ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তফা জব্বার

বিলুপ্তির পথে টিভি ও অন্য প্রচলিত গণমাধ্যম

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ১ মে ২০১৬

বিলুপ্তির পথে টিভি ও অন্য প্রচলিত গণমাধ্যম

যে শিরোনামটি আমি বাছাই করেছি তাতে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। বলা যায় এটি নিয়ে সুদীর্ঘ বিতর্ক হতে পারে। বিশেষ করে আমরা যখন প্রচলিত টিভির কথা বলছি তখন প্রসঙ্গক্রমে নতুন মিডিয়াগুলোও আলোচনায় আসছে। আমি আজকেই প্রাইস ওয়ারটার হাউস কুপারসের একটি প্রতিবেদন দেখলাম, যাতে দেখা যায় ২০০৬ সাল থেকে অনলাইন বিজ্ঞাপন প্রকাশের রাজস্ব ব্যাপকভাবে বাড়ছে। এর গতি এত বেশি যে, আশঙ্কা করার কারণ রয়েছে প্রচলিত গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনের রাজস্ব একেবারেই শূন্য না হয়ে যায়। অথচ বহুদিন থেকে বা সমসাময়িককালে বিশ্বের বহু মানুষের জন্যই টেলিভিশন সম্প্রচার ছাড়া জীবনধারণ করা প্রায় কঠিন। ঘরে থাকলে সারাদিন চোখের সামনে টিভি চলে। আবার আমরা সারাদিন বাইরে থেকে ঘরে ঢুকেই তো টিভি অন করি। এখনকার মানুষের তথ্য-উপাত্ত ও বিনোদনের প্রধানতম মাধ্যম হচ্ছে টিভি। আমরা টিভিতে সিরিয়াল দেখি, সিনেমা দেখি, নাটক দেখি, টকশো দেখি, খবর দেখি; কত কিছু। যতক্ষণ জেগে থাকি ততক্ষণ তো ওটা আমার নিজেরও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। আমি টিভির ঘরে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকি। দেখি বা শুনি সেটির চাইতে গুরুত্বপূর্ণ সেটি আমার লেখালেখির জন্য ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে কাজ করে। টিভির বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান আমি বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখি। তবে এখন সম্ভবত মনে মনে চিন্তা করতে হচ্ছে যে, এমনটি কি সামনেও থাকবে? আগামীতে টিভি সেটেই কি টিভি দেখব? স্যাটেলাইট বা টেরেস্টরিয়াল উপায়েই কি টিভি সম্প্রচার হবে? কি কি থাকবে টিভিতে? এমন নানাবিধ প্রশ্ন এখন সকলের মাথায় ঘুরপাক খায়। টিভির বৃন্তচ্যুত হওয়ার খবর দিয়েই লেখাটির ভূমিকা তৈরি করতে পারি। আমার ছেলে বিজয়ের জন্ম ৯৩ সালের অক্টোবরে। ওকে গোসল করানো থেকে খাওয়ানো অবধি সবকিছু টিভিতে কার্টুন দেখিয়ে করাতে হতো। একটু বড় হলে চার বছর বয়সে ওকে আমেরিকান শিক্ষামূলক সফটওয়্যার দিয়ে টিভির সময় কমানো সম্ভব হয়। আরও একটু বড় হওয়ার পর টিভির সঙ্গে বই যোগ হয়। আমাকে দেশের বই তো বটেই আমাজন ডট কম থেকে বই কিনে দিতে হয়েছে। সেই সময়েই তার প্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায় কম্পিউটার গেমস। কিন্তু তাকে একটি আলাদা টিভি দিতেই হতো। এরপর আমরা ইন্টারনেটের যুগে পড়লাম। দৃশ্যটা আমূল পাল্টে দিল ইন্টারনেট। টিভির সময় কমতে থাকল আর ইন্টারনেটের স্পিড বাড়তে থাকল। যখন স্নাতক স্তরে