ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অবৈধভাবে পজেশন ও স্থাপনা ভাড়া দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রভাবশালীরা

গণপূর্তের ১শ’ ৬০ একর জমি বেদখল

প্রকাশিত: ০৪:০২, ৩০ এপ্রিল ২০১৬

গণপূর্তের ১শ’ ৬০ একর জমি বেদখল

রাজু মোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম ॥ প্রায় পাঁচ যুগ ধরে অবৈধ দখলকারীরা গণপূর্তের ৩০২ একর জমির শতাধিক একর জবর দখল করে ভোগ করছে। এসব মূল্যবান সরকারী জমি রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোরালো পদক্ষেপ না থাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে যত্রতত্র দোকানপাট, বাড়িঘর, ক্লাব সমিতি, প্রভাবশালী সংগঠনের কার্যালয়। ড্রেন, পুকুর, আবাদী জমি সবই বেআইনী দখলদারদের কবলে। দখলীস্বত্ব এমনভাবে কায়েম হয়েছে যে পাকা ভবন তৈরি করতেও দ্বিধা করেনি। কোন কোন অবৈধ দখলদার বিপুল পরিমাণ জায়গা দখল করে অবকাঠামো নির্মাণ করছে। শুধু তাই নয়, অবৈধ দখলদাররা তাদের জবরদখলীয় জমির পজেশন লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে হাত বদলও করেছে। পাশাপাশি সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারী সংস্থাসমূহ এই হুকুম দখলকৃত জমিতে যে অবকাঠামোসমূহ তৈরি করেছে তাতেও বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন মানা হয়নি। যে যেখানে পেয়েছে সেখানে ইচ্ছেমতো জমি দখলে নিয়ে অবকাঠামো তৈরি ও সীমানা প্রাচীর কিংবা ঘের দিয়েছে। ০১/১১/২০০৬ সালে সেনা সমর্থিত সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গে অবৈধ দখলদাররা বিপাকে পড়ে যায়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ আর মোল্লার নির্দেশে এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। গণপূর্ত বিভাগ তাদের বেদখলকৃত জমি ফিরে পায়। ঐ ফাঁকা জায়গায় মার্কেট করার প্রস্তাব গণপূর্র্ত বিভাগ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কিন্তু এর কোন কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়নি। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে অবৈধ দখলদাররা নড়েচড়ে বসে। প্রথমে কয়েক প্রভাবশালী অবৈধ জায়গায় ঘর তোলা শুরু করে। তাদের দেখাদেখি বাকি দখলদাররা তাদের পূর্বের জায়গা দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এই দখলদারদের তালিকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সাধারণ মানুষও রয়েছে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যাপারে প্রায় মাইকিংসহ উচ্ছেদ নোটিস পাঠানো হলেও অবৈধ দখলদাররা তা আমলে নিচ্ছে না। ১৯০০ সালের গোড়ার দিকে ধরলা নদী ক্রমেই ভাঙ্গনপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং ব্যাপকভাবে ভাঙতে শুরু করে। এর ফলে কুড়িগ্রাম শহর ক্রমেই বিলীন হতে থাকে। একের পর এক বিলীন হয়ে যায় অফিস, আদালত, স্কুল, খেলার মাঠ, রেলস্টশন, বাড়িঘর। ১৯৫৪ সালে ধরলার ভাঙনে শহরের অধিকাংশ এলাকা বিলীন হয়ে যায়। এরই প্রেক্ষিতে তৎকালীন সরকার কুড়িগ্রাম শহর উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন করে গণপূর্ত বিভাগের আওতায় ১৯৫৮-১৯৫৯ অর্থবছরে এল এ কেস নং ১/৫৮-৫৯ মারফত নাজিরা মৌজায় ৩৯.৫০ একর, হিঙ্গন রায় মৌজায় ১১৩.