ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চাঁপাই ও রাজশাহীর আম লিচু ঝরে পড়ছে খরায়

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১ মে ২০১৬

চাঁপাই ও রাজশাহীর আম লিচু ঝরে পড়ছে খরায়

ডি.এম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ প্রচ- দাবদাহে তপ্ত ধরণী। এই দহনের সঙ্গে যোগ হয়েছে লু-হাওয়া। এই দুই তপ্ত দহনে গৌড়ীয় বরেন্দ্রর মাটি ফেটে একেবারে চৌচির। খরতাপে রুক্ষপ্রকৃতির ভয়াল থাবায় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন আমচাষীরা। উত্তরের আর্থিক প্রাণকেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফলের ওপর খরার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে আম ও লিচু বাগান বৈশাখের গনগনে আগুনে একেবারে নাস্তানাবুদ। ঝরে পড়ছে ফল। বেশ কয়েক বছর ধরেই মনুষ্য সৃষ্ট কেমিক্যাল আক্রমণে বিপর্যস্ত ও পুঁজিহারা আম ব্যবসায়ীরা এবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে খরার দহন সে স্বপ্ন ইতোমধ্যেই চুরমার করে দিয়ে গেছে। খরার বিপর্যয় আরও সপ্তাহ খানেক অব্যাহত থাকলে আম ব্যবসায়ীরা কয়েক যুগের মতো একেবারে পুঁজিহারা হয়ে পথে বসবে। দেশের একমাত্র বৃহত্তম আম সাম্রাজ্য চাঁপাইয়ে খরার এই মহাদুর্যোগকে তুলনা করা চলে যে কোন ল-ভ- করা সুনামির সাথে। প্রকৃতির রুদ্র দহনে প্রতিদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী মিলে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলে ৫০ টনের অধিক আমের গুটি ঝরে পড়ছে, যার পরিমাণ ইতোমধ্যেই কয়েক হাজার টনের কাছাকাছি পৌঁছেছে। রাত-দিন মিলিয়ে বৃষ্টির ফোঁটার মতো গুটি ঝরে পড়ছে বাগানে। জেলায় এবার প্রায় ২৬ হাজার হেক্টরে আমের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। একই ভাবে চাঁপাই সংলগ্ন রাজশাহী অঞ্চলের ১৬ হাজার হেক্টরে ডালপালা ভেঙ্গে যে আমের উৎপাদন লক্ষ্য করা গিয়েছিল তা এখন ঝরে পড়ছে সমান তালে। একই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে লিচু ব্যবসায়ীরা। লিচু উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এলাকা হয়ে উঠেছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী অঞ্চল। প্রাকৃতিক কারণেই এই অঞ্চলের লিচু গাছে এবার ফুল এসেছিল তুলনামূলক কম। জেলায় ২৫০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হচ্ছে। কিন্তু খরায় ঝরে পড়ার কারণে উৎপাদন বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা শিবগঞ্জে সব চেয়ে উন্নত জাতের লিচুর চাষ হয়ে থাকে। কিন্তু চলমান দাবদাহে ঝরে পড়ছে লিচু। ঝরে পড়া আমের গুটির চাহিদা থাকলেও ছোট ছোট কাঁচা লিচুর কোন চাহিদা বা মূল্য নেই। ব্যবসায়ীরা বলছে, গত দুই সপ্তাহে প্রায় অর্ধেক লিচু ঝরে পড়েছে। এতে তারা ব্যাপক লোকসানের আশঙ্কা করছে। একটি মহল অভিমত দিয়েছে ইতোমধ্যেই চাঁপাই ও রাজশাহী অঞ্চলে প্রায় শত কোটি টাকার লিচু ঝরে পড়ে নষ্ট হয়েছে। যারা লিচু বাগান কিনেছিল তাদের অর্ধেক পুঁজি ইতোমধ্যেই খোয়া গেছে। শিবগঞ্জের লাল মোহাম্মদ জানান, অনেক আশায় এক লাখ টাকা দিয়ে একটি ছোট লিচু বাগান কিনেছিলাম। খরায় সেই লিচু বাগান থেকে ২৫ হাজার টাকা উঠে আসবে কিনা এখন সেই আশঙ্কার মধ্যে রয়েছি। কারণ এখনও বৃষ্টির দেখা নেই। অনুরূপ বড় ধরনের বিপর্যয় গ্রাস করেছে জেলার প্রায় সাড়ে সাত হাজার বড় আম বাগানকে। জেলার অধিকাংশ বড় আম বাগানের অবস্থান সদরসহ শিবগঞ্জ, ভোলাহাট ও গোমস্তাপুর উপজেলায়। এসব আম বাগানে সিংহভাগ গাছের বয়স শত বছর পেরিয়ে গেছে। বিশেষ করে জেলায় ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, খিরসাপাত, বোম্বাই, লক্ষণভোগ গাছের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখের কাছাকাছি। উন্নত অচেনা গুটিজাত গাছের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এসব শতাব্দী প্রাচিন বড় বড় আমগাছের অবস্থান পদ্মা, পাগলা ও মহানন্দা বিধৌত অঞ্চলে। এবার দীর্ঘ খরায় মহানন্দা ও পদ্মার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ও পাগলা একেবারে পানিশূন্য হয়ে পড়াতে এসব পুরনো গাছের শিকড় পানির নাগাল পাচ্ছে না। ফলে এসব গাছ পানি সরবরাহ করতে পারছে না গাছের ডগা পর্যন্ত। ফলে আমের গুটি পানি পাচ্ছে না। শুকিয়ে যাচ্ছে বোঁটা। খরার কারণে বোঁটা শুকিয়ে যাওয়া আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে। মূল কারণ হচ্ছে প্রধান নদীগুলো পানিশূন্য হবার কারণে নেমে যাচ্ছে ভূর্গস্থ পানির স্তর। ফলে আমগাছের শিকড় নাগাল পাচ্ছে না ভূগর্ভস্থ পানির। ফলে পুরো গাছে বা ডগা পর্যন্ত পানি সরবরাহ করতে পারছে না এসব আম গাছ। প্রচ- সূর্যতাপে এমনিতেই গুটি ঝরে যাচ্ছে। একাধিক কৃষিবিদের অভিমত- বড় বড় আম বাগানে সেচ দেবার কোন ব্যবস্থা না থাকায় গুটি ঝরার হার খুবই বেশি। বিশেষ করে খা খা বরেন্দ্র ভূমি গোমস্তাপুর অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি এলাকায় পানির স্তর দেড় শ’ ফুট নিচে নেমে গেছে। কোন ধরনের পাম্প মেশিনেও পানি আসছে না। এমনকি গভীর নলকূপেও যে পানি আসছে তা চাহিদার চতুর্থাংশ। আম ও লিচু চাষীরা খরা মোকাবেলা করতে না পেরে দৌড়ে যাচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণে। তাদের একমাত্র পরামর্শ গাছের গোড়ায় পানি দেয়ার পাশাপাশি পাতা ও ফলের ডগাতে পানি স্প্রে করার। কিন্তু ২২ লাখের অধিক আমগাছে কৃষক কিভাবে সেচ ও স্প্রে করবে। বিশেষ করে শতাব্দী উৎরে যাওয়া প্রায় ৭ লাখ আমগাছে স্প্রে করার মতো প্রযুক্তি কৃষকের হাতে নেই। অনুরূপভাবে লিচু গাছেও সেচ ও পানি স্প্রে করার মতো কোন সহজ প্রযুক্তি কাছে নেই। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত কৃষি সম্প্রসারণের কাছে খরার কারণে আম ও লিচুর ক্ষতির কোন পরিসংখ্যান নেই। তারা কৃষকদের কোন ধরনের সহযোগিতা দিতে পারছে না। এই অসহায়ত্বের চিত্র চাঁপাই ও রাজশাহীর সর্বত্র। তবে নানাভাবে কৃষকদের সাথে কথা বলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ ও কৃষিবিদদের ধারণা ইতোমধ্যেই মোট উৎপাদনের অর্ধেক আম ও লিচু ফল ঝরে পড়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ইতোমধ্যেই পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে তাদের ধারণা। এই ক্ষতি কোনভাবেই এই মুহূর্তে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। শিবগঞ্জ এলাকার একাধিক আম চাষীর সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি (আংশিক) তারা (সহস্রাধিক চাষী) প্রায় ১৫০ কোটি টাকার আম বাগান কিনেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে সেচ দিতে পারলেও কিংবা বৃষ্টি হলেও অর্ধেক পুঁজি উঠে আসতে পারত। কিন্তু প্রতিদিন বাড়ছে ক্ষতির পরিমাণ। একই ধরনের অভিমত পাওয়া গেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, ভোলাহাট, গোমস্তাপুর, রাজশাহীর চারঘাট, গোদাগাড়ী, পুঠিয়াসহ একাধিক উপজেলায় আমচাষীদের কাছ থেকে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এতদিন আম ও লিচু ভিত্তিক যেসব তথ্য দিয়ে এসেছে তা অনুমানের ওপর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষ সম্প্রসারণ বিভাগের বিভাগীয় জনৈক কর্মকর্তা জানান, দেশের একমাত্র অর্থকরী ফল আমের উৎপাদনসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যন তৈরির জনবল তাদের হাতে নেই। এমনকি চাঁপাইনবাবগঞ্জে যে আম গবেষণাগার হয়েছিল তা বিলুপ্ত হয়েছে গোপনে, কয়েক বছর আগে। তা এখন রূপান্তরিত করা হয়েছে “আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রে। এখানে বেশ কিছু গবেষক থাকলেও নেই গবেষনণাগার। এরা মাঝে মধ্যে স্থানীয় প্রচলিত জাতকে উন্নত জাতের নামে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে নিজেদের গবেষক হবার ঘোষণা দিয়ে থাকে। অথচ চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম সম্পদকে বা আম সাম্রাজ্যকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা খরা নামে প্রচলিত তা নিরসনে কোন কাজ করছে না। ফলে এখানকার আমচাষীরা নিজেরাই গবেষক সেজে যে অবদান রাখছেন তার বাইরে আধুনিক কোন কর্ম উদ্যোগ নেই। তাই এই অঞ্চলের এই মুহূর্তের দাবিÑ চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম গবেষণা নামের প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় চালু করা হোক। যাতে এখানকার আমচাষীরা ভাবতে পারে তাদের জন্য কিছু করা হচ্ছে। বিশেষ করে এখন পর্যন্ত এখানকার আমচাষের উন্নয়নে দৃশ্যমান কিছু করা হয়নি। উপরন্তু নানান জাতের ভারতীয় কেমিক্যাল আগ্রাসন ও ভূ-গর্ভস্থ পানি নেমে যাওয়ায় প্রতিটি আম বাগানে গাছ শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। গত এক যুগ ধরে আমের গাছ মরা পরিস্থিতি রুখে দিতে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক যুগের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমশূন্য এলাকায় পরিণত হবে। এই আশঙ্কা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কৃষি সম্প্রসারণ ও কৃষি গবেষণা কাজে নিয়োজিত একাধিক কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষিবিদের।
×