পড়ার সময়ে পৌঁছাল তখন একদিন সে তার মাকে জানাল, ওর ঘর থেকে যেন টিভিটা সরিয়ে ফেলা হয়। এখন তার ঘরে টিভি নেই। সম্ভবত আর কখনও টিভির পর্দায় সে তাকাবে না। অন্যদিকে টিভির জন্মের পর ধারণা করা হয়েছিল যে, কাগজ, রেডিও, সিনেমা এবং অন্য মাধ্যমগুলো হয়ত টিভির দাপটের কাছে টিকে থাকবে না। বিশেষ করে রেডিও টিভির দাপটের জন্য প্রচ- চাপের মাঝে পড়ে এবং সাম্প্রতিককালে এফএম রেডিওর জাগরণের আগে রেডিও প্রায় বিলুপ্তির পথেই চলে গিয়েছিল। অন্যদিকে কমিউনিটি রেডিও বিশেষায়িত কাজে বিশেষ অবদান রাখা শুরু করেছে। অন্যদিকে টিভি কাগজের বিকল্প হয়ে যায়নি। একটি সময় পর্যন্ত টিভির সম্প্রসারণের পাশাপাশি কাগজের গণমাধ্যম বিলুপ্ত না হয়ে বরং প্রসারিত হয়েছে। আরও ধারণা করা হয়েছিল যে, টিভির আবির্ভাবের ফলে সিনেমা হারিয়ে যাবে। বাংলাদেশে সিনেমা বিপন্ন হওয়ার প্রধানতম কারণ নিম্নমান ও পাইরেসি হলেও দুনিয়াজুড়ে সিনেমা একটি স্বতন্ত্র মাধ্যম হিসেবে এখনও কোন না কোনভাবে টিকে আছে। হলিউড বা বলিউডে এখনও সিনেমার সরব উপস্থিতি আছে। এমনকি ইউটিউব সিনেমার দর্শক বরং বাড়িয়েছে। এর সহজ হিসাবটা হলো, টিভি তার নিজের প্রভাব বাড়াতে পারলেও কাউকেই বিলুপ্ত করতে পারেনি। তেমন কোন ইচ্ছাও সম্ভবত টিভির ছিল না। কিন্তু এখন প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে যে, সামনের দিকে টিভি-রেডিও-কাগজ ইত্যাদি গণমাধ্যমের রূপান্তর কেমন করে হবে? কি রকম হবে? কতটা হবে? বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালে টিভির জন্ম হওয়ার পর সেটি নানাভাবে বিবর্তিত হয়েছে। প্রথমে সাদাকালো সরকারী টিভি ছিল। সেটি প্রচারিত হতো টেরিস্টরিয়াল পদ্ধতিতে। সরকারী চ্যানেল পিটিভি বা বিটিভি ছাড়া আর কারও এখনও টেরিস্টরিয়াল সম্প্রচারের অনুমতি নেই। মাঝখানে একুশে টিভির অনুমতি থাকার পরও সেটি বাতিল হয়েছে। সেই সময়ে এ্যান্টেনা দিয়ে টিভি সেটে টিভি দেখা যেত। পরে সেই টিভি স্যাটেলাইট সম্প্রচারে গেছে, রঙিন হয়েছে এবং বেসরকারী মালিকানায় বিপুল সংখ্যায় জন্ম নিয়েছে। এক সময়ে টিভি স্টুডিওকেন্দ্রিক থাকলেও এখন মাঠে-ময়দানে এবং তাৎক্ষণিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। টিভির যন্ত্রপাতিতেও নানা পরিবর্তন এসেছে। ফিল্ম, বিএনসি, ইউম্যাটিক, বেটা থেকে ডিভি-এইচডির প্রবহমান ধারায় এখন পুরোটাই ডিজিটাল প্রক্রিয়ার জয়জয়কার। তবে যে জায়গাটিতে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি সেটি হলো টিভি সেট। এক সময়ে ক্যাথোড রে টিউবভিত্তিক সাদাকালো টিভি সেট এখন বড়জোর এলসিডি-এলইডি ও কালার হয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড ১৯/২০ ইঞ্চির টিভি ৪২/৫২ বা তারও বেশি বড় হয়েছে। এ্যান্টেনার যুগ পার হয়ে এখন আমরা কেবল বা ডিশ ও ডিশ লাইন কিংবা ডিরেক্ট টু হোমের যুগে এসেছি। টিভি সম্প্রচার বিতরণের সর্বশেষ প্রযুক্তিটার