ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রশংসায় বিশ্বব্যাংক

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১ মে ২০১৬

বাংলাদেশের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রশংসায় বিশ্বব্যাংক

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রশংসা করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে বিশ্বের ১১৮টি দেশের মধ্যে মাত্র ১২টি দেশ ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। আন্তর্জাতিক বিবেচনায় এ অর্জন অনেক প্রশংসার। তবে চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ক্ষেত্রে সরকারী হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংক। বলেছে চলতি অর্থবছর সরকার বলছে ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। কিন্তু এ বছর শুধু রফতানি ও ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি ছাড়া কোন সূচকই (প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে এমন) গত অর্থবছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়নি, তাহলে কিভাবে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এত হবে। তবে আগামী অর্থবছর ২০১৭-এ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। অন্যদিকে প্রবৃদ্ধি অর্জনে অর্জিত সাফল্য অব্যাহভাবে চলতে থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এক্ষেত্রে উদ্বেগগুলো হচ্ছে, রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতা, উন্নয়ন ব্যয়ের গুণগত সমস্যা ও ধীরগতি, বাজেটের ঘাটতি অর্থায়ন (বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন), আর্থিক খাতে আস্থার সঙ্কট, জ্বালানি, অবকাঠামো ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতার ক্ষেত্রে আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে। শনিবার রাজধানীর আগারগঁাঁওয়ে বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়। বছরে দু’বার এই আপডেট প্রকাশ করে থাকে সংস্থাটি। এতে বক্তব্য রাখেন ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান। আপডেট উপস্থাপন করেন প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। এ সময় যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহেরিন এ মাহবুবসহ বিশ্বব্যাংকের অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। চিমিয়াও ফান বলেন, বাংলাদেশ যেভাবে আর্থিক খাতে অগ্রগতি করছে, তা ধরে রাখা গেলে মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছানো সম্ভব। গত দশকে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। বিশেষ করে দারিদ্র্য নিরসন, মানব উন্নয়ন, প্রাথমিক শিক্ষা, লিঙ্গ সমতা আনয়ন, মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা দেখিয়েছে। এসব অর্জন ধরে রেখে আগামীতে এগিয়ে যেতে হলে অকাঠামো উন্নয়ন জরুরী হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে দক্ষতা উন্নয়ন, মানসম্মত শিক্ষা, পরিবহন, তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুত ও জ্বালানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ নজর রাখতে হবে। বিশ্বব্যাংক সাম্প্রতিক অনুমোদিত কান্ট্রি পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় আগামী পাঁচ বছর সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা দিয়ে যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। সুতরাং সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে এ বিষয়ে আরও সতর্ক হতে হবে। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে অর্থনীতির জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে জ্বালানি সঙ্কট, অবকাঠামো সঙ্কট, প্রতিযোগিতার সক্ষমতা, আর্থিক খাতে অনিয়ম, সুশাসন এবং সুব্যবস্থাপনা। বলা হয়েছে এসব চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকি উন্নয়নে সরকারকেই কাজ করতে হবে। এখানে আন্তর্জাতিকভাবে সমাধানের খুব বেশি সুযোগ নেই। প্রাথমিক জ্বালানি সমস্যা সমাধানে দেশী-বিদেশী প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে জ্বালানি মূল্য নির্ধারণী নীতিতে সংস্কার করতে হবে। জ্বালানি খাতে কর ব্যবস্থায় পরিবর্র্তন আনা যেতে পারে। এক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষায় কার্বন ট্যাক্স আরোপের বিষয়টি ভালভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে। একদিকে যেমন মূল্য সংস্কার করতে হবে, অন্যদিকে তেমনি পরিবেশের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বলা হয়েছে বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের ধারাবাহিক ৬ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রশংসীয়। বিশ্বের ১১৮টি দেশের মধ্যে মাত্র ১২টি দেশ ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। তাই আন্তর্জাতিক বিবেচনায় যে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে বা হবে সেটি প্রশংসার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই অর্জন ধরে রাখা সম্ভব হবে কিনা। কেননা চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধি বাড়লেও সেটি হবে চাহিদার দিক থেকে সরকারী বিনিয়োগ এবং সরকারী ব্যয় বাড়ার কারণে। তাছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যে প্রক্ষেপণ দিয়েছে সেখানে দেখা গেছে সরবরাহর দিক থেকে সেবা ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে প্রবৃদ্ধি হওয়ায় চলতি অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে। কিন্তু কৃষিতে প্রবৃদ্ধি কমেছে। কিন্তু প্রতিবছর তো বেতন বাড়বে না, তাহলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে কার হাত ধরে। এ জন্য কৃষিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ার