ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তেল শোধনাগার স্থাপনে ১০ হাজার কোটি টাকা চাইবে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৩০ এপ্রিল ২০১৬

তেল শোধনাগার স্থাপনে ১০ হাজার কোটি টাকা চাইবে বাংলাদেশ

তৌহিদুর রহমান ॥ বাংলাদেশে তেল শোধনাগার স্থাপনে কুয়েতের কাছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে আরও জনশক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়ে প্রায় হাফ ডজন চুক্তির প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী জাবের আল মুবারক আল হামাদ আল সাবাহর ঢাকা সফরকালে এসব চুক্তি সই হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে মুসলিম দেশের দৃঢ় পদক্ষেপের বিষয়েও বাংলাদেশ-কুয়েতের মধ্যে আলোচনা হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে জনশক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার পরিধি বাড়াতে ঢাকা সফরে আসছেন কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি আগামী ৩-৫ মে তিন দিন ঢাকা সফর করবেন। কুয়েতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর সামনে রেখে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। মধ্যপ্রাচের বিভিন্ন দেশ থেকে তেল আনার পর সেই তেল শোধন করার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে একটি অত্যাধুনিক তেল শোধনাগার স্থাপিত হলে তেল আমদানি করে পরিশোধন করলে খরচ অনেক কমে আসবে। পাশাপাশি অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হবে। সে কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি বড় ধরনের অত্যাধুনিক তেল শোধনাগার স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশের। এই তেল শোধনাগার করতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। কুয়েত সরকার রাজি হলে, দুই দেশই এ তেল শোধনাগারের মাধ্যমে লাভবান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে একটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল স্থাপনে কুয়েতের সহযোগিতা চাওয়া হবে। দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে চারটি এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে মহেশখালীতে দেশের প্রথম এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তিও সই হয়েছে। তবে বাংলাদেশ এখন আরও তিনটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করতে চায়। এর মধ্যে একটি টার্মিনাল নির্মাণে কুয়েতের সহায়তা চাইবে। এছাড়া বাংলাদেশে প্লাস্টিক শিল্পে কুয়েতের বিনিয়োগের সহায়তা চাওয়া হবে। কুয়েত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ একটি শ্রমবাজার। তবে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা শুরু হওয়ার পর থেকে গত কয়েক বছর ধরে দেশটিতে বাংলাদেশী শ্রমিক যাওয়ার হার কমে গেছে। ১৯৭৬ থেকে এ পর্যন্ত ৫ লাখ ৫ হাজার ৪৭ বাংলাদেশী শ্রমিকের কুয়েতে কর্মসংস্থান হয়েছে; যার মধ্যে প্রায় ৭ হাজার ৬৫৮ জন নারী। ২০০৬ সালেও দেশটিতে ৩৫ হাজার ৭৭৫ জন বাংলাদেশী শ্রমিক প্রবেশ করে। তবে দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ধীরে ধীরে শ্রমিক পাঠানো কমে যায়। এ সংখ্যা এখন বাড়াতে চায় সরকার। নতুন করে জনশক্তি রফতানির বিষয়ে দুই দেশ আবার একমত হয়েছে। জনশক্তির রফতানির বিষয়ে একটি চুক্তি হতে পারে। সূত্র জানায়, কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী এশিয়ার পাঁচ দেশ সফরের অংশ হিসেবে প্রথমেই ঢাকায় আসছেন। বাংলাদেশের পর পর্যায়ক্রমে দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, জাপান ও হংকং সফর করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী এ সফর করছেন। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ, কুয়েতের অর্থায়নে তেল শোধনাগার স্থাপনসহ অন্যান্য বিষয়েও আগ্রহ দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। জনশক্তি রফতানি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে কুয়েতের অর্থায়নকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেট আইএস উত্থানের পর মুসলিম দেশগুলো একযোগে কিভাবে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ করতে পারে, সে বিষয়েও আলোচনা হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, কুয়েতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির বিষয়ে এখনও আলোচনা চলছে। বেশ কয়েকটি চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে এসব চুক্তির মধ্যে কোনটি কোনটি চূড়ান্তভাবে স্বাক্ষর হবে সেটা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এখনও আলোচনা চলছে। কুয়েতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন বাংলাদেশ সফরকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ১৯৭৩ সালে কুয়েত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তারপর এই দুই মুসলিম দেশের মধ্যে বিভিন্নভাবে সহযোগিতার দৃঢ়ভিত্তিতে পরস্পরের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেই আস্থা এখনও অটুট রয়েছে। এর আগে দুই দেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুয়েত সফর করেন। এশীয় সহযোগিতা সংলাপ (এসিডি) বৈঠকে যোগদানের জন্য শেখ হাসিনা ওই সফর করেন। তখন আঞ্চলিক সম্মেলনের পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও হয়েছিল। কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী জাবের আল মুবারকের এটা ফিরতি সফর। ফলে কুয়েতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরকালে ওই সময়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে। উপসাগরীয় যুদ্ধের পর কুয়েত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তির অধীনে কুয়েত পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীসহ সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা দেশটিতে কাজ করেছেন। এভাবেই দুই ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারপর বাংলাদেশের জনশক্তি মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশটিতে পাঠানো হয়। রাশিয়া ও ইরান অব্যাহতভাবে তেল উত্তোলনের ঘোষণা দেয়ায় বিশ্ববাজারে তেলের দাম পড়তে শুরু করেছে। আগামী তিন-চার বছর বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যের এই পতন অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ কুয়েত এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণে আগ্রহী। কম মজুরিতে দক্ষ কর্মী পাওয়া কুয়েতের অর্থনীতির জন্য অগ্রাধিকার হওয়ায় এমন কর্মী পাওয়ার জন্য বাংলাদেশই সবচেয়ে ভাল স্থান বলে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি মনে করে। এ কারণেই প্রধানমন্ত্রী জাবের আল মুবারক আল হামাদ আল সাবাহর এ সফর বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। প্রাথমিক কর্মসূচী অনুযায়ী, কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী জাবের আল মুবারক আল হামাদ আল সাবাহ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন। এছাড়া তিনি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করতে পারেন। তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ রাষ্ট্রীয় অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দেবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুয়েতের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করবেন। ৩ মে দুপুর বারোটায় একটি বিশেষ বিমানে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছবেন কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীরা। কুয়েতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সে দেশের ব্যবসায়ীদের একটি বড় প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসছে। এ সময় বাংলাদেশের শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই এবং কুয়েতের কেসিসিআইয়ের একটি যৌথ সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এতে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যতে সম্ভাবনার দিকও তুলে ধরা হবে। কুয়েতে বর্তমানে দুই লাখের বেশি বাংলাদেশী কর্মী কর্মরত আছেন। দেশটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষক, তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী, প্রকৌশলী, ডাক্তার, নির্মাণ শ্রমিক নিয়োগ করতে আগ্রহ দেখাতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
×