ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাসভাড়া বাড়ানো হলো কমানোর সরকারী সিদ্ধান্তের আগেই

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১ মে ২০১৬

বাসভাড়া বাড়ানো হলো কমানোর সরকারী সিদ্ধান্তের আগেই

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ভাড়া কমানোর প্রস্তুতির মধ্যেই আরেক দফা বাড়ল দূরপাল্লার বাসের ভাড়া। ঘোষণা ছাড়াই দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাসের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে চারদিন আগে থেকেই। এ নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। জানা গেছে, ২৮ এপ্রিল থেকে পাবনা, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন রুটের বাস মালিকরা বাড়তি মুনাফা লাভের আশায় ইচ্ছেমতো যাত্রীদের কাছ থেকে বাস ভাড়া আদায় করছেন। জ্বালানি তেলের দাম কমার পর আন্তঃজেলা রুটে বাস ভাড়া কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ভাড়া কমানোর পরও যেন মালিকদের বাড়তি মুনাফা থাকে এ চিন্তা থেকেই নতুন করে ফের ভাড়া বাড়ানোর কথা বলছেন অনেকেই। জ্বালানি তেলের দাম কমানোর পর গণপরিবহনের ভাড়া কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে পরিবহন ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটিকে একটি খসরা প্রস্তাব দেয়ার মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, গণপরিবহনের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে মাত্র ৩ পয়সা করে কমানো হবে। আর সর্বোচ্চ ভাড়া কমবে ১৪ টাকা। আগে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ছিল ১ টাকা ৪৫ পয়সা। বর্তমানে তা ১ টাকা ৪২ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে বৈঠকে বসবে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি। এরপর তা চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এদিকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে পরিবহন মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের বৈঠকের জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। আগামীকাল সোমবার বিআরটিএ এলেনবাড়ি কার্যালয়ে গণপরিবহনের ভাড়া কমানোর বিষয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর উদ্যোগ যখন সরকারের পক্ষ থেকে তখন স্রোতের বিপরীত দিকে হাঁটছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। বাড়তি ভাড়ার আদায়ের উদ্যোগ তাদের পক্ষ থেকে। যদিও যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, আন্তঃজেলা রুটে সরকার নির্ধারিত বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৪৫ পয়সা। দেশের বেশিরভাগ পরিবহন কোম্পানি সরকারের এ নির্দেশনা মানছে না। বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ অনেক পরিবহন কোম্পানির বিরুদ্ধে। গত ২৯ এপ্রিল ঢাকার উত্তরা কাউন্টার থেকে পাবনা এক্সপ্রেসের টিকেট কাটেন সোহাগ। তিনি জানান, সকাল সাড়ে সাতটায় ছেড়ে যাওয়া এই পরিবহনের বাসের টিকেট নম্বর-৪১৩১৪। ৩৫০ টাকায় নিয়মিত ভাড়ার পরিবর্তে টিকেটের মূল্য নেয়া হয়েছে ৪৫০ টাকা। তিনি জানান, কোন রকম ঘোষণা ছাড়াই যাত্রীদের জিম্মি করে বাড়তি অর্থ আদায় করছে পরিবহন কোম্পানিগুলো। এ নিয়ে কারও কিছু বলারও নেই করারও নেই। তিনি বলেন, অনেক যাত্রী বাড়তি ভাড়ার প্রতিবাদ করলেও কাজ হয়নি। কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মালিকপক্ষের সিদ্ধান্তে বেড়েছে বাস ভাড়া। এ নিয়ে তাদের করার কিছুই নেই। সারোয়ার জাহান নামের অপর যাত্রী জানান, ২৯ এপ্রিল তিনিও পাবনা এক্সপ্রেসের যাত্রী ছিলেন। চাহিদা বেশি হওয়ার কারণে টিকেটের বাড়তি দাম নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। ৪৫০ টাকা দিয়ে তিনি টিকেট কাটার কথা স্বীকার করেন। তবে তাদের কাউন্টার থেকেই জানানো হয়েছে, ২৮ এপ্রিল থেকে বাসের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। অপর যাত্রী পাপ্পু জানান, পাবনা থেকে ঢাকা আসতে সরকার ট্রাভেলস থেকে টিকেট সংগ্রহ করেছেন তিনি। বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশে গাড়ি ছাড়বে। টিকেট নম্বর-৬১৪০৩। ৩৫০ টাকার পরিবর্তে তাঁর কাছ থেকে দাম রাখা হয়েছে ৪৫০ টাকা। যা টিকেটের গায়ে উল্লেখ রয়েছে। তিনি বলেন, নিয়মিত যাতায়াত করছি ৩৫০ টাকায়। কিন্তু হঠাৎ করে টিকেটের দাম বাড়ায় সব যাত্রীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, বাস কাউন্টার থেকে বলা হয়েছে এ দামেই এখন থেকে টিকেট বিক্রি