ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল মালেক

বিষোদগার তুঙ্গে ॥ আক্রমণের ভাষায় সতর্ক হিলারি

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ১ মে ২০১৬

বিষোদগার তুঙ্গে ॥ আক্রমণের  ভাষায় সতর্ক হিলারি

রাষ্ট্রপতি পদে রিপাবলিকান দলের মনোনয়নপ্রার্থী রিয়ালস্টেট মোগলের সামনের পথটি বড় একটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সেটা বোঝা যাচ্ছিল শুক্রবার সানফ্রান্সিসকোতে উগ্র-প্রতিবাদকারীরা যখন অপেক্ষা করছিল ট্রাম্পের অবতরণের অপেক্ষায়। তাদের বিক্ষোভে পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে যে, ধনকুবেরকে গোপনে পেছনের দরজা দিয়ে সশস্ত্র পাহারায় বের করা হলো। পায়ে হেঁটে ভিন্ন একপথ অতিক্রম করে তিনি সম্মেলন স্থলে গেলেন। আগের দিনও ক্যালিফোর্নিয়ায় তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীরা এক মারমুখী সমাবেশ করে। জনতা দরজায় লাথি মেরে, পেছনের জানালা দুমড়ে-মুচড়ে পুলিশকারের ছাদের ওপরে উঠে যায়। রায়ট পুলিশ এ্যাকশনে গিয়ে তাদের সরিয়ে দেয় রাস্তায়। মাত্র কদিন আগেই চিত্রটা ছিল ভিন্ন। ওয়াশিংটনের একটি হোটেলের বলরুমে ঝাড়বাতির মিটি মিটি ঔজ্জ্বল্যে রাষ্ট্র নায়কোচিত কণ্ঠে, আমেরিকার এই বিলিয়নিয়ার রাষ্ট্রপতি প্রার্থী দেশের ভবিষ্যত পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে যেভাবে বক্তৃতা করলেন সেটা বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। নানা সূত্রে জানা যায়, ডোনাল্ড এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এই বক্তৃতার জন্য কাজ করেছেন। ট্রাম্প তার ভাষণের মাধ্যমে বন্ধু এবং মিত্র রাষ্ট্রদের চোখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরও নির্ভরযোগ্য, এমনকি শত্রুদের কাছেও সম্মানিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দেশবাসীকে। নবনিযুক্ত ক্যাম্পেইন উপদেষ্টা পল ম্যানেফার্থ অবশ্য বলেছেন, এই স্পিচের কথাগুলো এবং চিন্তাচেতনা সবই ডোনাল্ডের নিজস্ব। বক্তৃতাকালে তার আক্রমণধারা নমনীয় হয়েছিল নিউইয়র্ক প্রাইমারির ভিক্টোরি স্পিচেই। তিনি গঠনমূলক বক্তৃতা দিলেন সেখানে। লোকে বলল ট্রাম্প এবার বদলে গিয়ে ‘হবু প্রেসিডেন্ট’ সুলভ আচরণ করছেন। কম বেশি অনেকেরই পড়া আছে মুখরারমণী বশীকরণের গল্পটি। কিন্তু মুখরপুরুষ বশীকরণের কোন গল্প আজ অবধি লেখা হয়েছে কি? বর্তমানে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পটভূমিতে চেষ্টা হলো সেই রকমই একটা গল্প লেখার। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে রিপাবলিকানদের নিত্যনতুন চলন-বলন সত্যিকার অর্থে ভিন্নতা এনেছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনী মঞ্চটি। যেমন বৃহস্পতিবার বিকেলে যা ঘটল সেটা টক অব দ্য কান্ট্রি হয়ে থাকবে অনেকদিন। ‘হোয়াট এবাউট টেড ক্রুজ?’ সাবেক স্পীকার জন বেনার বক্তৃতা শেষ করে স্ট্যাম্পফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের কাছ থেকে এমন প্রশ্নটি পেয়েই মুখ খুললেন ফটাস করে ‘হি ইজ এ লুসিফার অব দি ফ্লেশ!’ অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ অভিধানে লুসিফার হলো শয়তানের অপর এক নাম। সুতরাং ডাকসাইটে সাবেক স্পীকারের ভাষায় সিনেটর ক্রুজ হলেনÑ ‘মনুষ্য শরীর নিয়ে একজন পাক্কা শয়তান’ এবং এখানেই শেষ নয়। বেনার অকথ্য উচ্চারণে আরও বললেনÑ ‘আমার অনেক ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান’ বন্ধু আছে কিন্তু এ রকম ‘সান অফ এ বিচ ...!’ প্রতিযোগী হিসেবে সিনেটর টেড ক্রুজতো ভোটের অঙ্কে বাদ পড়েছেন বলা যায়। তারপরও যেন আঠার মতো লেগে আছেন অদ্যাবধি। তার মধ্যে হিউলিন্ড প্যাকার্ডের সিইওকার্লি ফারিনাকে ঘোষণা দিলেন তার রানিংমেট অর্থাৎ ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে। বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ ‘ল্যাঙ্গুটের আবার নাকি বুকপকেট’ সেইটি কি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য? ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় দলের ফ্রন্ট রানার হিলারি ক্লিন্টন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৬ এপ্রিল মিনি টুইসডে প্রাইমারিতে জিতে যাওয়ার পর মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন বলে অনেক ভোটার মনে করেন। কানেকটিকেট, রোড আইল্যান্ড, পেনসিলভেনিয়া, মেরিল্যান্ড ও ডেলওয়ার- এই পঞ্চ রাজ্যে ট্রাম্পের নিরঙ্কুশ বিজয় এবং ক্লিন্টনের ৪টি রাজ্য জয় উভয় প্রার্থীকে তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী যথাক্রমে টেড ক্রুজ এবং বার্নি স্যান্ডার্সের চাইতে ডেলিগেটস সংখ্যায় বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে দিয়েছে। এখানে একটা কথা খোলাসা করা প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে পাবলিকের মিলিয়ন মিলিয়ন ভোটে জিতলেও যিনি জিতেছেন তিনি কিন্তু আলেকজান্ডার হবেন না। প্রার্থীদের জন্য মূল ভাগ্য নির্ণায়ক হলো জাদু প্রদীপ হাতে ডেলিগেটস নামক ব্যক্তিবর্গের ব্যালটের পরিমাণ আর সেটাই ম্যাজিক নম্বর। এ পর্যন্ত হিলারির ডেলিগেটস প্রাপ্তি নম্বর হলো ২১৩৮। তাকে আরও ১৮% ডেলিগেটস পেতে হবে। হিলারি যে সামনের দৌড়ে সংখ্যাগুলো অনায়াসে ছুঁতে পারবেন সে বিষয়ে অনেকেই নিশ্চিত। নিউইয়র্ক প্রাইমারিতে বিরাট বিজয়ের পর মিনি টুএসডেতে ট্রাম্প আবার জয়ের ধারায় ফিরে এসেছেন। এখন অতি সহজেই ম্যাজিক নম্বর ১ হাজার ২৩৭ ডেলিগেটস পাবেন বলে তিনি আশাবাদী। অঙ্কের হিসেবে বর্তমানে ৯৯২ ডেলিগেটস তিনি পেয়েছেন এবং আরও পেতে হবে ২৪৫ ডেলিগেটস। তবে তিনি যদি সাড়ে এগারো শ’ পান তাহলেও হয়তো সম্ভব হবে। কারণ রিপাবলিকান দলে রয়েছে ১০০ নন প্লিজড ডেলিগেটস। ম্যাজিক সংখ্যার মধ্যেই রয়েছেন এই অনির্বাচিত নন প্লিজড ডেলিগেটস। যারা কারও প্রতি কমিটেডও নন। ট্রাম্প তাদের সমর্থন লাভে সচেষ্ট হবেন সেটাই স্বাভাবিক। এদিকে তেমন একটা জয় না পেয়েও ওয়াহিও রাজ্যের গবর্নর জন কেসিক কি আশায় রেসের বালুচরে খেলাঘর বাঁধছেন সে উদ্দেশ্যটা এতদিন বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু গত মিনি টুইসডে প্রাইমারির আগে তিনি যখন দলীয় মনোনয়ন ভোটের অগ্রবর্তী প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে থামাতে চুক্তিবদ্ধ হলেন টেড ক্রুজের সঙ্গে তখন কেসিকের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হলো। এই শর্ত অনুসারে সামনের প্রাইমারিগুলোতে ক্রুজ ও কেসিক পরস্পরের পথে কাঁটা না হয়ে বরং এগিয়ে দেবেন গোলাপ। এই বিষয়ে ক্রুজ শিবির তাদের একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, চুক্তি অনুসারে সিনেটর ক্রুজ ইন্ডিয়ানা প্রাইমারিতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য নির্বাচন করবেন এককভাবে এবং কেসিক সেখানে লড়বেন না। অরেগন ও নিউ মেক্সিকো যে দুই রাজ্যে কেসিক ভাল ফল করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে সেখানে তিনিই ক্রুজের বদলে এককভাবে অবতীর্ণ হবেন ট্রাম্পযুদ্ধে। বলাবাহুল্য, ৩ মে ইন্ডিয়ানায়, ১৭ মে অরেগনে এবং ৭ জুন নিউ মেক্সিকোতে রিপাবলিকান প্রাইমারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ক্লিভল্যান্ড রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে ট্রাম্প প্রয়োজনীয় ডেলিগেট যাতে না পান সে জন্যই এই চেষ্টা। মিনি টুইসডের চার স্টেটে বিপুল জয়লাভ করবার পর হিলারি আছেন অত্যন্ত ফুরফুরে মেজাজে। এর আগে নিউইয়র্ক প্রাইমারিটিকে তিনি নিয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ লড়াই হিসেবে। কারণ জানতেন মনোনয়নপ্রার্থী বাছাইপর্বে এই রাজ্যের ফল মূলত তার জন্য হতে যাচ্ছে দেয়াল লিখন। অবশেষে আমেরিকার এম্পায়ার স্টেট প্রাইমারিতে জয়লাভ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য নিঃসন্দেহে এক হিউজ শিফট হয়ে গেল। ডেমোক্র্যাট দলের নেতৃত্বের পর থেকেই সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সকে র্নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে সরে যেতে চাপ প্রয়োগ করছে। কিন্তু তিনি ক্যালিফোর্নিয়া প্রাইমারি পর্যন্ত যাবেন সেই মতে অটল। নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে বার্নি বলেছেন, তার সরকার হবে সকলের, কেবল এক পার্সেন্টে ধনী শ্রেণীর জন্য নয়। ফ্রি উচ্চশিক্ষা, সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং ঘণ্টাপ্রতি মজুরি বৃদ্ধির মতো আরও অনেক জনকল্যাণমূলক কর্মসূচীর কথা সেখানে আছে। বার্নির ভাষায়, ‘এই পলিটিক্যাল রেভুলেশনের’ বাণী তিনি নির্বাচনী প্রচারণার মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে দিতে চান আমেরিকার জনগণের দুয়ারে দুয়ারে। এই দেশের নারীকুলের মধ্যে বহুসংখ্যক আশা করেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ইতিহাসে এবার একজন নারীর আগমন ঘটবে। বহু নামী-দামী নারীরা সমর্থন ব্যক্ত করেছেন তার প্রতি। হলিউড অভিনেতা জর্জ ক্লুনির স্ত্রী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী আমেল ক্লুনি তাকে সমর্থন করেছেন। তাছাড়া ক্লিন্টনদের আর একটি প্লাস পয়েন্ট হলো কালোদের সমর্থন। জীবনের নানা কর্মকা-ে তারা জড়িয়ে রয়েছেন কালোদের সঙ্গে। বিল সাহেবের অফিস কৃষ্ণাঙ্গদের ঐতিহ্যময় এলাকা হার্লেমে। ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের মধ্যে এই সমস্ত ভোটাররা হিলারিকেই অধিকতর পছন্দ করেন। ডেমোক্র্যাট দলের স্টাবলিশমেন্টের সমর্থনও তার প্রতি লক্ষণীয় । হিলারি পরিবারের সঙ্গে ডোনাল্ডের অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল একসময়। তাদের মেয়েরা এখনও পরস্পরের বন্ধু। মেলোনিয়ার-ডোনাল্ড বিবাহের সময় ক্লিন্টন দম্পতি ছিলেন বিশেষ অতিথি। কিন্তু হিলারিকে তার প্রচারণার শুরু থেকেই ট্রাম্প বলেছেন মিথ্যেবাদী। তার কাছ থেকে অনেক নামেই ভূষিত হয়েছেন তিনি। নিউইয়র্ক নির্বাচনকালে ট্রাম্প তাকে বিশেষায়িত করেন ‘ক্রুকেট হিলারি’ হিসেবে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বরাবরই হিলারি একই উত্তর দিয়েছেন- ‘আমার শরীরের ত্বক অনেক মোটা। যে যেমন মানুষ সে তো তেমনি ভাষায় কথা বলবে। তাই এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না।’ তার স্বামী প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন একজন সুবক্তাÑ কাজ করছেন স্ত্রীর প্রচারণায়। হিলারি তাই ট্রাম্পের মতো রিয়্যালিটি টিভি স্টারের দেখানো পথটি বেছে না নিয়ে বুদ্ধিমতীর মতো অনুসরণ করছেন বিলকেই। হিলারি তার ‘নারী’ কার্ড ব্যবহার করে ভোট জিতছেন বলে ট্রাম্প নতুন ধুয়া তুলে বলছেনÑ পুরুষপ্রার্থী হলে হিলারির পক্ষে ৫% এর বেশি ভোট পাওয়া সম্ভব হতো না। হিলারির জবাব নারীদের সমান বেতন এ রকম অনেক এজেন্ডাই আছে আমার। তিনি আরও বলেছেন, আমি ইকোনমি, এ্যাডুকেশন, হেলথ কেয়ার, ফরেন পলিসি নিয়ে কি কাজ করতে চাই তাতে কোন লুকো ছাপা নেই। শুরু থেকেই হিলারি আক্রমণের ভাষার প্রতি সতর্ক ছিলেন। কিন্তু সেদিন নিজ রাজ্যের বিজয় শেষে এক প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্পকে আখ্যা দিয়ে ফেললেন ‘ডাংকি অব দ্য ডিকেড।’ বিষদগারে রিপাবলিকান প্রার্থীর জুড়ি মেলা ভারÑ তিনিও নতুন ভাষায় আক্রমণ করে যাবেন প্রতিদ্বন্দ্বীকে। এখন দেখা যাক আক্রমণের এই ধারা গড়ায় কোন দিকে। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও সংবাদ বিশ্লেষক।
×