ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আজ মহান মে দিবস

দেশের ৫ কোটি ৪০ লাখ শ্রমিক ঘাম ঝরাচ্ছেন প্রতিদিন

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১ মে ২০১৬

দেশের ৫ কোটি ৪০ লাখ শ্রমিক ঘাম ঝরাচ্ছেন প্রতিদিন

শাহীন রহমান ॥ জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশ শ্রম-ঘনত্বই অর্থনীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকসহ ৫ কোটি ৪০ লাখ ৮৪ হাজার লোক বিভিন্ন শ্রমের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। সংস্থাটির হিসাব মতে, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যা রয়েছে ৬৭ লাখ ৮৭ হাজার, যারা মূলত সরকারী-বেসরকারী সংস্থায় নিয়মিত শ্রম দিয়ে থাকেন। এসব সংস্থার মধ্যে রয়েছেÑ পাট, টেক্সটাইল, চিনি, কাগজ, গার্মেন্টস, হালকা যান, পরিবহন, ট্যানারি, চা ও নৌযান শ্রমিক। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমের সংখ্যা প্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অনেক বেশি। মূলত শ্রমের ৮৭.৫ ভাগই নিয়োজিত রয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, এ খাতে ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত। তারা মূলত গৃহশ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, হকার প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত। এ বিশাল শ্রমিকের নেই কোন স্বীকৃতি। নেই কোন আলাদা পরিচয়পত্র। অথচ তাদের ঘামেও সচল রয়েছে দেশের অর্থনীতির চাকা। হিসাব অনুযায়ী দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছেন এসব শ্রমিক। অথচ এই শ্রমিকদের এখনও অনেকে ন্যূনতম জীবনধারণের অধিকার থেকে বঞ্চিত। কর্মক্ষেত্রে সইতে হচ্ছে নানান ধরনের নির্যাতন। পরিবেশবান্ধব কর্মপরিবেশ নেই। বর্তমানে শ্রমিকদের সুবিধা কিছু বাড়লেও অনেক অসুবিধাও রয়েছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বেশিরভাগ শ্রমিকের নেই কোন স্বীকৃতি ও পেশার মর্যাদা। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সারাদিন পরিশ্রম করলেও সব ধরনের সুযোগ সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রতিনিয়ত তাদের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিবারের ন্যায় এবারও দ্বারে এসেছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। যাকে সারাবিশ্বে মে দিবস হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে আজ ১ মে জাতীয় ছুটির দিন। অনেক দেশে এটি বেসরকারীভাবে পালিত হয়। আজ মহান মে দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশে এ দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পাালন করা হবে। এবারের মে দিবস উপলক্ষে সরকারী ও বেসরকারীভাবে পালনের জন্য নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচী। দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ, বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তারা মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। এছাড়া বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও দিনটি পালনে নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারীভাবেও দেশে এ দিবস পালনের জন্য কর্মসূচী রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যেসব খাত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে তাদের মধ্যে তৈরি পোশাক খাত অন্যতম। এ খাতে প্রায় ৫ হাজার কারখানা রয়েছে; যেখানে ৩.৫ মিলিয়নেরও অধিক শ্রমিক কাজ করছেন। ২৫ বিলিয়ন ডলারের এ খাত জাতীয় রফতানি আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ পূরণ করে থাকে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত বাংলাদেশের এ পোশাক খাতের ৮০ ভাগ শ্রমিকই হচ্ছে সমাজের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার নারীগোষ্ঠী। যাদের উল্লেখযোগ্য কোন শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই। অথচ নিরন্তন পরিশ্রম করে এ খাত বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন শ্রমিকরা। কৃষি ও পোশাক খাত ছাড়াও যেসব খাতসমূহ বার্ষিক জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যÑ নির্মাণ, শিপ বিল্ডিং/ব্রেকিং, চিংড়ি, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোটেল/ মোটেল ও রেস্তরাঁসহ অন্যান্য সেবা এবং বিভিন্ন ধরনের ছোট ও মাঝারি শিল্প। বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রমঘন পরিবেশের কারণেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের খ্যাতি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। যার কল্যাণে পোশাক খাত আজ সারাবিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে গিয়েছে তারা হলো এ সেক্টরে কর্মরত শ্রমিক। যাদের ৯৫ ভাগই আবার নারী। এ দেশের পোশাকের খ্যাতি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও শ্রমিকদের অবস্থার কোন হেরফের হয়নি। সরকারের গৃহীত নীতির কারণে শ্রমিকদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে শ্রমিকরা এখনও নানা সমস্যায় জর্জরিত। শুধু তৈরি পোশাক খাত নয়, চামড়া, চাসহ অন্যান্য খাত দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে সংশ্লিষ্ট সেক্টরের কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণে। দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পের নাম চা শিল্প। এ সেক্টরেও দেশের দেড় লাখ শ্রমিক অবদান রাখছেন। তাঁত শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন ৫০ লাখ শ্রমিক। বস্ত্র শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত তৈরি পোশাক শিল্প ছাড়াও তুলা উৎপাদন, সুতা উৎপাদন, প্রিন্টিং ও ডাইং মিলে কাজ করা শ্রমিকের সংখ্যাও কম নয়। চামড়া শিল্পের শ্রমিকরা এ শিল্পকে অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছেন। মাছ উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের কল্যাণে দেশের মাছ উৎপাদন বিশ্বের চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। কৃষি শ্রমিকের অবদানে বিশ্বের ধান উৎপাদনেও বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। অথচ তাদের পেশার নেই কোন স্বীকৃতি। দেশে এখন একজন নারী কৃষি শ্রমিকের যেমন সাংবিধানিক কোন স্বীকৃতি নেই, তেমনি কৃষি শ্রমিক হিসেবে পরিচয় দেয়ার মতো পরিচয়পত্রও নেই। এমনকি জীবন, স্বাস্থ্য, অক্ষমতা, মাতৃত্ব সংবলিত সামাজিক নিরাপত্তা সুযোগ এবং বৃদ্ধ বয়সের ভাতার সুযোগ নিশ্চিতকরণের কোন নীতি বা কৃষি শ্রমিক কল্যাণ তহবিল বা জাতীয় বোর্ড গঠন এবং এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আজও উঠেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিতে অর্থনৈতিক কর্মকা- কমে যাওয়ার ফলস্বরূপ গ্রামাঞ্চলের এক বিরাটসংখ্যক শ্রমিক এখন কাজের সন্ধানে শহরমুখী হয়েছেন। গ্রামাঞ্চলে কিছুটা অকৃষিজ পেশার সুযোগ বৃদ্ধি, কাজের টানে শহরমুখী হওয়া এবং শিল্পায়ন না হওয়ায় জাতীয় অর্থনীতিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক খাতের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি শহরে জন্ম নিয়েছে বিশাল আকৃতির এক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। এ খাতে কম মজুরিতে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমজীবীর কর্ম-নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। তবে এর বিপরীতে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের কল্যাণে আজ তৈরি পোশাক শিল্প পরিপক্বতা অর্জন করেছে। এ শিল্প আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে শিশুশ্রম বন্ধ, ন্যূনতম মজুরি দেয়া, ক্রেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজের পরিবেশ উন্নত করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বেশ কয়েকটি কারখানায় সিবিএ-সহ ট্রেড ইউনিয়ন সক্রিয় আছে। রানা প্লাজার ট্র্যাজেডি এ খাতে সাময়িক বাধা এলেও বর্তমানে তা অতিক্রম করতে পেরেছে। এ ঘটনার পর দেশের গার্মেন্টস শিল্পের কর্মপরিবেশ আরও অনেক উন্নত হয়েছে। মে দিবসের পেছনের কাহিনী ॥ যাদের ঘামে কল্যাণে অর্থনীতির চাকা চালু থাকে সেই শ্রমিকরা সব সময় থাকছেন অবহেলিত। এ দেশেও এর কোন ব্যতিক্রম নেই। তাই শ্রমিকদের অবস্থা দেখে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখতে বাধ্য হয়েছিলেনÑ আসিতেছে শুভদিন, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ! হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়, পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়, তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি, তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি; তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান। মে দিবস ইতিহাসের পাতায় ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে আসছে। এদিন এলেই মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে দেয়। এ দিন প্রমাণ করে দিয়েছে শ্রমিকের ন্যায্য দাবিকে গলাটিপে হত্যা করা যায় না। তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবির কাছে মাথা নোয়াতে হয়। শ্রমিকের আন্দোলনের কারণে আজ ৮ ঘণ্টা কাজ করার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই শ্রমিকের এ দাবিকে আইনে পরিণত করেছে। তবে দুখের বিষয় যাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন আজ বাংলাদেশের সেসব শ্রমজীবী মানুষের কাছে দিনটির তাৎপর্য আজও ভালভাবে পৌঁছায়নি। অনেক দিনমজুর, গৃহশ্রমিক জানে না মে দিবস কী। কর্মসূচী ॥ মহান মে দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সমাবেশ, র‌্যালি ও শোভাযাত্রা। মে দিবস উপলক্ষে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে আজ শ্রমিক দল আয়োজিত এক জনসভায় বক্তব্য রাখবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। দিবসটি সরকারীভাবে পালনের জন্য র‌্যালির আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের খদ্দর মার্কেটের শপিং কমপ্লেক্সের সামনে সকাল ৮টায় শ্রমিক সমাবেশ ও র‌্যালির আয়োজন করেছে। এরশাদ ॥ শ্রমিকদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার নিশ্চয়তার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রয়োজন কল্যাণধর্মী সমাজব্যবস্থা -রওশন ॥ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কল্যাণধর্মী সমাজব্যবস্থার প্রয়োজন বলে মনে করেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। মহান মে দেবস উপলক্ষে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বাণীতে তিনি একথা বলেন। বিশ্বের শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের সঙ্গে ঐক্য ও সংহতি প্রকাশ করে মে দিবসে সকল মেহনতি মানুষকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি।
×