ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

লুকিং ফর দ্য সামার!

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ৩ মে ২০১৬

লুকিং ফর দ্য সামার!

খুব বেশি মন খারাপ হলে লিখতে পারি না। ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। ঠিক কিভাবে কোথা থেকে শুরু করব, আর কিভাবে শেষ করব বুঝে উঠতে পারি না। অনেক দিন পর বিশ্রীরকমের মন খারাপ। লেখা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। একদিকে বাংলাদেশে সিরিজ দিয়ে মৃত্যু। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, পরিকল্পিত হত্যা। তার সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছে সিলিকন ভ্যালিতে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত স্বামী-স্ত্রীর হত্যাকা-, যেখানে মোটামুটি তথ্যের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে, তাদের দুই ছেলেই নিজের মা-বাবাকে গুলী করে হত্যা করেছে। এত বড় শকিং নিউজ সিলিকন ভ্যালির বাংলাদেশী কমিউনিটিতে আগে কখনই ঘটেনি। বাংলাদেশে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ খুন হয়। পত্রিকার পাতায় সবটা আসে না। কিন্তু যেগুলো আসে সেগুলোর দিকে নজর দিলেই দেখা যাবে প্রায় প্রতিটি পাতায় অসংখ্য হত্যাকা-। নামচেনা কাউকে মেরে ফেললে হেডলাইনটা একটু বড় হয়। নইলে ভেতরের পাতায় সিঙ্গেল লাইন শিরোনামে জায়গা হয়। অনেকের ভাগ্যে সেটুকুও জোটে না। কে যে কাকে কখন কেন মেরে ফেলছে, সেটা বোঝাই মুশকিল। বাংলাদেশের যেহেতু আস্থার জায়গাটাতে সঙ্কট আছে, তাই এই মৃত্যুর যে যা ব্যাখ্যা দিক কোনটাই সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। আপনি যদি বলেন ‘ক’, তার পাল্টা উত্তরে ‘খ’ বলার মানুষের অভাব নেই। পুরো বাংলাদেশে বর্তমানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এমন হয়ত হতে পারে, মানুষ নিজেকেও বিশ্বাস করে না। এখানে আপনি যা-ই বলবেন মানুষ ভাবতে থাকে এর পেছনে না জানি কী এক সাঙ্ঘাতিক রহস্য রয়েছে। এই দেশের মানুষ সবকিছুতেই রহস্যের গন্ধ পেতে চায়। এই অভ্যাস হয়ত একদিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন পরাধীনতায় থেকে থেকে মুক্তি পেয়ে তার পরের মিথ্যাচারের রাজনীতি আমাদের মনকে নষ্ট করে দিয়েছে। আমাদের ব্রেনকে পাল্টে ফেলেছে। আমাদের লজিক জ্ঞান নষ্ট হয়ে গেছে। যদি এখন কেউ এসে বলে, কোন এক মন্ত্রীর ছেলে বা মেয়ে বিমানবন্দর দিয়ে এক হাজার কোটি টাকা স্যুটকেসে ভরে নিয়ে গেছে, এই দেশের অনেক মানুষ বিশ্বাস করবে। এক হাজার কোটি টাকা ভরতে কত স্যুটকেস লাগবে, তার ওজন কত হবে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তার কী হবে, বিদেশে যেখানে বিমান নামবে সেখানকার কাস্টমস এটাকে কিভাবে দেখবে- এগুলো কিছুই চিন্তা করবে না। এই দেশের মানুষের বড় একটা অংশ ভাববে, এটা কোন ব্যাপার হলো? সব ম্যানেজ করা যায়! একটি জাতীয় দৈনিকের জনৈক সম্পাদকের এক বক্তৃতার রেশ ধরে জনৈক বন্ধু গতকাল ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘চারপাশে যে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে তা দূর করার ক্ষমতা শিল্প-সংস্কৃতির নেই। যে শিল্প-সংস্কৃতি আমাদের আছে তা এতই বিভাজিত, এতই ক্ষমতাকেন্দ্রিক, বর্ণবাদী, অকার্যকর, গুরুত্বহীন, অচল ও বাতিল যে, এর আলো দূরের