ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পান্থ আফজাল

কতদূর এগিয়ে গেল শ্রমিক

প্রকাশিত: ০৪:০০, ৩ মে ২০১৬

কতদূর এগিয়ে গেল শ্রমিক

এদেশের মেহনতী মানুষ গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে ছুটে যায় লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে মাঠে ফসল বুনতে। নিজের সত্তার কথা চিন্তা না করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রক্তকে পানিতে পরিণত করে যারা জীবনের বাঁকে শ্রমের তরীর মাঝি হিসেবে তরীকে তার গন্তব্যে নিয়ে যেতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, সেই সকল মেহনতী মানুষের প্রতীক মহান মে দিবস আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছিল। মহান মে দিবস সারা বিশ্বে পালিত হয় তাৎর্পযপর্ণভাবে। বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারী-বেসরকারী ছাড়াও বিভিন্ন রাজননৈতিক দল ও সংগঠন শ্রমিক সমাবেশের মাধ্যমে এই দিবসটি উদ্যাপন করে। কিন্তু আমরা যদি ইতিহাসের বাঁকে ফিরে দেখি যে অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই মহান মে দিবস সেই সকল মেহনতি শ্রমিকের অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মহান মে দিবস হচ্ছে- পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের বিজয় নিশান। এ কারণে মে দিবস বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের কাছে অত্যন্ত তাৎর্পযর্পূণ। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ আত্মত্যাগের এক বিরাট ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। শিকাগো শহরের ৭টি সংগঠনসহ ২২টি শ্রমিক সংগঠন এদিন মিছিলে নিয়ে ‘হে’ মার্কেটের সামনে সমবেত হতে হয়। তাদের সুমহান আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে স্বীকৃতি পেয়ছে শ্রমের মর্যাদা। শ্রমজীবী মানুষের কাছে ‘সিলভিস’ একটি কিংবদন্তি নাম। সিলভিস ছিলেন লোহা ঢালাই শ্রমিকদের তরুণ নেতা। তার নেতৃত্বে ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন সর্বপ্রথম আমেরিকায় দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি করে। শ্রমিকদের এই ন্যায্য দাবির সঙ্গে সরকার ও মালিক পক্ষ ঐক্যমত না হওয়ায় সমাবেশ বানচাল করতে পুলিশ গুলি চালালে এতে অনেক শ্রমিক নিহত হয়। কিন্তু শ্রমিকরা মরিয়া হয়ে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু ঢেলে দিতে প্রস্তুত তবুও তাদের ন্যায্যা দাবি থেকে এক চুল পরিমাণও পিছপা হতে রাজি নয়। শ্রমিকদের আত্মত্যাগ আর মরিয়া ভাবের নিকট পরাজিত হয় সরকার। অনেক শ্রমিক নিহত হলে মিল মালিকরা তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে মার্কিন সরকার ১ মে কে ‘ল ডে’ হিসেবে ঘোষণা করে। বঞ্চনার মাঝে অধিকার আদায় করে নেয় শ্রমিকরা। তখন থেকেই মে দিবস সকলের নিকট শ্রমিক অধিকার আদায়ে আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। শুধু আমেরিকা আর কানাডা ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই সরকারীভাবে পালিত হয় মে দিবস। ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের সরকারীভাবে পালিত হয় মে দিবস। বাংলাদশে লেবার ফোর্সের সার্ভে অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমিক সংখ্যা ৫ কোটির কাছাকাছি, এর মধ্যে এক চতুর্থাংশ মহিলা শ্রমিক। বাংলাদেশের এই বিশালসংখ্যক শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়নে প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিবছরই আমাদের দেশে মে দিবস পালিত হলেও এদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে যারা সবচেয়ে বড় অংশীদার তাদের অধিকারের কথাগুলো সরকার থেকে শুরু করে আমরা সবাই ভুলে যাই। ফলে মে দিবস আসে, মে দিবস চলে যায় কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়না, জীবন যাত্রার চাকা ঘোরানো