ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঘরে-বাইরে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি;###;পানিবাহিত রোগাক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে ;###;উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে মর্নিং শিফ্্ট চালুর চিন্তাভাবনা

রেকর্ড গরম ॥ গত সাত বছরে এমন টানা তাপপ্রবাহ হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৩০ এপ্রিল ২০১৬

রেকর্ড গরম ॥ গত সাত বছরে এমন টানা তাপপ্রবাহ হয়নি

নিখিল মানখিন/বিভাষ বাড়ৈ ॥ রেকর্ড একটানা তাপপ্রবাহ! এক মাসের বেশি সময় ধরে বয়ে যাচ্ছে। গত সাত বছরে এমন টানা তাপপ্রবাহ বয়ে যায়নি। দাবদাহে পুড়ছে সারাদেশ। চলতি মাসের জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত, তাপপ্রবাহ, নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দিয়েছিল আবহাওয়া অফিস। তাপপ্রবাহ ছাড়া অধিদফতরের কোন পূর্বাভাসই বাস্তবে রূপ নেয়নি। তীব্র রোদ ও অসহনীয় গরমে ব্যাহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ঘন ঘন বিদ্যুত বিভ্রাট বাড়িয়ে দিয়েছে রাজধানীবাসীর দুর্ভোগের মাত্রা। খাঁ খাঁ করছে দেশের মাঠ প্রান্তর। খাল-বিল, নদী-নালা ও জলাশয় ফের পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। ঘরে বাইরে সব খানেই বিরাজ করে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। রাজধানীর আইসিডিডিআরবি’তে প্রতিদিন স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে দ্বিগুণ নতুন নতুন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হচ্ছে। তীব্র গরমের কারণে উচ্চ বিদ্যালয়গুলো পরিচালনা কমিটির অনুমোদন নিয়ে প্রয়োজনে মর্নিং স্কুল চালু করতে পারবে। এমন ঘোষণা দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) তাদের অধীন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনায় পাঁচ দফা নির্দেশনা জারি করেছে। আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, আজ শনিবার ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ী দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র আকাশ অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলাসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। রাজশাহী ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ঢাকা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, নোয়াখালী, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলা অঞ্চলসহ রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সূত্রটি আরও জানায়, মে মাসে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। ওই মাসে বঙ্গোপসাগরে ১-২টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। ওই মাসে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে ২-৩ দিন বজ্রসহ মাঝারি/ তীব্র কালবৈশাখী/বজ্র-ঝড় ও দেশের অন্যত্র ৩-৪ দিন হালকা/মাঝারি কালবৈশাখী /বজ্রঝড় হতে পারে। আর দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ২-৩টি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যত্র ২-৩টি মৃদু / মাঝারি (৩৮-৪০ সে.) তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে বলে জানায় আবহাওয়া অফিস। আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ ॥ আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করে যাচ্ছে আবহাওয়া! গত বছর একটানা ২১ দিন তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। এ বছর মার্চের শেষ সপ্তাহ শুরু হওয়া তাপপ্রবাহ একটানা এখন পর্যন্ত বয়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা ওঠানামা করলেও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে নামছে না। চিন্তার বিষয় হচ্ছে, দেশের প্রায় সব ক’টি সেন্টারের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড হচ্ছে। শুক্রবার আরেক দফা বেড়েছে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এদিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রাজশাহীতে ৪১.২ ও সর্বনিম্ন সিলেটে ১৯.৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড হয়। আর ঢাকার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয় যথাক্রমে ৩৭.