কথা, ফ্লাডলাইট জ্বালিয়েও ঘনীভূত ও ঘনায়মান অন্ধকার দূর করা সম্ভব নয়। সমাজে মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। সন্দেহ, অবিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যা, প্রতারণা, বঞ্চনা, লুটপাট, অন্যায়, শঠতা, অবিচার সমাজের স্তরে স্তরে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের অন্তঃসারশূন্য, ভঙ্গিসর্বস্ব, ভাসমান তাবত শিল্প-সংস্কৃতি যদি ফ্লাডলাইট জ্বালিয়েও বসে থাকে, তারপরও অন্ধকার দূর হওয়ার সামান্য সম্ভাবনাও নেই। বরং নাগরিকদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের বিশ্বাস, আস্থা, পরিচয়, মূল্যায়ন, সম্মান ও ন্যায়বোধের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আরও মিনিংফুল কাজ করা দরকার।’ বাংলাদেশে এখন আর সুস্থ ধারার সমালোচনা কিংবা আলোচনার সুযোগ নেই। তাই আমি কারও নামই প্রকাশ করছি না। যে দেশে নাগরিকদের পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস বা আস্থা নেই, সেই দেশে জীবনযাপন কেমন? বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হ্যাকিং নিয়ে উত্তাল হলো দেশ, বাঁশখালীতে গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে আরও উত্তাল দেশের মানুষ, তনু হত্যার রেশ তখনও কাটেনি, একজন সম্পাদককে গ্রেফতার করা নিয়ে পুরো দেশ ব্যস্ত থাকল সপ্তাহখানেক, সেই রেশের তাপ না ফুরাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খুন, তারপর আরও, আরও এবং আরও... চলছেই প্রতিনিয়ত। এখন সবাই ব্যস্ত জুলহাসকে নিয়ে। এই উত্তাপ শেষ না হতেই সুন্দরবনে আগুনের উত্তাপ পেতে শুরু করেছে এই দেশের মানুষ। হোয়াট এ হ্যাপেনিং পেস! তারপর নিশ্চয়ই নতুন আরেকটা বিষয় চলে আসবে। কিন্তু এই যে এত ঘটনা, কেউ কি বিশ্বাস করছে কাউকে? না, এই দেশে বিশ্বাসের মা’র মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। এই যখন মনের অবস্থা তখন এসে নতুন করে যোগ হয়েছে গোলাম রাব্বানী পরিবারের হত্যা সংবাদ। গোলাম রাব্বানী পরিবারকে আর বাংলাদেশী পরিবার বলা যাবে না। তারা দীর্ঘ দিন আগেই আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়ে ওখানে বসবাস করছিলেন। তাদের দুটি ছেলেই আমেরিকান। তবুও তাদের মৃত্যু এসে আমাদের আক্রান্ত করে কেন? যখন শুনলাম স্যান হোজে শহরের এভারগ্রীন এলাকায় নিজ বাড়িতে তারা খুন হয়েছেন, তখন পুরো শরীর কেঁপে উঠেছিল। তারপর যখন পুলিশের তথ্য প্রকাশ পেতে শুরু করল, হাত-পা ঠা-া হবার যোগাড়। নিজের দুই ছেলেকেই সন্দেহ করা হচ্ছে। তাদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা বলতে পারি, যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে তারা সত্যিই কি তাদের মা-বাবাকে গুলি করে মেরেছে কি না, তা নিশ্চিত হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। তবে এখন পর্যন্ত পুলিশের কাছ থেকে যেটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তা ভয়াবহ। দুই ভাই পুলিশকে দুই রকম তথ্য দিয়েছে। বড় ভাই (যার বয়স মাত্র ২২) বলেছে, কেউ একজন তাদের বাড়িতে প্রবেশ করেছিল এবং সে তার বাবাকে গুলি করতে বলেছিল। সে তার বাবাকে গুলি করে। আর সেই অনুপ্রবেশকারী লোকটি তার মাকে গুলি করে। আর ছোট ভাই (যার বয়স মাত্র ১৭) বলেছে, তার বড় ভাই নিজেই ১২টি গুলি করেছে তার