হবে। যাত্রীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাজধানীতে পাবনা এক্সপ্রেসের কাউন্টারে-০১৭১১০২৪০৮৮ এই মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলা হয়, বাড়তি ভাড়ার বিষয়ে আমাদের করার কিছুই নেই। আমরা নির্দেশ বাস্তবায়ন করছি মাত্র। সরকার ট্রাভেলসের ঢাকা কাউন্টারে ০১৭২৫৪৪২৬৪৬-৪৩ নম্বরে ফোন করা হলে আওয়াল পরিচয়ে কাউন্টার মাস্টার জানান, সেবার মান বাড়ানো হয়েছে। তাই ভাড়াও বেড়েছে। তাছাড়া বাড়তি ভাড়ার বিষয়ে আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা হুকুম বাস্তবায়ন করছি মাত্র। যাত্রীরা এই ভাড়ায় টিকেট না কাটলে বাস ছাড়বে না বলেও জানান তিনি। ঢাকা থেকে নাহিদ এন্টারপ্রাইজে সিরাজগজ্ঞে যান তন্ময়। তিনি জানান, এই বাসের হঠাৎ করে ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ২২০ টাকার ভাড়া ২৮০ টাকা করা হয়েছে। যাত্রীরা প্রতিবাদ করলেও কাজ হয়নি। সবাইকে বাড়তি অর্থ গুনে গন্তব্যে যেতে হয়েছে বলে জানান তিনি। যাত্রীদের অভিযোগ পাবনা রুটে, শ্যামলী পরিবহন, রাজা বাদশা এন্টারপ্রাইজ, কিংস পরিবহন, বাদল গ্র্যান্ড চয়েস থেকে শুরু করে সব পরিবহন একযোগে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সিরাজগঞ্জসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি জেলায় ইচ্ছেমতো যাত্রীদের কাছ থেকে বাস ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের দূরত্ব ১৪২ কিলোমিটার। আন্তঃজেলা রুটে টোল বাদে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা আছে ১ টাকা ৪৫ পয়সা। এই হিসেবে ভাড়া হওয়ার কথা ২০৫ টাকার কিছু বেশি। ঢাকা থেকে রাজশাহীর দূরত্ব ২৭২ কিলোমিটার। ১ টাকা ৪৫ পয়সা হারে ভাড়া আসে ৩৯৪ টাকা। ঢাকা থেকে পাবনার দূরত্ব ১৬১ কিলোমিটার। ১ টাকা ৪৫ পয়সা কিলোমিটার প্রতি ভাড়া হিসেবে আসে ২৩৩ টাকা। প্রশ্ন আছে তাহলে ৪৫০ টাকা আদায় করা হচ্ছে কোন্ যুক্তিতে? সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)-এর আওতায় সাত জেলায় পরিবহনের ভাড়া কমবে না। এসব জেলাসমূহের মধ্যে রয়েছেÑ ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এসব জেলায় ঢাকার নির্ধারিত ভাড়ায় পরিবহন চলাচল করবে। এ ব্যাপারে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক সাংবাদিকদের বলেছেন, জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহন ভাড়া কমানোর বিষয়ে ভাড়া নির্ধারণ কমিটিকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা ব্যয় বিশ্লেষণ করে একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে দূরপাল্লা বাসের ভাড়া কমানো হচ্ছে বলে জানান তিনি। আন্তর্জাতিক বাজারে অব্যাহত তেলের দর পতনের পর থেকেই বাংলাদেশে তেলের মূল্য কমানোর দাবি ওঠে। এক পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় তিন দফায় তেলের মূল্য কমানো হবে। এরি ধারাবাহিকতায় গত ২৫ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে কমানো হয়েছে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। পেট্রোল ও অকটেনের মূল্য লিটারপ্রতি কমানো হয়েছে ১০ টাকা। কেরোসিন ও ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি কমানো হয়েছে তিন টাকা। তেলের মূল্য কমানোর ঘোষণার পরদিন থেকেই গণপরিবহনের ভাড়া কমানোর দাবি ওঠে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে তেলের মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিবহন ভাড়া কমানো হোক। যদিও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী অনেক আগেই বলেছেন, তেলের দাম কমলে পরিবহনের ভাড়াও কমানো হবে। লিটারপ্রতি এক টাকা তেলের দাম কমলে কিলোমিটারপ্রতি এক পয়সা ভাড়া কমানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। গণপরিবহনের ভাড়া কমানো প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শ্যামলী পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, পরিবহন ভাড়া কমানোর বিষয়ে আমি একমত। তিনি বলেন, যখন তেলের দাম বাড়ে তখন আমরা ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানাই। এখন তেলের দাম কমেছে। সব মহল থেকেই দাবি ্্্্উঠছে ভাড়া কমানোর। এমন দাবি কোনভাবেই অযৌক্তিক হতে পারে না। সর্বশেষ ২০১৩ সালে আন্তঃজেলা রুটে বাস ভাড়া বাড়ানো হয়। তখন ভাড়া নির্ধারণ করা হয় কিলোমিটারপ্রতি এক টাকা ৪৫ পয়সা। এর আগে ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি দূরপাল্লার বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১৫ পয়সা করে বাড়িয়ে এক টাকা ৩৫ পয়সা করা হয়।
×