ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জরুরী অবস্থার সময় দেশের অর্থ পাচার হয়েছে বেশি ॥ সংসদে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ;###;গত এক দশকে ১৩১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিদেশে পাচার

অর্থ পাচার

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৩০ এপ্রিল ২০১৬

অর্থ পাচার

রহিম শেখ ॥ গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে অর্থ পাচার হয়েছে ২০০৬ সালে। ওই বছর দেশ থেকে ২৬৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার অর্থ পাচার হয়। ২০০৭ সালে সৃষ্ট ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও অর্থ পাচার হয়েছে বেশি। ওই বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ২৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা যত বেশি থাকে, দেশ থেকে অর্থ পাচারও তত বাড়ে। আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আভাস থাকে- এমন বছরগুলোতে অর্থ পাচার কমে যায়। একইভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় ২০০৫ সাল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হতে থাকে। ওই বছর ১০৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার পাচার হয়। তখন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ২০০৬ সাল থেকেই দেশের রাজনীতি অস্থির হয়ে ওঠে। ২০০৭ সালে জরুরী অবস্থায় আবারও অর্থ পাচারের ঘটনা বাড়তে থাকে। দেশের অর্থ পাচার প্রসঙ্গে এবার সংসদে নতুন তথ্য দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । তিনি জানালেন, দেশে যখন জরুরী অবস্থা ছিল তখন বিদেশে অর্থ পাচার বেশি হয়েছে। তিনি বলেন, ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিল তারা বেশিরভাগই বিদেশেই টাকা রেখেছেন এবং এখনও প্রচুর পরিমাণ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রীর ছেলের বাইরে রাখা টাকা ফেরত আনার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অর্থ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) তথ্যমতে, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার ৩১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এই টাকার অঙ্ক বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ গড়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১৩২ কোটি ডলার বা ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো পাচার হচ্ছে। জিএফআই প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের বেশিরভাগই পাচার হচ্ছে আমদানি-রফতানির সময় পণ্যের মূল্য বেশি বা কম দেখিয়ে। অর্থাৎ কম দামে বিদেশ থেকে পণ্য কিনে বেশি দাম দেখিয়ে (ওভার ইনভয়েসিং) অর্থ পাচার করা এবং বেশি মূল্যে রফতানি করে কম মূল্য দেখিয়ে (আন্ডার ইনভয়েসিং) বাড়তি টাকা বিদেশেই রেখে দেয়ার মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। গত দশকের প্রথম দিকে বেশিরভাগ অর্থই পাচার হয়েছে আমদানি-রফতানির সময়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নগদ অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়ে গেছে। সূত্র মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা যত বেশি থাকে, দেশ থেকে অর্থ পাচারও তত বাড়ে। আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আভাস থাকে- এমন বছরগুলোতে অর্থ পাচার কমে যায়। একইভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় ২০০৫ সাল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হতে থাকে। ওই বছর ১০৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার পাচার হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ২০০৬ সাল থেকেই দেশের রাজনীতি অস্থির হয়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছর বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়, যার পরিমাণ ২৬৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০০৭ সালে সৃষ্ট ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও অর্থ পাচার হয়েছে বেশি। ওই বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ২৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। তবে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের দিকে এগোতে থাকায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আলামত মেলে। ফলে আগের দুই বছরের তুলনায় ওই বছর অর্থ পাচার কমে দাঁড়ায় ১২২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। আর ২০০৯ সালে নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর অর্থ পাচারের পরিমাণ আরও কমে দাঁড়ায় ১০৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারে। এর আগে ২০০৩ সালে ৮৩ কোটি ডলার ও ২০০৪ সালে ৮৪ কোটি ডলার দেশ থেকে পাচার হয়েছে। জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমদানি-রফতানি মূল্যে কারসাজি করে (ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং) ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট ৮০৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা ৬৪ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকার মতো পাচার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবছর আমদানি-রফতানি মূল্যের আড়ালে গড়ে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা পাচার হয় বাংলাদেশ থেকে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৯ সালে ৩৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০০৮ সালে ৯১ কোটি ১০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ১৬৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ২০২ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০০৫ সালে ৪১ কোটি ডলার, ২০০৪ সালে ৮১ কোটি ৪০ লাখ ডলার এবং ২০০৩ সালে ৮৩ কোটি ডলার পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। গত বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশে যখন জরুরী অবস্থা ছিল, তখন বিদেশে অর্থ পাচার বেশি হয়েছে। সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আ খ ম জাহাঙ্গীর হুসাইনের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, অনেকেই বিদেশে ব্যবসা করেন, টাকা দেশে আনেন না। তবে বিদেশে টাকা পাচারের ঘটনা বেশি ঘটেছে ২০০৭ সালে দেশে যখন জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ থেকে কোন অফসোর ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন কখনও দেয়া হয়নি। তবে অফসোর ব্যাংক বহু দেশেই আছে, এটা প্রচলিত, উন্নত দেশগুলোর সব জায়গাতেই আছে। অনেকে বিদেশে ব্যবসা করেন, টাকা দেশে আনেন না, বিদেশেই রেখে দেন। আবার অনেকে বাইরে নিয়েও গেছে, এ তথ্যও আমাদের কাছে ধীরে ধীরে আসছে। টাকা পাচারের ঘটনাটি সব থেকে বেশি ঘটেছে ২০০৭ সালে যখন জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। তখন এবং তারপর থেকে অনেকেই এ ব্যাপারে শঙ্কিত, কারণ সে সময় ব্যবসায়ীদের ওপর অনেক অত্যাচার নির্যাতন হয়েছে। অনেকেই ২০০৭-০৮ অর্থবছরে টাকা বাইরে পাঠিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিল তারা বেশিরভাগই বিদেশেই টাকা রেখেছেন এবং এখনও প্রচুর পরিমাণ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রীর ছেলের বাইরে রাখা টাকা আমরা ফেরত আনতে পেরেছি। এটা বাংলাদেশের জন্য বিরল দৃষ্টান্ত, যে আমরা টাকা ফেরত আনতে পেরেছি এবং এভাবে আমাদের কার্যক্রম চলছে। বাইরে টাকা পাঠানো রোধ করা এবং পাঠালেই সেটা ফেরত আনার ব্যাপারে সরকার যথেষ্ট ব্যবস্থা নিয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কখনও কোন অফসোর ব্যাংক করার অনুমতি কাউকে দেয়নি। প্রবাসী বাঙালীদের ব্যাংক করতে দেয়া হয়েছে, ব্যাংকের শাখা দেয়া হয়েছে। সেই ব্যাংক তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশে কিন্তু বিদেশে দেয়া হয়নি। কোন অফসোর ব্যাংক করতে দেয়া হয়নি তবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে অফসোর ব্যাংক রয়েছে। এর আগে ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর বানিয়ে দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচারের সুযোগ পেয়েছিলেন। সূত্রে জানা গেছে, সেনা সমর্থিত সরকারের সময় দেশের বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ী-শিল্পপতি বেআইনী উপায়ে বিদেশে টাকা সরিয়ে নিয়েছেন। এরপরের ৪ বছরে অন্তত ৪ হাজার বাংলাদেশী নাগরিক মালয়েশিয়াতে সেকেন্ড হোম কর্মসূচীর সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এ সুবিধা পেতে হলে প্রত্যেক আবেদনকারীকে বাংলাদেশী মুদ্রার হিসাবে কমবেশি এক কোটি টাকা মালয়েশিয়ার ব্যাংকে ডিপোজিট রাখতে হয়। সুতরাং এই হিসেবে কেবল মালয়েশিয়াতেই পাচার হয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য সেকেন্ড হোম সুবিধা গ্রহণকারীদের অনেকেই সেদেশে এক কোটি টাকার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। সেখানে বাড়ি অথবা ফ্ল্যাট কিনেছেন। আবার অনেকেই কৃষি খামারসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। এছাড়া দুবাই, হংকং, বৃটেন, কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশেও পুঁজি সরিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের একজন সাবেক সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তখনকার সেনাসমর্থিত সরকার দেশের প্রথমসারির অধিকাংশ ব্যবসায়ী-শিল্পপতিকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে তাদের অনেককেই গ্রেফতার করে। কেউ কেউ পালিয়ে বিদেশে চলে যান। ওই সময়ে অনেকে অর্থ পাচারের সুযোগ নেন।
×