বাবাকে। তারপর নিজের মাকে মাথায় গুলি করে। তারপর বড় ভাই ছোট ভাইকে দেখতে বলে রক্ত বাইরে গড়িয়ে গিয়েছে কিনা। জানালার পর্দা টেনে দিতে বলে। গ্যারেজে মা-বাবার লাশ রেখে তারা দুই ভাই মিলে পাশের শহর ওকল্যান্ডে একটি শো দেখতে যায়। পুলিশ সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বলেছে, তাদের আচরণ ছিল খুব স্বাভাবিক। বড় ছেলেটি মিডিয়াকে বলেছে, তার ছোট ভাই নির্দোষ। তবে সে নিজেও চায় পুরো ঘটনা সবাই জানুক। তবে আইনজীবী ছাড়া সে এখনই কিছু বলতে চাইছে না। বাড়িতে যে চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল সেটাও এই দুই ভাইয়ের লেখা। প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়েছিল যে, মুসলমান পরিবারের ওপর স্থানীয় কেউ আক্রমণ করেছে। ওখানকার পুলিশ এবং সাংবাদিক উভয়পক্ষই অনেক বেশি পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে। পুলিশ তদন্তের স্বার্থে সবকিছু সঙ্গে সঙ্গেই প্রকাশ করেনি। তারা বড় ছেলেকে খুঁজতে থাকে। তাকে গ্রেফতার করে আইনের হাতে দিয়ে তারপর কিছু তথ্য প্রকাশ করতে থাকে। এখন পর্যন্ত যে তথ্য সবাইকে জানানো হয়েছে এবং দুই ভাই মিডিয়াকে যে তথ্য দিয়েছে তাতে তাদের জড়িত থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তবে, দুটি বিষয় এখানে উল্লেখ করে আপাতত লেখাটি শেষ করি। প্রাথমিকভাবে যখন সংবাদ আসে যে, একটি মুসলিম পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই কারা যেন নিজ বাড়িতে হত্যা করে রেখে গেছে- সেই সংবাদটির প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়ঙ্কর। সবাই ধরে নিয়েছিল যে, স্থানীয় কোন উগ্রবাদী মানুষ এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে। বাংলাদেশ থেকেও একইরকম প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়েছিল। তাকে বাংলাদেশী দাবি করে হত্যাকারীদের বিচার দাবি করা হয়। আমেরিকাতে এই ধরনের হত্যার বিচার হবে- সেটা সেই দেশের মানুষ ভাল করেই জানে। তবে ভয়ঙ্কর যে বিষয়টি তাহলো সেই সংবাদের নিচে মানুষের মন্তব্য। অসংখ্য মানুষ সেই হত্যাকা-কে সমর্থন করেছে। অর্থাৎ, অনেক মানুষ ভেতরে ভেতরে এই ধরনের জিনিস চাইছে। তারা মনে করছে, একজন মুসলিম পরিবারকে এভাবে মেরে ফেলা যায়। তারা মনে করছে, মুসলিমরা আমেরিকাতে ঝামেলা তৈরি করছে। তারই হয়তো কিছু বহির্প্রকাশ দেখা যাচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী পালে। কিন্তু আমেরিকার মতো স্বাধীন মত প্রকাশের দেশে যখন এমন হত্যাকা-কে অসংখ্য মানুষ সমর্থন দিচ্ছে, তারপর পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে ভেবে আমার শরীর ঠা-া হয়ে আসছে। আমরা সবাই জানি, আমেরিকাতে যে কেউ দোকান থেকে অস্ত্র কিনতে পারে। নিজের নিরাপত্তার জন্য সেই অস্ত্র ব্যবহারও করতে পারে। তাই আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে গোলাগুলি এবং নিরীহ মানুষের প্রাণহানির খবর আমরা প্রায়ই শুনি। কিন্তু সেটা যদি হয়ে ওঠে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাহলে হবে খুবই বিশ্রী ধরনের। তবে এটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, আমেরিকার জনগণের বড় একটা অংশ মুসলমানদের আর ভাল চোখে দেখছে না এবং এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে দাবি করা হয়েছিল