আমরা এই মজুরিতে রাজি করিয়েছিলাম। অবশ্য এজন্য মালিকপক্ষকে আমাদের বিশেষ কিছু সুবিধা দিতে হয়েছিল। কিন্তু সেদিন মালিকপক্ষ আমার কথা রেখেছিলেন।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মোঃ মুজিবুল হক চুন্নুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেনÑ জাতীয় সংসদের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান, আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর শ্রীনিবাস বি রেড্ডি, শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার, শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ, মালিকপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সালাউদ্দিন কাশেম খান প্রমুখ। আলোচনার পর মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।
×