ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দাবদাহ

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ১ মে ২০১৬

দাবদাহ

দুর্বিষহ গরম-খরা-অনাবৃষ্টিতে উষ্ণ বিস্তীর্ণ এলাকা। যেখানেই রাখে হাত সেখানেই দাবদাহ। তপ্তদহনে মাটি ফেটে চৌচির। বাতাসে যেন আগুনের হলকা। ১৩৭ বছরের ইতিহাসকে ম্লান করে দিয়ে গরম তার বাহু এমনভাবে প্রসারিত করেছে যে, ওষ্ঠাগত প্রাণীজীবন। হাঁসফাঁস করছে মানুষ। তীব্র অসহনীয় গরমে অতিষ্ঠ দেশবাসী, প্রাণিকুল ও ক্ষেতের ফসল। মরু অঞ্চলের মতো লু হাওয়া বইছে যেন। প্রতিনিয়ত বাড়ছে তাপমাত্রা। সেইসঙ্গে পানির সঙ্কট। প্রকৃতির এমন উত্তপ্ত হয়ে ওঠার বিপরীতে কারোই যেন কিছু করার নেই। দিনমজুর, শ্রমিক শ্রেণী, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের অস্বস্তিকর এই খরায় ‘প্রাণবায়ু যায় যায়’ অবস্থা। এই দাবদাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রোগ ছড়িয়ে পড়ছে মানবদেহে। ডায়রিয়া, জ-িস, নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য রোগের প্রকোপ যেমন বাড়ছে, তেমনি হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে কেউ কেউ। আকাশে মাঝে মাঝে মেঘ ভাসে; কিন্তু বৃষ্টি আর নামে না। বোশেখের মাসটি দেশের সবচেয়ে উষ্ণতম মাসে পরিণত হয়েছে। সূর্যের অবস্থান দিনের বেলা একেবারে মাথার ওপরে। দিনের চেয়ে এমনিতে রাত্রির ব্যাপ্তিকাল কম হওয়ায় ওপরের বায়ুম-ল ঠা-া হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে কম। ফলে রাতেও গরম বেশ অনুভূত হচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিশাল এলাকাজুড়ে এই সময়ের স্বাভাবিক বৃষ্টিটুকুও হচ্ছে না। এই সময়ে সাধারণত বঙ্গোপসাগর থেকে দখিনা বাতাস দেশের ভূÑখ-ে প্রবেশপূর্বক বজ্রবৃষ্টি সৃষ্টি করে থাকে। এবার হঠাৎ করে পশ্চিমা বায়ু এই সময়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ওই দখিনা বায়ুকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ফলে ওই এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছে অথচ বাকি এলাকায় শুষ্ক আবহাওয়া, যেখানে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ, ভারত নয়, বিশ্বের অনেক দেশই গরমে পুড়ছে, পানি ও খাদ্য সঙ্কটে ভুগছে। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের তুলনায় ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামে গরম-খরা-অনাবৃষ্টিতে জনজীবন, কৃষি সবই বিপন্ন-বিপর্যস্ত। পানি সঙ্কটও তীব্রতর। সর্বত্র গরমের রেকর্ড অতীতকে ছাড়িয়ে গেছে। বৃষ্টির কোন দেখা নেই। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ‘এল নিনো’র কবলে এখন বিশ্ব। এর প্রভাবে উষ্ণতা বাড়ছে। তাই চলতি বছরটি হতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। জলবায়ু পরিবর্তনের বিশাল ধকলে আক্রান্ত পৃথিবীর বহু স্থান। এল নিনোর প্রভাবে উত্তাপ বাড়ছে এবং তা আরও শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখাবে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এল নিনোর প্রভাবে জলবায়ুর মারাত্মক পরিস্থিতির শিকার হয়েছে বিশ্বের প্রায় ৬ কোটি লোক। এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। এল নিনো হচ্ছে বায়ুম-লীয় এবং গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলের সমুদ্রগুলোর মধ্যে একটি পর্যায়বৃত্ত পরিবর্তন। এর প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার লক্ষণ এবং আবহাওয়ার নিয়মিত ধরনগুলোতে পরিবর্তন দেখা দেয়। এল নিনো হচ্ছে পর্যায়বৃত্তের উষ্ণ পর্যায় এবং তা বন্যা, খরা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই এ বছর ব্যাপক খরা এবং খাদ্য ও পানি সঙ্কটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে পৃথিবী। তাই ক্ষুধা ও রোগ-বালাইয়ের প্রকোপও বাড়বে। বাংলাদেশে শত শত শিশু ও বৃদ্ধ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে। গ্রামীণ মাঠ-ঘাট, ক্ষেত-প্রান্তর ফেটে চৌচির। নদ-নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, ধুলোবালি, ওজোন গ্যাস, সালফার ডাই অক্সাইড ইত্যাদির পরিমাণ বাড়ছে ক্রমাগত। মহাসাগরীয় স্রোতে পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিবেশী ভারত সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দাবদাহে। গরমের কারণে বিহারে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যার মধ্যে রান্না বন্ধ। তা অমান্য করলে ২ বছরের জেল। গরম এমন পড়েছে যে, তেলেঙ্গানায় ঘরের মেঝেতে ডিমের ওমলেট করার ঘটনাও ঘটেছে। দাবদাহের প্রভাব ঠেকানোর জন্য সরকারের কোন দফতর নেই। তাই এর সম্পর্কে জনসচেতনতাও তৈরি করা হচ্ছে না। পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করা না গেলে বৈশ্বিক উষ্ণতার ধকলে পড়বে বিশ্ববাসী। গরমের তীব্রতা মেনে তবুও চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে যেতে হবে বৃষ্টির আর বর্ষা মৌসুমের।
×