যে, খুনীদের শীঘ্রই ধরে বিচারের আওতায় আনা হোক। ওখানকার পুলিশ দুদিনের ভেতরই সন্দেহভাজনদের ধরে আইনের আওতায় এনে দিয়েছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে, বাংলাদেশ থেকে দাবি তোলা হয়েছে বলেই পুলিশ এমন করিৎকর্মা। ওখানকার পুলিশ এভাবেই কাজ করে এবং পুলিশের ওপর সেই দেশের মানুষের আস্থা অনেকটা আছে বলে নিশ্চিত বলা যায়। তাই ওখানকার পুলিশ যখন কোন তথ্য প্রকাশ করে তা নিয়ে জনমানুষের মাঝে কোন সন্দেহ তৈরি হয় না। তাই পুলিশ যখন দুই ভাইকে ধরে এনে কোর্টে চালান করে মানুষ বিশ্বাস করে যে, এই ভাই-ই মূল আসামি। কিন্তু এই ঘটনায় পুরো বিষয়টা ভিন্ন দিকে মোড় নিয়ে ফেলে। দুই ভাই তার নিজের মা-বাবাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে! এবং তারা বাংলাদেশ থেকে আগত। আমেরিকাতে বাংলাদেশীদের নিয়ে খুব যে মাতামাতি হয় তা নয়। কিন্তু এই ঘটনার পর বাংলাদেশ হেডলাইনে চলে আসে এবং এটাকে আবার অনেকেই পছন্দ করছেন না। তাদের অনেকেই এখন বলার চেষ্টা করছেন, এরা তো বাংলাদেশী নয়, আমেরিকান। আমরা অনেকেই ওই পরিবারকে এখন ডিসওন করতে শুরু করেছি। এটাই হলো বাঙালীর চরিত্র। কেউ যদি নোবেল প্রাইজ পায় তখন তার বাড়ির বিড়ালটির সঙ্গে পর্যন্ত আমরা সম্পর্ক রাখতে চাই। আর যে মুহূর্তে বুঝতে পারলাম নোবেল প্রাইজটি পায়নি, তখনই তাকে ডিসওন করতে শুরু করি। কাউকে ডিসওন করার কালচার বাঙালীর নতুন নয়। এটা আমাদের রক্তে আছে। নইলে স্বাধীনতা নিয়ে আমাদের এত কনফিউশন তৈরি করব কেন? ঘোলা পানি তো আমরাই তৈরি করেছি। বিদেশীরা তো এসে করে দিয়ে যায়নি। তবে আমার মাথা কাজ করছে না ভিন্ন কারণে। দুটি সন্তান কিভাবে তার মা-বাবাকে মেরে ফেলতে পারে? বাংলাদেশে ঐশী নামের এক মেয়ে একই কাজ করেছিল। সেটা এখনও ভেবে আমি হারিয়ে যাই। আমার ব্রেন কাজ করে না। এতদিন পর আবারও তাই হলো! আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কী এমন হতে পারে যার জন্য মা-বাবাকে মেরে ফেলতে হবে? বিষয়টি নিয়ে আমি কথা বলেছি সিলিকন ভ্যালির বেশকিছু বাংলাদেশীর সঙ্গে। তাদের কথা থেকে যেটুকু মনে হয়েছে তাহলো এখন পর্যন্ত যেটুকু বোঝা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে মা-বাবার সঙ্গে ছেলেদের জীবনযাত্রার দূরত্ব। চিন্তার দূরত্ব, ভাবনার দূরত্ব, বিশ্বাসের দূরত্ব, জীবনযাপনের দূরত্ব, দুই জেনারেশনের দূরত্ব। এগুলোর বেশিরভাগটাই কল্পনা। আমরা এখনও অপেক্ষা করছি, ছেলেরা বিচারকের সামনে গিয়ে কী বক্তব্য দেয় সেটা দেখার জন্য। তখন পুরো বিষয়টি বুঝা যাবে। তার আগে অনুমান করে কারও সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু বলা ঠিক হবে না। তবে বড় ছেলে যেহেতু বলেছে সে ঘটনার সঙ্গে জড়িত- এটুকু তথ্যের ওপর নির্ভর করেই লিখছি। ছোট ছেলেটির বক্তব্যও নজরে আসার মতো। তার বড় ভাই যেভাবে খুন করেছে সেটা সে দেখেছে এবং বাড়ির পর্দা নামিয়ে দিয়েছে। গ্যারেজের দরজার নিচ দিয়ে রক্ত বাইরে চলে গিয়েছে কিনা দেখেছে। দেয়ালে ম্যাসেস লিখেছে। তারপর বড় ভাইয়ের সঙ্গে কমিক শো দেখতে গিয়েছে। সে কোন কিছুর প্রতিবাদ করেনি এবং ভয়ও পায়নি। মা-বাবার এই মৃতুকে সে সহজভাবেই নিয়েছে। এর অর্থ হলো, সে নিজেও মা-বাবার ওপর প্রচ- ক্ষিপ্ত ছিল। কিন্তু কেন এই দূরত্ব? রাব্বী পরিবার ধার্মিক ছিলেন। তারা প্রচুর দান করতেন। মানুষকে করতেন