ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জিএসপির পর আইএস নিয়ে চাপে রাখার কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১ মে ২০১৬

জিএসপির পর আইএস নিয়ে চাপে রাখার কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের

তৌহিদুর রহমান ॥ ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) ইস্যু কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমদিকে জিএসপি নিয়ে প্রবলভাবে বাংলাদেশকে চাপে রাখতে চাইলেও বর্তমানে আইএস ইস্যুকেই প্রাধান্য দিচ্ছে দেশটি। জিএসপি ইস্যুটিকে দেশটি রাজনৈতিকভাবে নিয়েছে বলে মনে করে বাংলাদেশ। আর আইএস নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকলে, তা সরবরাহ করতে অনুরোধ জানালেও সুনির্দিষ্টভাবে এখনও কোন তথ্য দিতে পারেনি দেশটি। এদিকে সম্প্রতি বিভিন্ন হত্যাকা-ের পর বাংলাদেশ পরিস্থিতি বেশ জটিল বলে অভিহিত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভৌগোলিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল অঞ্চলে ভারত ও চীনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশের দিকেই দেশটির নজর বেশি। সে কারণে বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশকে চাপে রাখতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একের পর এক বিভিন্ন শর্ত পালন করা হলেও জিএসপি সুবিধা না পাওয়ায় ইতোমধ্যেই দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। আর মধ্যপ্রাচ্যে আইএস উত্থানের পর থেকেই দেশটি অভিযোগ করে আসছে এখানে তাদের অস্তিত্ব রয়েছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর প্রথমদিকে জিএসপি ইস্যুতে চাপে রাখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে সরকার থেকে জিএসপি ইস্যুকে খুব একটা প্রাধান্য না দেয়ায় এখন আইএস ইস্যু সামনে নিয়ে এসেছে বিশ্বের প্রবল প্রভাবশালী এ দেশটি। বাংলাদেশে লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা, বিদেশী নাগরিকসহ বিভিন্ন ব্যক্তি হত্যাকা-ের শিকার হওয়ায় দেশটি অভিযোগ করে আসছে বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব রয়েছে। তবে সরকার থেকে বারবার এ অভিযোগ অস্বীকার করা হচ্ছে। এমনকি সরকার মনে করে বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব স্বীকার করার জন্য দেশটি বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে আসছে। জিএসপি ও আইএস ইস্যুতে বাংলাদেশকে চাপে রাখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন কৌশল নিয়েছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বন্ধ করে দেয়। এরপর বাংলাদেশকে শর্ত দেয়া হয়, জিএসপি পেতে হলে ১৬টি শর্ত পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ধীরে ধীরে সকল শর্তই পূরণ করে। এসব শর্ত পূরণে বাংলাদেশের প্রশংসাও করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে তারপরও জিএসপি সুবিধা পায়নি বাংলাদেশ। জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে সরকার প্রথমদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যায়। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বারবার ১৬ শর্ত পূরণের জন্য তাগিদ দেয় দেশটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশ্বস্ত করেছিল, এসব শর্ত পুরোপুরিভাবে পালন করলে জিএসপি সুবিধা বহাল হবে। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা আর বহাল হয়নি। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১২২টি দেশের পণ্যে জিএসপি নবায়ন করা হলেও সে তালিকায় আসেনি বাংলাদেশ। শর্ত পূরণের পরে জিএসপি সুবিধা বহাল না হওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, জিএসপি ইস্যুকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা বন্ধের বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, রোজ কেয়ামত পর্যন্ত শর্ত পূরণ করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেবে বলে মনে হয় না। তারা নতুন নতুন শর্ত দিতেই থাকবে। তাই জিএসপি নিয়ে যত কম ভাবা যায় ততই ভাল। জিএসপি সুবিধা বহালে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। রানা প্লাজা ধসের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনাকাক্সিক্ষতভাবে জিএসপি সুবিধা বন্ধ করে দেয়। জিএসপি ফিরে পেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া সব শর্তই পূরণ করেছি। জিএসপি ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্যকে অবশ্য অস্বীকার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেছেন, তার দেশে বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা দেয়া না দেয়ার পেছনে কোন রাজনৈতিক কারণ জড়িত নয়। জিএসপি সুবিধা পেতে পারে বাংলাদেশ, এজন্য ১৬টি শর্ত পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিয়ত অভিযোগ করতে থাকায়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেশটির কাছে থাকা এ বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বলেছিল, আইএস বিষয়ে বাংলাদেশকে তথ্য দেবে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার বললেও এখনও কোন ধরনের সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্যে আইএস উত্থানের পর প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশেই সংগঠনটি তাদের ঘাঁটি গাড়তে চায়। সে অনুযায়ী বাংলাদেশকেও টার্গেট করেছে আইএস। তবে বাংলাদেশ সরকার থেকে বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশে আইএসের কোন সাংগঠনিক অস্তিত্ব নেই। এখানে তাদের কোন ঘাঁটিও নেই। তবে বাংলাদেশে তাদের কোন অনুসারী থাকতে পারে। তাদের অনুসারী থাকলেও কোনভাবেই বাংলাদেশে আইএসের ঘাঁটি গাড়তে দেবে না সরকার। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারের জঙ্গীবাদবিরোধী অবস্থান দেশে-বিদেশে প্রশংসিতও হয়েছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সরকারের এই জঙ্গীবাদবিরোধী নীতিকে বিভিন্ন সময় প্রশংসা করেছে। তবে এসব সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার অভিযোগ করে আসছে, বাংলাদেশে আইএস রয়েছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইএসের অস্তিত্ব স্বীকার করার জন্য বাংলাদেশকে চাপ দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থানকে ভালভাবে নিচ্ছে না সরকার। ফলে আইএস ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। ২০১৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিশ্বের সকল দেশকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আইএসবিরোধী জোটে অংশগ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান। মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে বিশ্বের ৫৪টি দেশ আইএসবিরোধী জোটে অংশ নেয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ওই জোটে অংশ নেয়নি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশ শুধু জাতিসংঘের নেতৃত্বে কোন সামরিক জোটেই অংশ নেবে। অন্য কোন জোটে অংশগ্রহণ করবে না। বাংলাদেশ মার্কিন জোটে অংশগ্রহণ না করলেও সৌদি আরবের নেতৃত্বে আইএসবিরোধী জোটে অংশগ্রহণ করে। তাড়াহুড়ো করে এই জোটে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করায় নানা ধরনের সমালোচনার মুখে পড়েছিল সরকার। তবে বাংলাদেশ সরকার পরবর্তীতে আইএসবিরোধী সৌদি জোটকে জানায়, বাংলাদেশ এ জোটে অংশ নিলেও সামরিক কার্যক্রমে অংশ নেবে না। বাংলাদেশ শুধু তথ্য আদান-প্রদান, কারিগরি সহায়তা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রমে অংশ নেবে। যদিও এ জোটের ভবিষ্যত নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ পরিস্থিতি বেশ জটিল ॥ জুলহাস মান্নানসহ সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যাকা- এবং তা নিয়ে আইএস ও আল কায়েদার দায় স্বীকারের বার্তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে বেশ জটিল মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মার্ক টোনার এ মনোভাব জানান। ওয়াশিংটনে নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্নের মুখে মার্ক টোনার বলেন, এসব হত্যাকা-ের সুষ্ঠু তদন্ত করে খুনীদের আইনের আওতায় আনতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে। আইএস ও তালেবানের স্বীকারের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ পরিস্থিতি আসলে কেমন, তা জানতে চাওয়া হয় টোনারের কাছে। উত্তরে তিনি বলেন, এ ধরনের দায় স্বীকারের খবর এসেছে বলে আমি জানি, সেখানে পরিস্থিতিটা আসলে বেশ জটিল। দায় স্বীকারের অনেক বার্তাই আসছে। তবে এতে বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস, কোনটি করার কারণ এখনও নেই। তবে এটা স্পষ্ট যে, সেখানে (বাংলাদেশে) হুমকি আছে। বাংলাদেশে যারা হুমকির মুখে রয়েছেন, তাদের নিরাপত্তা দ্বিগুণ করার আহ্বান জানিয়েছে ওয়াশিংটন।
×