এদেশের শ্রমিক সমাজের। আমাদের দেশের শ্রমিকরা বিভিন্ন সেক্টরে তাদের শ্রম দিয়ে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিচ্ছেন। শুধু দেশেই নয় দেশের বাইরেও বিশালসংখ্যক শ্রমিক জনগোষ্ঠী অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য প্রবাসী এ শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। শুধু অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া বললে ভুল হবে তাদের চিত্র আরও ভয়াবহ। ইতোমধ্যে মে দিবস পেরিয়েছে ১৩০ বছর। এত বছর পরও শ্রমিকরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। আজও সমাজে তাদের অধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনও দেশে দেশে শ্রমিক শোষণ চলছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রেখে উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে চায়। এ নিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় দ্বন্দ্ব দেখা যায়। তাছাড়া আমাদের দেশে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ নারী ও শিশু। এসব নারী ও শিশু বিভিন্ন কল-কারখানা, বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে তারা বেশি কাজ করে থাকে। অথচ আমাদের সংবিধানে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। তথাপি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকেই আবার জীবন ঝুঁকির মধ্যেও পড়ে যাচ্ছে। মারাও যাচ্ছে অনেক শ্রমিক। আসলে আমরা শ্রম বা শ্রমিকের মর্যাদা বুঝেও বুঝতে চাই না। একজন মানুষের জীবন ধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাÑ এ সবই একজন শ্রমিকের প্রাপ্য। আর এটাই হচ্ছে শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা। একুশ শতকে এসে শ্রমিকরা এর কতটুকু মর্যাদা বা অধিকার ভোগ করছে? বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। কারণ শ্রমিকরা এ দেশের সম্পদ। তাদের কারণেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। সম্প্রতি সাভার ট্র্যাজেডির দিকে তাকালেই তা সকলের নিকট স্পষ্ট। যাদের ক্লান্তিহীন পরিশ্রমে নিজের ভাগ্য গড়ে মালিক আর সরকার তখন তাদের রাজনৈতিক বলিরপাঠা বানিয়ে মারাত্মক ফাটল ধরা ভবনে জোর করে ঢুকিয়ে কাজে বাধ্য করা হলো। ফলে ভবন বিধ্বস্ত হয়ে প্রায় ৪ শতাধিক শ্রমিককে হত্যা করা হলো। এ যেন ডেকে নিয়ে খুন করা। হাজার খানেকের মতো এখনও নিখোঁজ। এত বড় ঘটনায় শোক পালন হলো কিন্তু রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা হলো না। শ্রমিক বলেই তাদের কোন অধিকার থাকতে নেই। তাদের প্রাপ্য হলো ভবন ধসে কিংবা আগুনে পুড়ে লাশ হওয়া। দেশের ভেতরে যখন এই অবস্থা তখন ভাল নেই দেশের রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালনকারী প্রবাসী শ্রমিকরা। মাঠের ফসলি জমি, গোয়ালের গরু, পুকুরের মাছ, এমনকি নিজরে ভিটেমাটি বিক্রি করে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে গ্রামের সহজ সরল যে শ্রমিকটি জীবন-জীবিকার সন্ধানে, ভাগ্য উন্নয়নে প্রবাসে পাড়ি জমায় তখন দালালদের খপ্পরে পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করে কিংবা বিদেশী দূতাবাসে আশ্রয় গ্রহণ করে জীবন বাঁচানোর প্রার্থনা করে তখন আমাদের দূতাবাসের কর্তা ব্যক্তিরা শ্রমিকদের এই দুর্দশায় যেই পথে শ্রমিকটি দূতাবাসে এসে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে আবার সেই পথেই চলে যেতে বলে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। কারণ এরা তাদের জন্য বোঝা। তারা শুধু অর্থ উপার্জনকারীদের আয়েই দেশীয় রেমিটেন্স বাড়াতে চায় মানবেতর জীবনযাপনকারী এবং বিপদগ্রস্তদের দায় তাদের উপর বর্তায় না। বাংলাদেশের ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার রফতানি আয়ের মধ্যে অধিকাংশ আয় হয় তৈরি পোশাকশিল্পে। অথচ গুরুত্বর্পূণ এই শিল্পের শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। তাদের বোনাসতো দেয়াই হয় না বরং কাজের নির্দিষ্ট বেতনও ঠিকমতো পরিশোধ করে না মালিকপক্ষ। ফলে তাদের বেছে নিতে হয় আন্দোলন। আর শ্রমিকদের এই অসন্তোষের সুযোগ নেয় বিভিন্ন স্বার্থান্বষেী মহল। যারা পার্শ¦বর্তী দেশের বিদেশী বাজার চাঙ্গা রাখতে চায় তারা শ্রমিক অসন্তোষের এই সুযোগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ফলে এক দিকে তৈরি পোশাকশিল্প ধ্বংসের মুখে পড়ে অন্যদিকে শ্রমিক বঞ্চিত হয় বেতন-ভাতা থেকে তারা পরিণত হয় স্বার্থান্বেষী মহলের ক্রীড়নকে। শ্রমজীবী নারীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কর্মরত। এদেরে ওপর বাডির কর্তা, গিন্নী ও অন্যান্য সদস্যের নির্যাতনের যে ভয়াবহ সংবাদ পত্রিকার পাতায় মাঝে মধ্যে প্রকাশিত হয় তা কি এই সমাজের চরম হিংস্র রূপটিই প্রকাশ করে দেয় না? অথচ যারা নির্যাতন করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ‘শিক্ষিত’, ‘ভদ্র’ ও সমাজের চোখে ‘গণ্যমান্য’। তাহলে শিক্ষা ও সভ্যতার বড়াই কি আমাদের সাজে? প্রচলিত শিক্ষা ও বর্তমান সভ্যতা আসলে আমাদের কী দান করেছে? কেন আমরা প্রতিদিন হয়ে উঠছি আগের দিনের চেয়েও হিংস্র? আমাদের নতুন প্রজন্মের হিংস্রতা ও মানসিক অস্থিরতার বিষয়ে কি আমরা সচেতন? আমাদের এই দেশে শতকরা ৮০ ভাগ কৃষকের বাস হলেও কৃষকের অধিকার আজও আমাদের সমাজে অধরাই থেকে গেছে। আজও সারের জন্য, সেচপাম্পের মাধ্যমে জমিতে পানি দেয়ার জন্য বিদ্যুতের দাবিতে কৃষককে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে হয়। যে কৃষক শুধু নিজের জন্য চাষাবাদ করে না, ঝড়, বৃিষ্ট, সাইক্লোন, বন্যা, খরা মোকাবেলা করে দেশের জন্য সম্পদ তৈরিতে জমিতে ফসল বুনে, সেই কৃষক যখন দুঃখ দুর্দশায় পতিত হয় তখন মহান মে দিবসের কথা আমাদের মনে থাকে না, দাঁড়াতে পারি না আমরা সেই কৃষকের পাশে। আমরা সেই কৃষকের পরিশ্রমের মূল্য দিতে জানি না। দ্রব্যমূল্যেরে উর্ধগতিসহ জীবনযাত্রার ব্যয় যখন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তখন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না এদেশের শ্রমিক সমাজের আয়, ফলে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। কেউ একবেলা খেতে পারছে তো অন্য বেলা উপোস থাকছে। মে দিবসের চেতনা এখানকার শ্রমজীবীদের মধ্যে কাজ করছে না। মূলত গ্রাম থেকে আসা নরনারী ও তরুণী শ্রমিক শ্রেণীর যথার্থ চরিত্র প্রকাশে অক্ষম। তরুণীরা যে ধরনের নির্যাতনের শিকার, তার বিরুদ্ধে সমাজের নৈতিক প্রতিবাদ অনুপস্থিত। এর পরিণাম সংহত ইতিবাচক শক্তি প্রকাশের বদলে ভাঙচুরের মতো নেতিবাচক নৈরাজ্যে পরিণত, যা শ্রেণী সংগ্রামের চরিত্রানুগ নয় মোটেই। বাংলাদেশের শ্রমজীবী সমাজে ও শ্রম রাজনীতীতে মে দিবস আসা-যায় একদিনের অনুষ্ঠানের প্রতীক হয়ে। মে দিবসের তাৎপর্য, কোন পত্রেই প্রতিফলিত নয় বলে দিনটি আনুষ্ঠানিকতার বাইরে এক র্অথহীন ‘মার্চপাস্ট’ বলেই আমার মনে হয়। তাতে যে যা খুশি ভাবুন। এটি এক বিরাট দুর্বলতা। পরিণামে শ্রমিক স্বার্থে যেমন যথাযথ মাত্রা অর্জিত হয়নি, তেমনি শ্রমিক আন্দোলন সমাজ বদলের সংগ্রামেও সহায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। শ্রমিক আন্দোলন শ্রমিক নেতাদের বিত্তবান নাগরিক হতে, কাউকে অঢেল সম্পদ ও বৈভবের অধিকারী হতে সাহায্য করেছে। সাধারণ শ্রমিকদের অবস্থার তেমন কোন পরির্বতন ঘটেনি। আমরা মনে করি শুধু শ্রমজীবী সমাজেরই নয়, সমাজের সকল শ্রেণীর নারী ও পুরুষের যেমন রয়েছে জীবিকার অধিকার তেমনি রয়েছে মনুষ্যত্ব অর্জনের অধিকার। সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের কর্তব্য অধীনস্তদের মাঝে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো। ন্যায়-বোধ, সততা ও উদারতা, ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা এবং বিচক্ষণতা মতো মানবীয় গুণাবলীর চর্চা এখন অপরিহার্য।
×