ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আবুল আজাদ

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ জয়তু মুস্তাফা নূূরউল ইসলাম

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ১ মে ২০১৬

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ জয়তু মুস্তাফা নূূরউল ইসলাম

আজ ১ মে, ২০১৬ বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জাতীয় অধ্যাপক ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলামের ৯০তম শুভ জন্মদিন। জীবনের ৮৮টি জন্মদিন কেটেছে এই গুণীজনের পরম আনন্দে, জীবন সঙ্গিনী, আত্মীয়-পরিজন, প্রিয় মানুষ, ছাত্র-সহকর্মী, ভক্ত-সুহৃদ পরিবেষ্টিত হয়ে। কিন্তু গেলবার থেকে এই আনন্দের দিনেই বেদনার মালা গাঁথা শুরু। জীবনে এই দ্বিতীয়বার প্রিয়তমা জীবন সঙ্গিনী লুৎফা সুলতানাকে ছাড়া জন্মদিনটি অতিক্রম করতে হবে। গত ২০ মে ২০১৪ দীর্ঘ রোগ ভোগের পর মিসেস লুৎফা সুলতানা তাকে ছেড়ে পরলোকে চলে যান। এখন একা-নিঃসঙ্গ জীবন কাটে দেশবরেণ্য এই শিক্ষাবিদের। অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জন্ম ১৯২৭ সালের ১ মে। ৫ বছর বয়সে ১৯৩২-৩৩ সালে কলকাতায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের হাতে তাঁর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয়। পিতা সাদত আলী আখন্দের চাকরি সূত্রে ঘন ঘন বদলির সুবাদে ম্যাট্রিকুলেশন পর্যন্ত তিনি মোট ৮টি স্কুলে লেখাপড়া করেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল দিয়ে শুরু এবং স্কুলজীবন শেষ হয় ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে আইএসসি পড়েন। গ্র্যাজুয়েশন করেন কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন এবং পিএইচ.ডি করেন লন্ডন ইউনিভার্সিটির প্রাচ্যভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র সোয়াস থেকে। ছাত্র বয়স থেকেই দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলের তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৪৮-১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি প্রতিবাদী ও প্রতিরোধী আন্দোলনের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ষাটের দশকের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, একষট্টিতে প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনসহ সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ আন্দোলনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনে পিএইচ.ডি করা কালে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সক্রিয় আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন এবং জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের কর্মজীবন শুরু সাংবাদিকতা দিয়ে, দৈনিক আজাদ পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে। তারপর ১৯৫১ সালে তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় এ্যাসোসিয়েট এডিটর হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের যাত্রা সূচিত হয় ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলামের হাত ধরে। স্বাধীনতা পূর্বকালে ক’বছর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন এবং ১৯৭১ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি করা কালে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে খ-কালীন অধ্যাপনার চাকরিও করেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম মহাপরিচালক হন। কিন্তু একই বছর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মম হত্যাকা-ের প্রতিবাদ এবং সামরিক সরকারকে সমর্থনের বিষয়ে ভিন্নমতের কারণে বাংলা একাডেমিতে চাকরির মেয়াদ অসমাপ্ত রেখেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান। সেখানে টানা ১৭ বছর অধ্যাপনা করার পর ১৯৯২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের আগে-পরে জাতীয় জাদুঘর পরিচালনা পর্ষদের তিন মেয়াদের চেয়ারম্যান, নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্ট বোর্ডের তিন মেয়াদের সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নীতিনির্ধারণী পর্ষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। লেখক-গবেষক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের প্রবন্ধ-সঙ্কলন ও গবেষণা গ্রন্থের সংখ্যা ৩০টির অধিক। এর মধ্যে ‘সমকালে নজরুল ইসলাম’, ‘সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত’, ‘আমার বাংলা’, ‘নিবেদন ইতি’ (২ খ-), ‘বাঙালির আত্মপরিচয়’, ‘সেরা সুন্দরম’, ‘পূর্বমেঘ’, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’, ‘আমাদের মাতৃভাষার চেতনা ও ভাষা আন্দোলন’, ‘আবহমান বাংলা’, ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্য’, ‘সময়ের মুখ : তাহাদের কথা’, ব্যক্তিগত প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘আপন ভুবন’, ‘বেঙ্গলী মুসলিম পাবলিক অপিনিয়ন’, ‘সাদত আলী আখন্দ রচনাসমগ্র’ (সম্পাদিত) এবং ‘শিখা সমগ্র’ (সম্পাদিত) উল্লেখযোগ্য। বাংলা সাহিত্যের পাঠক ও গবেষকদের কাছে তাঁর এসব গ্রন্থ আকর তথ্যভা-ার হিসেবে বহুকাল যাবত সমাদৃত হয়ে আসছে। বিশেষ করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর ‘সমকালে নজরুল ইসলাম’ গ্রন্থটি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে আসছে। শিক্ষাবিদ মুস্তাফা নূরউল ইসলামের আরেক অনন্য কর্মযজ্ঞ তাঁর টেলিভিশন অনুষ্ঠানমালা। বিটিভিতে তাঁর ‘মুক্তধারা’ অনুষ্ঠানটি একাধারে ১৫ বছর চলেছে সাপ্তাহিক হিসেবে। এরপর বিএনপি সরকার এসে অনুষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে বিটিভিতে আরেকটি অনুষ্ঠান করছেন তিনি ‘বাঙালির বাংলা’ নামে। পাক্ষিক এই অনুষ্ঠানটির ইতোমধ্যে ১১৪টি এপিসোড প্রচারিত হয়েছে। এছাড়াও এটিএন বাংলায় ‘কথামালা’ নামে সাপ্তাহিক আরেকটি অনুষ্ঠান করেন। এগারো বছর হয়ে গেল ‘কথামালার’। ইতোমধ্যে ৭৬৪টি এপিসোড প্রদর্শিত হয়েছে। এছাড়া সমকালীন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে টেলিভিশনে শতাধিক সাক্ষাতকার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। তার মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য দু’টি অনুষ্ঠান হচ্ছে নজরুল জন্মজয়ন্তীতে গেল বছর এনটিভির ‘কালের যাত্রায় নজরুল’ এবং তার আগের বছর এটিএন বাংলায় ‘আজো মধুরও বাঁশরী বাজে’। আমার বিরল সৌভাগ্য যে, দু’টি অনুষ্ঠানেই আলোচক হিসেবে আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম। জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের আরেক অনন্য কীর্তি তাঁর ‘সুন্দরম’ পত্রিকা। প্রায় দুই যুগ তিনি পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। ত্রৈমাসিক এই পত্রিকাটি সমকালে সেরা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভাষা বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকীর অভিধা অর্জন করে। পত্রিকাটি মাঝখানে দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার পর তাঁকে উপদেষ্টা সম্পাদক করে কামরুল ইসলামের সম্পাদনায় এখন আবার নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত হচ্ছে। এই নন্দিত গবেষক, মেধাবী শিক্ষাবিদ ও জননন্দিত জাতীয় অধ্যাপকের জন্মদিনে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। জয়তু মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যার! লেখক : চেয়ারম্যান, মুক্তিযুদ্ধ একাডেমি ধনঁষধুধফ১৯৬১@মসধরষ.পড়স
×