ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আন্তঃজেলা রুটে পরিবহন ভাড়া কমছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৩০ এপ্রিল ২০১৬

আন্তঃজেলা রুটে পরিবহন ভাড়া কমছে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ জ্বালানি তেলের দাম কমানোর পর গণপরিবহনের ভাড়া কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে পরিবহন ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটিকে একটি খসড়া প্রস্তাব দেয়ার মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, গণপরিবহনের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে মাত্র ৩ পয়সা করে কমানো হবে। আর সর্বোচ্চ ভাড়া কমবে ১৪ টাকা। আগে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ছিল ১ টাকা ৪৫ পয়সা। বর্তমানে তা ১ টাকা ৪২ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে বৈঠকে বসবে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি। এরপর তা চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এদিকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে পরিবহন মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের বৈঠকের জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। আগামী ২ মে সকাল ১১টায় বিআরটিএ এলেনবাড়ি কার্যালয়ে গণপরিবহনের ভাড়া কমানোর বিষয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)-এর আওতায় সাত জেলায় পরিবহনের ভাড়া কমবে না। এসব জেলাসমূহের মধ্যে রয়েছে, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ ও নরসিংদী। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এসব জেলায় ঢাকার নির্ধারিত ভাড়ায় পরিবহন চলাচল করবে। এ ব্যাপারে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক সাংবাদিকদের বলেছেন, জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহন ভাড়া কমানোর বিষয়ে ভাড়া নির্ধারণ কমিটিকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা ব্যয় বিশ্লেষণ করে একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে দূরপাল্লা বাসের ভাড়া কমানো হচ্ছে বলে জানান তিনি। আন্তর্জাতিক বাজারে অব্যাহত তেলের দর পতনের পর থেকেই বাংলাদেশে তেলের মূল্য কমানোর দাবি ওঠে। এক পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় তিন দফায় তেলের মূল্য কমানো হবে। এরি ধারাবাহিকতায় গত ২৫ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে কমানো হয়েছে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। পেট্রোল ও অকটেনের মূল্য লিটারপ্রতি কমানো হয়েছে ১০ টাকা। কেরোসিন ও ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি কমানো হয়েছে তিন টাকা। তেলের মূল্য কমানোর ঘোষণার পরদিন থেকেই গণপরিবহনের ভাড়া কমানোর দাবি ওঠে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে তেলের মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিবহন ভাড়া কমানো হোক। যদিও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী অনেক আগেই বলেছেন, তেলের দাম কমলে পরিবহনের ভাড়াও কমানো হবে। লিটারপ্রতি এক টাকা তেলের দাম কমলে কিলোমিটারপ্রতি এক পয়সা ভাড়া কমানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে দুই দফায় ডিজেলের দাম ১১ টাকা কমানো হয়। সে সময় পরিবহনের ভাড়া ১১ পয়সা কমানো হয়। তখন থেকেই জ্বালানির মূল্য এক টাকা হ্রাস পেলে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রী ভাড়া এক পয়সা কমানোর প্রক্রিয়া চালু হয়। তবে ২০০৯ সালে আরেক দফা তেলের মূল্য কমানো হয়ছিল বলে জানা গেছে। ২০১১ ও ২০১৩ সালে দুই দফায় ডিজেলের মূল্য ১৫ টাকা বৃদ্ধি পাওয়ায় দূরপাল্লার ভাড়া বৃদ্ধি পায় ২৫ পয়সা। তাই ভাড়া কমানোয় এবারও ব্যয় বিশ্লেষণ বিবেচনা করা না হতে পারে। কারণ বিশ্লেষণে বিবেচ্য ২২টি উপাদানের মধ্যে গত তিন বছরে জ্বালানি ছাড়া সব ব্যয়ই বেড়েছে। এতে ব্যয় বিশ্লেষণে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া খুব একটা কমানোর সুযোগ না থাকার কথা বলছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। তাই পূর্বের পদ্ধতিতেই এক পয়সা হারে ভাড়া কমানো হতে পারে। গণপরিবহনের ভাড়া কমানো প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শ্যামলী পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, পরিবহন ভাড়া কামানোর বিষয়ে আমি একমত। তিনি বলেন, যখন তেলের দাম বাড়ে তখন আমরা ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানাই। এখন তেলের দাম কমেছে। সব মহল থেকেই দাবি উঠেছে ভাড়া কমানোর। এমন দাবি কোনভাবেই অযৌক্তিক হতে পারে না। পরিবহনের ভাড়া কমানো হলে সাধারণ মানুষের উপকার হবে। ভাড়া নির্ধারণী বৈঠকের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী দুই মে বিআরটিএ পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। সেখানে ভাড়া কত কমানো যায় এ নিয়ে মালিকদের মতামত নেয়া হবে। তিনি ব্যক্তিগত মতামত প্রসঙ্গে বলেন, আমরা চাই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে যৌক্তিক ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করা হবে। যেন মালিকদের ক্ষতি না হয়। যাত্রীরাও লাভবান হতে পারেন। তিনি বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিলে আমরা সে অনুযায়ী যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করব। সরকারী নির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গে দূরপাল্লার গাড়ি ভাড়া কমানোর কথা জানান তিনি। একুশে পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুদ্দিন ফরহাদ জানান, তাদের ঢাকা-নোয়াখালী রুটে একটি বাসের যাওয়া-আসা মিলিয়ে এক শ’ লিটার ডিজেল খরচ হয়, যার দাম আগে ছিল ৬ হাজার ৮০০ টাকা। তেলের দাম কমার পর এখন ৩০০ টাকার মতো সাশ্রয় হচ্ছে। এই তিন শ’ টাকা দুই যাত্রার ৮০ জন যাত্রীর মধ্যে ভাগ করে দিলে প্রতি টিকেটে তিন টাকা ৭৫ পয়সা করে কমানো সম্ভব। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, তেলের দাম কমার সুফল যাত্রীরা না পেলেও পরিবহন মালিকরা ঠিকই অল্প অল্প করে বড় অঙ্কের মুনাফা পাবেন। তার অভিযোগ, পরিবহন মালিকচক্রকে ভাড়া না কমানোর সুযোগ করে দিতেই সরকারের এই ‘দাম কমানোর ছল।’ মালিক বলবেন, লিটারে মাত্র ৩ টাকা হিসেবে যে হারে ভাড়া কমে, তা যাত্রীদের হাতে দেয়ার মতো নয়। বাস্তবেও আমরা তাই দেখতে পাচ্ছি। ১০-২০ টাকা কমালেও আমরা বার্গেইনিংয়ে যেতে পারতাম। মালিকদের লাভের চিত্র তুলে ধরে মোজাম্মেল বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যে গাড়ি চালাতে আগে প্রতিবার ১ হাজার ৩০০ টাকার জ্বালানি খরচ হতো, এখন তা এক হাজার টাকায় নেমে এলো। এভাবে দৈনিক এক হাজার টাকা করে বেশি পাওয়া গেলে যার দশটা গাড়ি আছে তিনি কয়েক মাসের মধ্যে আরেকটা গাড়ির মালিক হতে পারবেন। জ্বালানি তেলের দাম কমানো প্রসঙ্গে বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দ্রুত ভাড়া কমানোর প্রস্তাব চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম কমলেও যাত্রীদের দুর্ভোগ আগেও যা ছিল বর্তমানেও তাই। যাত্রী কল্যাণ সমিতির দাবি, ধনীদের ব্যক্তিগত পরিবহনে ব্যবহৃত পেট্রোল-অকটেনের মূল্য লিটারে ১০ টাকা কমালেও গণপরিবহনে ব্যবহৃত জ্বালানি ডিজেলের মূল্য মাত্র ৩ টাকা কমিয়ে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সম্প্রতি জনকণ্ঠকে বলেন, তেলের দাম কমলেও অন্য সবকিছুর দাম অনেক বেড়েছে। তিনি বলেন, ২৪টি বিষয়ের ওপর আলোচনা করে ভাড়া কমানো ও বাড়ানোর বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে জ্বালনি তেলের সংশ্লিষ্টতাই বেশি। কারণ বাস চালানোর জন্য তেল খাতেই সবচেয়ে বেশি ব্যয়। এখন তেলের দাম কমলে বাকি ২৩টি বিষয় আগের মতোই। অর্থাৎ বাড়তি। সেই সঙ্গে স্টাফদের বেতনও বেড়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, তেলের দাম বাড়লে ভাড়া বাড়ে। এখন দাম কমেছে। ভাড়াও কমানো উচিত। তবে পুরো বিষয়টি পরিবহন মালিক ও সরকারের ওপর নির্ভর করছে। সবদিক বিবেচনায় নিয়ে যুক্তিসঙ্গত ভাড়া নির্ধারণ করার দাবি জানান এই শ্রমিক নেতা।
×