ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দরবনে ১৪ বছরে ২৫ আগুনে পুড়েছে ৭০ একর বনভূমি

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১ মে ২০১৬

সুন্দরবনে ১৪ বছরে ২৫ আগুনে পুড়েছে ৭০ একর বনভূমি

বাবুল সরদার, বাগেরহাট থেকে ॥ একক বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ জীববৈচিত্র্যের আধার বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে একের পর এক অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। পুড়ে যাচ্ছে একরের পর একর বনভূমি। প্রতিটি ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। বন বিভাগসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ছোটাছুটি করেন। তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু স্থায়ী সমাধান বা প্রতিরোধমূলক কিছু হয় না। গত এক মাসে ৪ বার আগুনে ১৩ একর বন পুড়ে গেছে। গত ১৩ ও ১৮ এপ্রিল পরিকল্পিত নাশকতা আগুন দেয়ার ঘটনায় ১১ দুর্বৃত্তকে আসামি করে বনবিভাগ পৃথক দুটি মামলা করে। কিন্তু আজও এ মামলার আসামিদের একজনও গেফতার হয়নি। সুন্দরবন সুরক্ষায় ‘স্মার্ট পেট্রলিং টিম’ ও নাশকতার আগুন রোধে ৫টি ‘ফায়ার ওয়াচার টিম’ গঠন করা হয়। বসানো হয় ওয়াচ টাওয়ার। এত কিছুর পরও আগুন রোধ করা যায়নি। বরং এবার দুর্বৃত্তরা বনের ৮/৯টি দুর্গম এলাকায় একই সঙ্গে আগুন দিয়েছে। প্রচ- তাপপ্রবাহ এবং কাছাকাছি পানির সহজ উৎস না থাকায় আগুন নিভানো কঠিন হয়ে পড়ছে। এবার আগুনের বিস্তৃতি অপেক্ষাকৃত বেশি। এ অবস্থায় বনসংলগ্ন এলাকার সাধারণ মানুষ এবং পরিবেশ কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। রূপান্তরের নির্বাহী ও সুন্দরবন সমর্থক কমিটির সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম বলেন, দলমত নির্বিশেষে বন অপরাধীদের দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি বনসংলগ্ন এলাকাবাসীদের সমন্বয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কার্যকর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং জন সচেতনতা অপরিহার্য় বলে তিনি মত দেন। সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, এক মাসে চারবার অগ্নিকা-ের ঘটনা স্পষ্টতই নাশকতা। তাই হইচই না করে দুর্বৃত্তদের দমন করা জরুরী। সুন্দরবন সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণে তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ১৪ বছরে ২৫ বার অগ্নিকা- কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা ও দোষীরা শাস্তি না পাওয়ায় সুন্দরবনে বারবার আগুন জ্বলছে। গত ১৪ বছরে সরকারী-বেসরকারী হিসাবে ২৫বার অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এতে পুড়েছে প্রায় ৭০ একর বনভূমি। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মোঃ জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, সম্প্রতি আগুন লাগার ঘটনায় স্থানীয় ১১ চোরাকারবারির বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়ের করা হয়। এজন্য তারা পরিকল্পিতভাবে আবারও বনে অগ্নিসংযোগ করেছে। সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে চক্রটি একের পর এক নাশকতা চালাচ্ছে। এর আগে গত ২৭ মার্চ সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলি টহল ফাঁড়ির কাছে প্রথম আগুন লাগে। এর পর ১৩ এপ্রিল নাংলি ফাঁড়ি এলাকার আব্দুল্লাহর ছিলা ও ১৮ এপ্রিল একই এলাকায় আবারও আগুন লাগে। ২০০২ সালের ২২ মার্চ সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জে কটকা অভয়ারণ্য প্রথম অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। পুড়ে যায় ১ একর বন। এরপর ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলি ক্যাম্পের মাদ্রাসার ছিলা এলাকার ৩ একর বন পুড়ে যায়। ২৭ মার্চ আড়িয়ার খাল এলাকায় বনের ভেতরে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর আড়ুয়াবেড় এলাকায় আগুনে পুড়ে যায় প্রায় ৯ শতক বন। ২০০৫ সালের ৮ এপ্রিল ধানসাগর স্টেশনের অধীন কদলতেজি এলাকায় পুড়ে যায় আড়াই একর বন। এর ৫ দিন পর ১৩ এপ্রিল একই রেঞ্জের তুলাতলা এলাকায় পুড়ে যায় সাড়ে ৪ একর বন। এর পরের বছরের ৩ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টের আড়াই একর বন পুড়ে যায়। ১৯ মার্চ শরণখোলা রেঞ্জের তেরাবেকা এলাকায় পুড়ে যায় প্রায় একর বনভূমি। ২০০৬ সালের ১১ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া টহল ফাড়ি এলাকায় পুড়ে যায় প্রায় ৫০ শতক বন। এর একদিন পর কলমতেজির টহলফাঁড়ির খুটাবাড়িয়া এলাকার দেড় একর, পহেলা মে নাংলির পচাকুড়ালিয়া এলাকার ৫০ শতক, এর ৩ দিন পর ৪ মে ধানসাগর স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় আগুনে আড়াই একর বনভূমি পুড়ে যায়। ২০০৭ সালে সুন্দরবনে ৩টি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ১৫ জানুয়ারি শরণখোলার ডুমুরিয়া ক্যাম্প এলাকায় ৫ একর, ১৯ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলি এলাকার ২ একর ও ২৮ মার্চ একই এলাকার ৮ একর বনভূমি পুড়ে যায়। ২০১০ সালের ২০ মার্চ ধানসাগর স্টেশনের গুলিশাখালি এলাকায় প্রায় ৫ একর বন পুড়ে যায়। এর পরের বছর ২০১১ সালে মার্চ মাসে তিন দফা আগুন লাগে। ১ মার্চ নাংলি এলাকার ২ একর ও ৮ মার্চ একই এলাকার ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টে টানা ৩ দিনের অগ্নিকা-ে প্রায় সাড়ে ৩ একর বন পুড়ে যায়। এ আগুন নেভাতে না নেভাতেই ৯ মার্চ ভোলা নদী থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে গহীন বনে হঠাৎ আগুন জ্বলে ওঠে। ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ টানা ৩ দিনের অগ্নিকা-ে পুড়ে যায় প্রায় ১০ একর বনভূমি। ২১ মে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের ৬৫ ছিলায় আগুনে সাড়ে ৩ একর বন পুড়ে যায়। পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, একের পর এক দুর্ঘটনায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। তারা আশঙ্কা করছেন, বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি জীববৈচিত্র্যের আধার সুন্দরবনে এভাবে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলে তার দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলনের খুলনার আহ্বায়ক প্রফেসর আব্দুল মান্নান বলেন, সুন্দরবন আমাদের জন্য শুধু গর্বের নয়, ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় জনপদের লাখ লাখ মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় এই বনের গুরুত্ব অনেক। তাই বন অপরাধীদের দমনের পাশাপাশি সুন্দরবনের প্রতিবেশ-পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও যথাযথ বাস্তবায়নে সকলকে আন্তরিক হতে হবে বলে তিনি মত দেন।
×