সাহায্য। মানুষ হিসেবে সবাই তাদের পছন্দ করত। আশপাশের পড়শি থেকে শুরু করে মসজিদের ঈমাম পর্যন্ত। কেউ অপছন্দ করতেন এমনটা শোনা যায়নি। কিন্তু সমস্যা ছিল তার পরিবারের ভেতরে। সন্তানদের জন্ম হয়েছে আমেরিকায়, ভিন্ন কালচারে তারা বেড়ে উঠেছে, যা ওখানকার জন্য স্বাভাবিক। আমরা যারা জীবনজীবিকা এবং সাফল্যের জন্য ভিন দেশে গিয়েছি তার বড় একটি অংশ সেই দেশের কালচারের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি। সৌদি আরবে গিয়ে যেমন কেউ অন্য ধর্ম পালন করতে পারবে বলে আশা করতে পারে না; কিন্তু আমেরিকাতে সেটা পারে। যে কেউ তার নিজের ধর্মকে পালন করার স্বাধীনতা রাষ্ট্র দিয়ে থাকে। কিন্তু কালচার? সেটা তো দেয়াল দিয়ে আটকে রাখা যায় না। ঘরে একরকম, আর ক্লাসে আরেক রকম- এই দ্বৈত পরিবেশ শিশু-কিশোরদের কনফিউজ করবে এটাই স্বাভাবিক। বড়দেরও কত কনফিউজ করে। এই ঘটনার পর নিজের বয়সের কথা খুব মনে হচ্ছে। আমি নিজেও খুব একরোখা টাইপের মানুষ। যতক্ষণ হাসিখুশি ততক্ষণ ঠিক আছি। বলতে পারেন, ইজি গোয়িং। কিন্তু কোথাও বেঁকে বসলে সেটা আমাকে দিয়ে করানো প্রায় অসম্ভব। মা-বাবার খুব বাধ্য ছিলাম সেটা বলা যাবে না। নিজের মতামতকেই বেশি প্রাধান্য দিতাম। কৈশোর ও যৌবনের শুরুতে হয়ত এটাই মানুষ করে। তখন মনে হতো ওটাই ঠিক। মা-বাবা যা বলছেন সেটা সঠিক নয় কিংবা পুরনো। মা-বাবার সঙ্গে কত কনফ্লিক্ট ছিল। কত রাত ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। কতবার বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাব ভেবেছি। সেই কনফ্লিক্ট আমৃত্যু ছিল। মা-বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অনেক আগেই। কিন্তু এখন তো বুঝতে পারি, তারা থাকলে কিছু একটু করতে পারলেই যেন নিজে খুশি হয়ে যেতাম। সেই শত কনফ্লিক্টের পরও কি একটিবারের জন্য মা-বাবার মৃত্যু চেয়েছি? তাও আবার নিজেই তাদের মেরে ফেলব সেটা কি কল্পনাতেও এসেছে কখনও? কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, আমার নিজের সন্তানরাই আমাদের মেরে ফেলবে। মৃত্যু একদিন হবে সেটা আমি ভাল করে জানি। আমি আর কতদিন বাঁচতে পারি তারও একটা মোটামুটি প্রস্তুতি আমার আছে। তাই এটা নিয়ে আমি ততটা চিন্তিত নই। কিন্তু তাই বলে নিজের সন্তানের হাতে মৃত্যু! আমাদের চারপাশে যত অপকা- হচ্ছে, যত মৃত্যু হচ্ছে তা দিনকে দিন গা সয়ে যাচ্ছে। মোটামুটি একটি মৃত্যুপুরীতে বসবাস আমাদের। কিন্তু তার সবই আমার ভাবনাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে, যখন ওই ছেলে দুটির ছবি আমি দেখতে পাই। হোয়াট এ ওয়ার্ল্ড আই এ্যাম ইন! প্রচ- গরমে পুড়ছে বাংলাদেশ। কিন্তু সেই গরমকেও ছাপিয়ে আমার গায়ে লাগতে শুরু করেছে বাড়তি অস্বস্তি। এ কোন্ পৃথিবীর দিকে এগোচ্ছি আমরা? আর ভাবতে পারছি না। শুধু আশা করছি একদিন এই জঘন্য পরিস্থিতি কেটে যাবে। তাই কানে হেডফোন লাগিয়ে শুনছি ক্রিস রিয়ার একটি বিখ্যাত গান- ‘লুকিং ফর দ্য সামার! আই এ্যাম স্টিল লুকিং ...’। একবার নয়, বারবার শুনছি আর মনে মনে বলছি, মুক্তি হোক মানুষের চিন্তার, ফিরে আসুক পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, কমে আসুক দূরত্বÑ পরিবারে, বন্ধুত্বে, সমাজে, রাজনীতিতে, জীবনে- কোন এক গ্রীষ্মে! ১ মে, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ [email protected]
×