দিকে নজর দিতে হবে। মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারও সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সার্বিক মূল্যস্ফীতি চলতি অর্থবছরের মার্চে হয়েছে ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ, যা ২০১৫ সালের মার্চে ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯ শতাংশে। এক্ষেত্রে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য কমা এবং বিনিময় মূল্য কমার কারণে এটা হয়েছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের মার্চে এ হার হয়েছে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০১৫ সালের মার্চে ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। এটি হয়েছে চাহিদা ও ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধি, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি এবং সরকারী খাতের বেতন বৃদ্ধির কারণে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বহির্বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ভাল। রিজার্ভ বাড়ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে সমস্যাও। বিশেষ করে রিজার্ভের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিনিময় হার ভাল অবস্থানে রয়েছে। তবে রফতানি ও রেমিটেন্স দ্রুত ওঠানামা করছে। যা আগে কখনও এতটা হয়নি। গত নয় মাসে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি ভাল ছিল না। ২ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে স্বাভাবিক শ্রমবাজার ভাল ছিল না। তৈরি পোশাক রফতানির ওপর অধিক নির্ভরতা কমিয়ে রফতানি বহুমুখীকরণের দিকে নজর দিতে হবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ ভাল অবস্থায় নেই। এক্ষেত্রে বিনিয়োগে যেসব বাধা রয়েছে সেগুলো অপসারণে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে বাংলাদেশে কারখানা করার পরও বিদ্যুত ও গ্যাসের সংযোগ পেতে অনেক বিলম্ব হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগের অর্ডার হওয়ার পরও সংযোগ পেতে এক থেকে দেড় বছর দেরি হচ্ছে। এতে করে যারা বিনিয়োগ করেছে তারা যেমন ক্ষতির শিকার হচ্ছে, তেমনি নতুন বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। সুতরাং বিনিয়োগের যত ধরনের বাধা রয়েছে সেগুলোর দ্রুত সমাধান করতে হবে। ব্যাংক সুদের হারের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে শত কোটি টাকা তারল্য থাকা সত্ত্বে¡ও সুদের হার সে অনুযায়ী কমছে না। তবে সুদের হার কিছুটা ইতোমধ্যেই কমানো হলেও তা আরও কমানো সম্ভব ছিল। গত দশ বছরে দেখা গেছে ব্যাংক সুদের হার ১১ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যেই ছিল। এটি আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় একেবারেই কম বা উচ্চ এটা বলার সুযোগ নেই। বরং বলা যায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় কিছুটা কম। তবে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার করে ব্যাংক সুদের হার আরও কমানোর সুযোগ রয়েছে। বলা হয়েছে, সরকারী ব্যাংকে সুশাসন ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ছিল, সেটা এখনও আছে। শেয়ারবাজারের অবস্থা খারাপ, আস্থার সমস্যা ছিল সেটা এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এসব বিষয় নজর দিতে হবে। মুদ্রানীতির ধারাবাহিকতা বজায় আছে। এর লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। রাজস্ব ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। বার্র্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) বাস্তবায়ন অত্যন্ত ধীর। এক্ষেত্রে সরকারী বিনিয়োগ বাড়ানো হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে তা ব্যয় হচ্ছে না। আবার যা ব্যয় হচ্ছে তার গুণগত ব্যয় হচ্ছে না। অর্থাৎ সম্পদ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে না। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে যেতে পারবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার পথে রয়েছে। কিন্তু সেটি অর্জন করতে হলে এখন থেকে প্রস্তুতিমূলক ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেই হবে না, প্রবৃদ্ধি বাড়াতে জ্বালানী, যোগাযোগ, পরিবহন খাতে উন্নতি ঘটতে হবে। তানা হলে দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ আসবে না। গত অর্থবছর ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে। সেটিকে ২৫ থেকে ২৬ শতাংশে নিতে হলে ভবিষ্যত অনিশ্চয়তা কাটাতে হবে। বলা হয়েছে অবকাঠামো খাতে সরকারী বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে শুধু ব্যক্তি খাতে ঢালাওভাবে বিনিয়োগ করতে দিলে হবে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ এবং ভঙ্গুরতাÑ এই তিন সূচকের ওপর নির্ভর করে জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশের বাইরে যারা বেরিয়ে আসে সেসব দেশের তালিকা প্রকাশ করে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ একটি সূচকে ভাল করেছে। ২০১৮ সালের মধ্যে তিনটি সূচকের মধ্যে দুটিতে ভাল করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তখন জাতিসংঘের কমিটি বলবে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হতে পারে। তার তিন বছর পর ২০২১ সালে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে আবারও দেখা হবে বাংলাদেশের অর্জন ঠিক আছে কিনা বা তখন যদি তিনটি সূচকেই ভাল করে, তখন বলা হবে হ্যাঁ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হতে পারে। তার তিন বছর পর ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে আবার দেখা হবে অর্জন ধরে রাখতে পেরেছে কিনা। তখন সব ঠিকঠাক থাকলে ঘোষণা দেয়া হবে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়েছে।
×