নাম বোধ হয় ডিরেক্ট টু হোম। পাশের দেশ ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশেও সহসাই এই ব্যবস্থা চালু হবে বলে আমরা আশা করছি। অবৈধভাবে এই ব্যবস্থা অনেক বাড়িতেই চালু আছে। সহসাই বেক্সিমকো নামক একটি প্রতিষ্ঠান এই যন্ত্র বাজারজাত করবে বলে জানা গেছে। আপনি যদি ইন্টারনেটে টিভির ভবিষ্যত নিয়ে অনুসন্ধান করেন তবে দেখবেন কেউ বলছে টিভির ভবিষ্যত হচ্ছে মোবাইল ফোন। কেউ বলছেন টিভি মানে ইন্টারনেট বা কেউ বলছেন আরও নতুন কিছু। আমরা বাংলাদেশে এতসব ভাবি না। ফলে প্রচলিত ধারার সঙ্গে যতটা নতুনত্ব আসে তাতেই আমরা তৃপ্ত হই। আমাদের টিভি দেখা মানে মহিলাদের ভারতীয় সোপ অপেরা দেখা আর চায়ের স্টল ও আড্ডাখানাসহ বাড়ির পুরুষদের বাংলাদেশী টকশো দেখা। এজন্য ডিশের কেবল লাইন হচ্ছে একমাত্র বাহন। ঘরে ১৪ ইঞ্চি থেকে ৪২ ইঞ্চি আকারের টিভি যাতে সিআরটি, এলসিডি বা এলইডি থাকতেই পারে। কিন্তু অবস্থাটি এখন আর তেমন মনে হচ্ছে না। গত ৪ মে ২০১৫ দৈনিক প্রথম আলো ছোট একটি খবর ছাপে। খবরটি এরকম- “মাঠে তখন চলছে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের তৃতীয় ওয়ান ডে। আর ক্রিকেটের ভক্ত সুমন কিনা বসে আছে বাসে, আটকে গেছে যানজটে। সাধারণত জগন্নাথ হলের টিভি রুমেই বন্ধুদের নিয়ে হই-হুল্লোড় করে দেখে খেলা। কিন্তু আজ হলে ফিরতে দেরিই হয়ে যাবে, যে যানজট রেডিওতে ধারাভাষ্য শুনছেন ঠিকই; কিন্তু এতে কি আর দেখার সাধ মেটে? এমন সময় ফেসবুকের একটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘মোবাইল টিভি’ সম্পর্কে ধারণা পান সুমন। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গেই সেটা চালু করে নিলেন। বাসের সবাই মিলে জ্যামে বসেই সাক্ষী হলেন আরেকটি বাংলাওয়াশের। কী এই মোবাইল টিভি? টুজি বা থ্রিজি মোবাইল সংযোগ ব্যবহার করে দেশের যে কোন স্থানে যে কোন সময় মোবাইলের নির্দিষ্ট এ্যাপ ব্যবহার করে মোবাইল ফোনেই টিভির সব অনুষ্ঠান দেখার প্রযুক্তি হলো মোবাইল টিভি। এই সেবা দিচ্ছে মিডিয়াকম লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সম্পর্ক বিভাগের এ্যাকাউন্ট সুপারভাইজার খন্দকার আহসানুজ্জামান বলেন, ‘মোবাইল টিভির কল্যাণে বিনোদন এখন পুরোপুরি হাতের মুঠোয় যে কোন জায়গায় যে কোন সময়।’ তিনি জানান, বাংলালিংক, রবি, টেলিটক ও এয়ারটেলের সিম ব্যবহার করে উপভোগ করা যাবে মোবাইল টিভি। জাভা, এ্যান্ড্রয়েড, আইওএস- চালিত ফোনে চলবে এটি। নির্ধারিত ফির বিনিময়ে নিবন্ধন করতে হবে। এজন্য দিতে হবে বাংলালিংক:/(মাসিক ৪০ টাকা), টেলিটক:/(মাসিক ৮০ থেকে ১৮০ টাকা), রবি:/(মাসিক ৫০ টাকা), এয়ারটেল:/(মাসিক ৭২ টাকা)। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠান ছাড়াও এতে দেখা যাবে ধারণকৃত নাটক, ছবি, টেলিফিল্ম, মিউজিক ভিডিওসহ ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান। তবে সরাসরির বেলায় কেবল টিভির চেয়ে ২ সেকেন্ড পরে দেখা যাবে অনুষ্ঠান। খবরটি ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। সুমন বোধ হয় একা নয়, অনেকেই তার হাতের মুঠোফোনে টিভি দেখে। তবে এটি বোঝার বিষয় আছে যে, টিভি দেখার যন্ত্রটা টিভি সেট থেকে মোবাইল ফোনে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। আরও একটি বিষয় চোখে পড়ার মতো যে, মোবাইল অপারেটররা টিভি সেবা প্রদান করা শুরু করেছে। মোবাইলে যখন বিনামূল্যে কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে তখন কথা বলার মোবাইল নেটওয়ার্কের জন্য এমন পথে চলা শুরু করাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। মোবাইল যন্ত্রটি রেডিও শোনার, ছবি তোলার যন্ত্র হয়েই আছে। ইন্টারনেট ব্রাউজ করা ও নানাবিধ কাজে একে ব্যবহার করার এক অসাধারণ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে এই যন্ত্রটির। ফলে ডিজিটাল সভ্যতার ডিজিটাল যন্ত্র বলতে আমরা সবচেয়ে জনপ্রিয় হিসেবে মোবাইলকেই শনাক্ত করতে পারি। মোবাইলের আকার কেমন হবে, এটি এ্যাপলের আইফোন থাকবে, না স্যামসাঙের গ্যালাক্সি হবে, না ট্যাবলেট হবে এসব নিয়ে অনেক লম্বা বিতর্ক হতে থাকবে। কেউ ট্যাবলেটকে ল্যাপটপের বিকল্প বানাবেন, কেউ স্মার্ট ফোনকে ট্যাবলেটের বিকল্প বানাবেন। তবে সম্ভবত কিছু মৌলিক বিষয় এমন হবে যে, স্মার্ট ফোন ও ট্যাবলেটে (হয়ত ল্যাপটপেও) সিম ব্যবহারের সুযোগ একটি অতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। ওয়াইফাই-ব্লুটুথ নিয়ে কথা বলার দরকারই নেই। ঘটনাটি সম্ভবত কেবল মোবাইলে টিভি দেখাতেই সীমিত হয়নি। বাংলাদেশে যারা টিভি দেখেন তারা টিভি কেন্দ্রগুলোর স্ক্রলবারে দেখেন যে, র‌্যাডিয়্যান্ট আইপি টিভি নামের একটি এ্যাপ দিয়ে ইন্টারনেট থেকেও টিভি দেখা যায়। এর মানেটি খুবই সহজ। আপনি ইন্টারনেটে যুক্ত থাকলেই টিভি আপনার হাতের মুঠোয়। ইদানীং ইন্টারনেটভিত্তিক টিভি পাওয়া যায়। ফলে টিভি সেটেও ইন্টারনেটের টিভি পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বেশকিছু টিভি কেন্দ্র নিজস্ব এ্যাপ বাজারে ছেড়েছে। সেটি দিয়েও সেই টিভির পর্দা ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। একই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে আমি কথা বলছিলাম কয়েকজন তরুণের সঙ্গে। ওরা বাংলাদেশে বসে এ্যাফিলিয়েটেড মার্কেটিং করে। ওদের ব্যবসার খবর জানতে গিয়ে বোঝা গেল ওরা প্রধানত আমেরিকার টিভি দর্শকদের জন্য খেলার বিষয়গুলোর মার্কেটিং করে। আমেরিকান টিভি চ্যানেলগুলোর স্ট্রিমিং ভিডিও ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইটে টাকার বিনিময়ে সম্প্রচার করা তাদের ব্যবসা। তাদের মতে আমেরিকানরা আমাদের মতো ডিশ লাইনে বা সেটটপ বক্সে টিভি দেখা এ্যাফোর্ড করতে পারে না। ওদের জন্য সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেট। (চলবে)
×