৪ ও ২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। দুর্বিষহ গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে দেশবাসী। বৃষ্টিপাত নেই বললেই চলে। দেশের কিছু জায়গায় সীমিত বৃষ্টিপাত হলেও তা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খরতাপে শুকিয়ে যাচ্ছে। গত মাসে বেশ কিছুদিন বৃষ্টিপাত থাকায় ওই সব জায়গায় পানি দেখা গিয়েছিল। বোরো ধান কাটার সুবিধে হলেও বৃষ্টিবিহীন আবহাওয়ায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশিসহ নানা মৌসুমী জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, মে মাসেও দেশে তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। বায়ুম-লে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি। পশ্চিমা লঘুচাপের সঙ্গে পুবালী লঘুচাপের সংযোগ না ঘটায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। বায়ুম-লে ক্রমেই অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়া বিন্যাসে সাধিত হচ্ছে ব্যাপক পরিবর্তন। আবহাওয়া বিন্যাসের ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে পশ্চিমা বায়ু উপরের দিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং উপরের অংশে অবস্থান করছে। পশ্চিমা বায়ুর অবস্থান উত্তর দিকে হিমালয় বরাবর। এ বছর গ্রীষ্মকালে তুলনামূলকভাবে বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে। জলভাগ ও স্থলভাগের তাপমাত্রার বড় ধরনের পার্থক্যের কারণে বর্ষাকাল সৃষ্টি হয়। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর এ দু’স্থানের তাপমাত্রার ব্যবধান অনেকটা বেশি থাকবে। আবহাওয়ার দীর্ঘকালীন পূর্বাভাসে চলতি মাসে দু’টি নিম্নচাপের কথা বলা হয়েছিল। যা এখন পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। নিম্নচাপ হলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে পারত এবং দাবদাহের মাত্রা হ্রাস পেত। এমনটি মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়াবিদরা আরও বলছেন, দেশের অধিকাংশ অঞ্চলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা অনেক উপরে উঠে গেছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সব আবহাওয়া স্টেশনে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড হয়ে আসছে। মাঝে মাঝে আকাশে মেঘ জমলেও বৃষ্টি হয় না। ভূ-পৃষ্ঠের শুষ্ক অবস্থা আরও উত্তপ্ত হয়ে পড়ছে। বেড়ে যায় ভ্যাপসা গরমের মাত্রা। রাজধানীর অবস্থা ॥ রাজধানীর আকাশেও স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত নেই। দিনের অধিকাংশ সময় পড়ছে তীব্র রোদ। গরমে অতীষ্ঠ নগরবাসী। ব্যাহত হচ্ছে নগরবাসীর স্বাভাবিক কাজকর্ম। প্রখররোদ উপেক্ষা করেই চলতে হয় পথচারীদের। এত অস্বাভাবিক গরমে পরিবহনগুলোর ভেতরের তপ্ত পরিবেশে অস্থির হয়ে ওঠে যাত্রীরা। দাবদাহে জর্জরিত মানুষের কাছে বেড়ে যায় ঠা-া পানীয়ের চাহিদা। ঢাকার গত এক সপ্তাহের তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে থাকছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৭ থেকে ২৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড হচ্ছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে এমন অবস্থায় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমে আসে, তাহলে গরমের তীব্রতা বেশি অনুভূত হবে। বর্তমানে ঢাকায় এমন অবস্থাই বিরাজ করছে। ঢাকার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য হ্রাস পেয়ে ৭ থেকে ৯ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে থাকছে। শুধু তাই নয়, রাজধানীসহ শহুরে এলাকার জন্য সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস অনেকটাই দুর্বিষহ অবস্থা সৃষ্টি করে। বর্তমানে রাজধানীবাসীকেও এমন বিরূপ আবহাওয়া ও ইট-পাথরের প্রতিকূল অবস্থায় পড়ে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ॥ তীব্র গরমের কারণে উচ্চ বিদ্যালয়গুলো পরিচালনা কমিটির অনুমোদন নিয়ে প্রয়োজনে মর্নিং স্কুল চালু করতে পারবে। এমন ঘোষণা দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) তাদের অধীন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনায় পাঁচ দফা নির্দেশনা জারি করেছে। তীব্র গরমের কারণে কদিন ধরেই শিক্ষার্থী অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বিদ্যালয়ের শ্রেণী কার্যক্রমের পুনর্বিন্যাস, গ্রীষ্মের ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধিসহ নানা দাবি সামনে আসছিল। তীব্র তাপদাহ জনজীবনে প্রভাব ফেলেছ। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষকে। রাজধানীতে একাধিক স্কুলে কয়েক শিশুর অসুস্থ হয়ে পড়ারও ঘটনাও ঘটেছে। এরই মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) বৃহস্পতিবার রাতে তাদের অধীন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনায় নতুন নির্দেশনা জারি করে। এতে বলা হয়েছে, স্থানীয় পর্যায়ে তাপপ্রবাহের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি বিদ্যালয়ের নির্ধারিত শ্রেণী কার্যক্রমের সময়সূচী পুনর্বিন্যাস করতে পারেন। এর অংশ হিসেবে বিদ্যালয় পরিচলনা কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে মর্নিং স্কুল চালু করা যাবে। আর যেসব স্কুলে দুই শিফটে ক্লাস হয়, সেখানে ‘ক্ষেত্র বিশেষে’ প্রাত্যহিক সমাবেশ স্থগিত করে নির্ধারিত সময়ের আগেই শ্রেণীর কার্যক্রম