ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাবেক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন

কোন সুযোগ নেই ॥ নিষ্পন্ন মামলার পুনঃশুনানি

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৩ মে ২০১৬

কোন সুযোগ নেই ॥ নিষ্পন্ন মামলার পুনঃশুনানি

বিডিনিউজ ॥ আপীল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া মামলার পুনঃশুনানির সুযোগ নেই বলে মত জানিয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন। অবসরের পর রায় লেখা ‘সংবিধান পরিপন্থী’ বলে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার মন্তব্যের পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা দেড় শতাধিক মামলা পুনঃশুনানির জন্য আপীল বিভাগের কার্যতালিকায় উঠার প্রেক্ষাপটে তিনি এই মত প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের ২০তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে এক বছর আগে অবসরে যাওয়া মোজাম্মেল হোসেন তার সংশ্লিষ্ট মামলাগুলো কার্যতালিকায় আসার আলোকে রবিবার বিডিনিউজকে বলেন, হঠাৎ দেখতে পেলাম যে আদালতের শুনানিতে কিছু মামলা, যেগুলো আগে শুনানি হয়েছে আমার কার্যকালে, পুনঃশুনানির জন্য এসেছে। আমার ভিউ (মত) হচ্ছে যে এই শুনানি আইনগতভাবে সঠিক হচ্ছে না। কারণ পুনঃশুনানির কোন সুযোগ নেই। আমাদের সুপ্রীমকোর্ট রুলসে নেই, সংবিধানেও নেই, আইনেও নেই। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সংক্ষুব্ধ পক্ষ চাইলে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করতে পারেন, বলেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে (জানুয়ারিতে) আমি অবসর গ্রহণ করি। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আমি অন্তত কয়েকশ আদেশ এবং রায়, কিছু আমার লেখা, কিছু আমার কলিগদের (সহকর্মী বিচারপতি) লেখা, সেগুলো আমি সই করেছি। সর্বশেষ বেশ কয়েকটা জাজমেন্ট সিনহা সাহেবের (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) আমি সই করেছি। কাজেই এই প্রশ্ন কখনও আমার সামনে আসে নাই, আসার কারণও ছিল না, যেহেতু এটি প্রচলিত রীতি। আমার পূর্ণাঙ্গ রায়ে উনারা সই করেছেন, উনাদেরগুলো আমিও সই করেছি ডিসেম্বর পর্যন্ত। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি নিজের দায়িত্ব নেয়ার বছর পূর্তিতে এক বাণীতে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, কোন কোন বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন। আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী। আইনবিদদের মধ্যে এ নিয়ে তখন ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করে, যা রাজনৈতিক বিতর্কেও গড়ায়। তুমুল আলোচনার মধ্যে অবসরের পর লেখা নিজের রায় ও আদেশগুলো গত ফেব্রুয়ারিতে ও মার্চে জমা দিয়েছিলেন গত অক্টোবরে অবসরে যাওয়া আপীল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী, যিনি বিচারপতি সিনহার সমালোচক। এরপর গত মাসে একটি মামলায় বিচারপতি সিনহা নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে রায়ে দ্রুত সই করতে বিচারকদের তাগিদ দিয়ে বলা হয়, ব্যতিক্রমী মামলার ক্ষেত্রেও রায় ঘোষণার ছয় মাসের মধ্যে তাতে সই করতে হবে। তারপর বৃহস্পতিবার সুপ্রীমকোর্টের অনলাইনে প্রকাশিত ২ মে’র আপীল বিভাগের দুই বেঞ্চের কার্যতালিকায় দেড় শতাধিক মামলা পুনঃশুনানির জন্য রাখা দেখা যায়। এই দুই বেঞ্চে অন্য বিচারকদের সঙ্গে অবসরে যাওয়া সাবেক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন এবং বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী ছিলেন। সুপ্রীমকোর্টের এক কর্মকর্তা জানান, পুনঃশুনানির জন্য ওঠা ১৬১টি মামলা নিষ্পত্তির বেঞ্চে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী ছিলেন। ৭টিতে বেঞ্চে ছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন। অবসরের পর রায় লেখার বিপক্ষে মত জানানো বিচারপতি সিনহার যুক্তি, বিচারপতি হিসেবে কেউ চাকরি জীবন শেষ করলে তার দায়িত্ব নেয়ার সময় শপথ আর কার্যকর থাকে না। তবে তার সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়েছেন আইনমন্ত্রীসহ আইনজ্ঞদের অনেকে। প্রবীণ আইনপ্রণেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও বিচারপতি সিনহার সঙ্গে অমত জানিয়েছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনও বলেন, অবসরের পর রায় লেখার প্রচলিত রীতিতে কোন নিষেধ নেই। সুপ্রীমকোর্টের একজন আইনজীবী হিসেবে আমার প্রথম জীবনে, পরবর্তীতে বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থান থেকে যতদূর জানতে পেরেছি, শিখতে পেরেছি, এতে (অবসরের পর রায় লেখা) আইনগত কোন অসুবিধা নেই। আমাদের সংবিধানেও কোন রকম নিষেধ নেই, আইনেও নেই। কাজেই এটিই প্রচলিত আইনী রীতি। আমি বলতে পারি, এটি একটি প্রতিষ্ঠিত আইনী রীতি যে বিচারপতিগণ অবসরে যাওয়ার পর সব সময়ই লিখে আসছেন। একাত্তর পর থেকেই এই রীতি চলে আসছে, আমাদের সিনিয়রদেরও দেখেছি। ‘দুঃখজনক’ ॥ রায় ঘোষণার প্রক্রিয়া বিস্তারিত তুলে ধরে পুনঃশুনানির এই উদ্যোগকে ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন। তিনি বলেন, শুনানির পর রায় ঘোষণা হয় ওপেন কোর্টে (প্রকাশ্য আদালতে)। ভারডিক্ট ঘোষণা হয়, ইট হ্যাজ বিন এ্যালাউড অথবা ডিসপোজড অব বা ডিসমিসড। প্রধান বিচারপতি নিজেও রায় লিখতে পারেন, অথবা কোন একজন বিচারপতিকে লেখার জন্য দায়িত্ব দেন। তেমনি বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতি নিজেও রায় লিখতে পারেন অথবা কোন একজন বিচারপতিকে লেখার দায়িত্ব দিতে পারেন। তবে যিনি লিখেন, তার লেখা শেষ হওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ রায়ের ড্রাফট কপি সবচেয়ে জুনিয়র যিনি ওই বেঞ্চে তার কাছে পাঠিয়ে দেন। উনি এটি দেখে তার পরবর্তী উপরে যিনি তার কাছে দেন। ধরেন, পাঁচজন হলে ৫, ৪, ৩, ২ এভাবে সার্কুলেশন হয়ে শেষ হবে। যখন ড্রাফট কপি সবাই দেখে তাতে ইনিশিয়াল দেবেন, অর্থাৎ এ্যাপ্রুভ করলেন। সবার দেখার পর লেখক বিচারপতি যিনি থাকেন, সর্বশেষ যার কাছে যায়, তিনি তা তার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আর যদি অথার জাজ প্রধান বিচারপতি হন, তাহলে এটি তার কাছে এসেই গেল, উনি তা ব্লু কাগজে প্রিন্টের পর নিজে সই করবেন প্রধান বিচারপতি বা প্রিসাইডিং জাজ। স্বাক্ষর করার বেলায় জ্যেষ্ঠতার ক্রম অনুসরণ করা হয়। বিচারপতি মোজাম্মেল বলেন, এরকম আমার পাঁচটি রায় সার্কুলেশনে ছিল। জুনিয়র থেকে সিনিয়র পর্যন্ত মানে যেহেতু আমি অথার জাজ (লেখক বিচারপতি) প্রধান বিচারপতি, সিনহা সাহেব পর্যন্ত গেল, তিনি দেখেও পাঠালেন। পাঠানোর পর সেটি ব্লু প্রিন্ট ফাইনাল প্রিন্ট করে আবার তখনকার প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমি সই দিয়ে উনার ওখানে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তারপর আমি আর জানি না কী হলো? ‘এখন দেখতে পাচ্ছি ওই যে পাঁচটি রায়, যেগুলো পাঁচজন বিচারপতি অথার জাজসহ সবাই এ্যাপ্রুভ করলাম, তাতে আমি সইও করলাম, সেটিও এখন দেখা গেল শুনানিতে এসেছে। এটি দুঃখজনক। কেন হলো ঠিক বুঝতে পারলাম না?
×