শুরু করা যাবে। গরমের মধ্যে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দিয়েছে মাউশি। নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে জারি করা এসব নির্দেশনা ‘সাময়িক ব্যবস্থা’ হিসেবে বিবেচিত হবে। এদিকে টানা গরমে ক্লাস ও পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েই অচেতন হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। গত তিন দিনে রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্কুলে একই ঘটনায় বেশ কয়েক শিক্ষার্থীর অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পরে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছে। মিরপুর সিদ্ধান্ত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনি বলছিলেন, মন্ত্রণালয়ের পূর্বনির্ধারিত একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই সময়ে প্রথম বার্ষিক পরীক্ষা নিতে বাধ্য আমরা। কিন্তু গরমে পরীক্ষায় বসতে গিয়ে প্রায় অচেতন হয়ে পড়ছে শিশুরা। প্রায় প্রতিদিনই ৪/৫ জন ছাত্রছাত্রীর অসুস্থতার খবর পাচ্ছি। অভিভাবকরা পরীক্ষা কিছুদিন পিছিয়ে নেয়ার দাবি জানাচ্ছেন। আমরাও মনে করি গরমের কারণে গ্রীষ্মকালীন ছুটি কিছুদিন এগিয়ে আনা উচিত। গ্রীষ্মকালের ছুটি এগিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। একাডেমিক কেলেন্ডার অনুযায়ী মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আগামী ১৪ মে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি হবে, শেষ হবে ২৬ মে। কলেজ পর্যায়ের এ ছুটি অবশ্য ইতোমধ্যেই শেষ। অন্যদিকে তীব্র গরমেই শিশুদের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা নিচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। এতে কেন্দ্রে বসেই হাঁসফাঁস খাচ্ছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। ঢাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত ২৩ এপ্রিল শুরু হয়েছে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। এ পরীক্ষা শেষ হবে আগামী ৩০ এপ্রিল। এরপর ২০ মে থেকে ২৭ মে পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটি থাকবে। অসহনীয় গরমের মধ্যে শিশুদের দুর্ভোগে ফেলে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে কেন এবং এতে শিশু শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহিন আরা বেগম বলছিলেন, গরমে কিছুটা সমস্যা সবারই হচ্ছে। এরপরও আমরা পরীক্ষা সূচী অনুযায়ী নিচ্ছি। কারণ এখন পর্যন্ত গরমে কোন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়েছে, এমন খবর আমার কাছে আসেনি। ঢাকার ৯০টি ওয়ার্ডে ৩৪৫টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। আর ঢাকায় নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে পাঁচ শতাধিক। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই এখন চলছে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। অসহনীয় গরমের কারণে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা পিছিয়ে নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক এলিয়াছ হোসেন বলেন, ‘তীব্র গরমে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা দিতে কিছুটা সমস্যা হলেও এই সময়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটি এগিয়ে আনার কোন পরিকল্পনা নেই। তবে যদি গরমের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, সেক্ষেত্রে সরকার এটা বিবেচনা করতে দেখতে পারে। তবে ইতোমধ্যেই আমরা পরিপত্র জারি করেছি। যেখানে বলা হয়েছে, তীব্র গরমের কারণে উচ্চ বিদ্যালয়গুলো পরিচালনা কমিটির অনুমোদন নিয়ে প্রয়োজনে মর্নিং স্কুল চালু করতে পারবে।’ রোগ-ব্যাধি ও হিটস্ট্রোক ॥ এদিকে তীব্র গরমে হিটস্ট্রোক, সর্দি-কাশি, জ্বর, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। হিটস্ট্রোক ও ডায়রিয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। গত বছর এমন সময়ে হিটস্ট্রোকে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটে। রাজধানীতে ইতোমধ্যে তাপমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন করে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। তাপমাত্রা বাড়লে ডায়রিয়ার জীবাণুগুলোর সংক্রমণের ক্ষমতা বেড়ে যায়। এমন অবস্থায় চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়রিয়ামুক্ত থাকতে পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। আর হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সতর্ক থাকতে হবে। দীর্ঘক্ষণ রোদে থাকা যাবে না। অতি প্রয়োজন না হলে রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। রোদে কাজ করার সময় মাথা ও শরীরে ঢাকনা দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রচুর পরিমাণ তরল জাতীয় কিছু খেতে হবে। ঢিলাঢালা পোশাক বিশেষ করে সূতি কাপড় পরিধান করতে হবে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাকে ছায়াচ্ছন্ন স্থানে শুইয়ে দিতে হবে। ঠা-া পানি (রেফ্রিজারেটরের পানি নয়) দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। এতে উন্নতি না হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আইসিডিডিআরবি’র বিজ্ঞানী ও ইউনিটপ্রধান ড. মোঃ শাহাদাত হোসেন বলেছেন, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে গেলেই এ দেশের মানুষের হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। যতটা সম্ভব প্রখর রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। বেশি মাত্রায় পানি পান করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আবহাওয়া অফিসের পরামর্শও প্রায় একই। ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের তাপমাত্রা এ দেশের মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এর উপরে চলে গেলে তা হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, যা সহ্য করতে এ দেশের মানুষ অভ্যস্ত নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সতর্ক থাকতে হবে। দীর্ঘক্ষণ রোদে থাকা যাবে না। প্রচুর পরিমাণ তরল জাতীয় বিশেষ করে ওরস্যালাইন খেতে হবে। ঢিলেঢালা জামা পরিধান করতে হবে। আর হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাকে ছায়ায় নিতে হবে। শরীর মুছে দিতে হবে। এতে আক্রান্তের অবস্থার উন্নতি না হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি বলেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্তের আগে শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থার বেশি থাকবে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। বমি বমি ভাব দেখা দেবে। মাথা ঘুরতে থাকবে। প্রস্রাব কমে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তের চাপও কমে যাবে। এসব লক্ষণ দেখা দিলেই ছায়াচ্ছন্ন স্থানে বিশ্রাম নিতে হবে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই বিশেষ সতর্ক থাকার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন তিনি। স্টাফ রিপোর্টার চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানান, তীব্র দাবদাহের সঙ্গে চট্টগ্রামে বেড়েছে লোডশেডিং। বিদ্যুতের বারবার আসা-যাওয়ায় বিষিয়ে উঠছে জনজীবন। গ্রীষ্মের প্রারম্ভে লোডশেডিং শুরু হয়ে দিন দিন এর মাত্রা বেড়েই চলেছে। গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ১০-১৫ বার বিদ্যুত আসা-যাওয়া করছে। সন্ধ্যার পরেও পাওয়া যাচ্ছে না নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ। কাঠফাটা গরমে জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়িয়েছে তীব্র লোডশেডিং। প্রতিদিন রাতের অধিকাংশ সময় আবাসিক বাসাবাড়ি অন্ধকারে ডুবে থাকছে। পড়াশোনা নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে রেফ্রিজারেটর ব্যবহারকারী দোকানিরাও পড়েছেন জটিলতায়। ঘন ঘন বিদ্যুত বিভ্রাটে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে পড়ছে। এছাড়া বিদ্যুত সরবরাহের অভাবে নগরীর ছোট থেকে মাঝারি ধরনের বিভিন্ন শিল্প কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তবে পিডিবি কর্মকর্তাদের দাবিÑ এখানে লোডশেডিং নেই। চট্টগ্রামে মাঝে মধ্যে বিদ্যুত বিভ্রাট ঘটে টেকনিক্যাল কারণে। অতিরিক্ত গরম পড়ায় এর প্রাদুভার্ব একটু বেড়েছে। পিডিবি চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মনিরুজ্জামান জানান, স্থানীয়ভাবে লাইনের ত্রুটির কারণে গ্রাহকরা বিদ্যুত বিভ্রাটের মুখে পড়েন। তাতে হয়ত গ্রাহকরা আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বিদ্যুত পান না। আর এখন মাত্রাতিরিক্ত গরমের কারণেও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিভ্রাট ঘটছে। এদিকে লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি ঝাঁঝালো রোদ আর তীব্র খরতাপ নগরবাসীর এ দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে দিনমজুরদের কষ্টের সীমা নেই। কোথাও কোন গাছের ছায়া পেলেই সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কিছুটা শান্তি খুঁজছেন তারা। যেন গাছের ছায়াই সবচেয়ে শান্তির জায়গা। ভরদুপুরে অনেক রিক্সাচালক ও ভ্যানগাড়ি চালককে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে দেখা গেছে। এছাড়া তীব্র গরমে নগরবাসী অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। শিশুরা সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অহরহ। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ীÑ ২৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৭ হাজার ৯৯০ মেগাওয়াট, এর মধ্যে চট্টগ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৮৯০ মেগাওয়াট। এর আগে ২৭ এপ্রিল বুধবার সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৭ হাজার ৯৫৯ মেগাওয়াট। চট্টগ্রাম জোনে চাহিদা ছিল ৯১৬ মেগাওয়াট। ২৬ এপ্রিল মঙ্গলবার সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৭ হাজার ৮৩৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জোনে চাহিদা ছিল ৯২৫ মেগাওয়াট। মাত্রাতিরিক্ত গরমের কারণে সারাদেশের সঙ্গে চট্টগ্রাম জোনেও দিন দিন বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে কিন্তু এর বিপরীতে সরবরাহ কমে যাওয়ায় এখানে বিদ্যুত বিভ্রাট ভয়াবহ রূপধারণ করেছে। পিডিবি চট্টগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে সরকারী-বেসরকারী ১৪টি বিদ্যুত কেন্দ্রে ১৩২৮ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু গত ৫ দিনে ডে পিকে ৬০৬ মেগাওয়াট থেকে ৭৪১ মেগাওয়াট এবং ইভিনিং পিকে ৬৬৯ থেকে ৮০৮ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যাচ্ছে। ১৪ বিদ্যুত কেন্দ্রের অধিকাংশ কেন্দ্রে উৎপাদন কমেছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বুধবার রাউজানের ২১০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুত কেন্দ্রে গ্যাস সঙ্কটের কারণে ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হয়েছে। একই এলাকার ২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আরপিসিএল পাওয়ার প্ল্যান্টে উৎপাদন হয়েছে ১৮ মেগাওয়াট, পতেঙ্গার ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বারাকা বিদ্যুত কেন্দ্রে উৎপাদন হয়েছে ৪৯ মেগাওয়াট, কোলাগাঁও ১০৮ মেগাওয়াটসম্পন্ন ইসিপিডিএল পাওয়ার প্ল্যান্টে উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৪১ মেগাওয়াট, কাপ্তাই ২৩০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত প্রকল্পে উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৯৮ মেগাওয়াট, শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াটসম্পন্ন পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে উৎপাদন হয়েছে ১১০ মেগাওয়াট, হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াটসম্পন্ন পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে উৎপাদন হয়েছে ৫১ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে ওই দিন ১৪টি বিদ্যুত কেন্দ্রে উৎপাদন হয়েছে ৬৭৯ মেগাওয়াট, যা চাহিদার তুলনায় প্রায় ২৩৭ মেগাওয়াট কম। পিডিবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আজহারুল ইসলাম জানান, চট্টগ্রামে তেমন একটা লোডশেডিং নেই। লাইন মেরামত ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ফ্লাইওভার নির্মাণকে কেন্দ্র করে তাদের কাজের সুবিধার্থে কিছু কিছু সময় বিদ্যুত লাইন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। পাশাপাশি গত কয়েক দিন নৌ-শ্রমিকদের অবরোধের কারণে জ্বালানি সরবরাহে বিঘœ ঘটায় বিদ্যুত জেনারেশনের প্রভাব পড়েছে এ কারণে এখানে বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে এটিও বেশি দিন থাকছে না, দুই-এক দিনের মধ্যে বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তখন নগরবাসী নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত পাবেন বলে তিনি জানান। স্টাফ রিপোর্টার রাজশাহী থেকে জানান, একদিনের ব্যবধানে রাজশাহীতে তাপমাত্রার পারদ আরও বেড়ে ৪১ এর ঘর ছুঁয়েছে। শুক্রবার এ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১.২ ডিগ্রী সেললিয়াস। এর আগে বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। প্রায় মাসব্যাপী দীর্ঘ তাপমাত্রার স্থিতিবস্থায় গরমে নাভিশ^াস উঠেছে মানুষের। বিশেষ করে কর্মজীবী মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। সকাল থেকে সূর্য দহনে স্বাভাবিক কাজকর্মেও নেমে এসেছে স্থবিরতা। শুক্রবার বেলা ১১টার পর থেকে নগরীর রাস্তাঘাট অনেকটাই দেখা গেছে জনমানবশূন্য। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন জানিয়েছেন, গত প্রায় এক মাস ধরেই রাজশাহী অঞ্চলে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮, ৩৯ ও ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করছে। এর মধ্যে কয়েক দিন ৪০ ডিগ্রীও অতিক্রম করেছে। আর এ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তামপাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে শুক্রবার ৪১ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এদিকে চলমান তাপপ্রবাহ ও দীর্ঘ খরার কবলে পড়ে উত্তরাঞ্চলের আম, লিচু ও পাটের ক্ষেত নিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষক। গাছেই শুকিয়ে যাচ্ছে লিচু আর আমের গুটি। খরায় পাটের ক্ষেতও নুইয়ে পড়ছে। কৃষকরা জানান, এ সময়ে বৃষ্টির খুব দরকার। উত্তরের কৃষকরা একটু স্বস্তির বৃষ্টির অপেক্ষায় চেয়ে রয়েছেন আকাশের দিকে।
×