৫০ একর এবং কৃষ্ণপুর মৌজায় ১৪৯.৪৫ একর মোট ৩০২.৪৫ একর ভূমি হুকুম দখলের প্রক্রিয়া শুরু করে। ১৯৬১ সালের দিকে ভূমি হুকুম দখল প্রক্রিয়া শেষ হয় এবং ১৯৬২ সাল থেকে নতুন শহরে অফিস আদালত, বাসভবন নির্মাণ শুরু হয়। এ সময় একটি মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় ভূমি হুকুম দখল এবং অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও পরবর্তীতে এই মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী আর কাজ হয়নি। মাস্টারপ্ল্যানটির অস্তিত্ব এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ’৭০ দশকে নতুন শহর এলাকা ব্যস্ততম এলাকা হিসেবে গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অবৈধ দখল প্রক্রিয়াও শুরু হয়। অব্যহৃত জমিতে বাড়িঘর নির্মাণ হতে থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দখল প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিযোগিতায় রূপ নেয় এবং দখল হতে থাকে এলাকার পর এলাকা। রাস্তার দু’ধারে দখল হয় দ্রুতগতিতে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হুকুম দখলকৃত ৩০২.৪৫ একর জমিতে বর্তমানে জেলা প্রশাসক কার্যালয় ৯.৬৫ একর, সাব জজ বর্তমানে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ২.৫০ একর, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক দফতর .৪৯ একর, কুড়িগ্রাম সদর থানা ৫.৭৩ একর, জেলা জজকোর্ট ১.৫০ একর, পুলিশ লাইন ১২.৫০ একর, খামার বাড়ী ২.৯১, আনসার ও ভিডিপি ও ব্যারাক ৩.৪০, ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ৪.৯৮ একর, বিজিবি হেডকোয়ার্টার ৪১.২৯ একর, কুড়িগ্রাম সরকারী কলেজ ১৫.৭৫ একর, সরকারী হাই স্কুল ৭.৬০ একর, সরকারী শিশু পরিবার ৩.০৯ একর, পিটিআই ৯.৬৮ একর, জনস্বাস্থ্য বিভাগের পানির ওভার হেড ট্যাংক ২.৩৬ একর, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস .৮৩ একর, কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতাল ১৫.৬৪ একর, বার লাইব্রেরী ১.২০, ঈদগাহ ময়দান ২.৯৬ একর, মারকাস মসজিদ .৮৬ একর, জজকোর্টসংলগ্ন পুকুর ২.৫২ একর, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ স্কুল (প্রস্তাবিত) ১.০০ একর, টাউন হল .৬৪ একর, স্টেডিয়াম ৫.০৩, পৌরসভার নতুন কবরস্থান ১২.০৫, জেলা কারাগার ১৬.২৩ একর, সার্কিট হাউস ১.৫৬ একর, জেল খানার বাইরে পুকুর .৭৬ একর, জমি ১০.৫৪ একর, পুকুরসংলগ্ন জমি ১.৬৭, বাসটার্মিনাল ২.০০ একর, কুড়িগ্রাম আলিয়া মাদরাসা ৪.০০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন .২৫ একর, বিদ্যুত ইউনিয়ন বোর্ড ৪.৬০ একর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর .৩৪ একর, সড়ক ও জনপদ বিভাগ ১৩.৬৫, গণপূর্ত বিভাগের ওভার হেড পানির ট্যাংক ১.০০ একর, স্টাফ কোয়ার্টার ২১.০০ একর, সরকারী মহিলা কলেজ ৪.১৫ একর, সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ৩.১০ একর। অফিসার্স ক্লাব .৮৮ একর, পেট্রোল পাম্প .৩০ একর (সেলামির মাধ্যমে লিজ), পোস্ট অফিস ১.০০ একর, পৌর বাজার ১.৫৯, সোনালী ব্যাংক .৩৩ একর, শিশু নিকেতন .৫৩। কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাব .২২ একর, আদর্শ পৌর বাজার মসজিদ ১.০৭ একর, ফায়ার সার্ভিস .৩৪ একর, টিএন্ডটি ৩.০০ একর, সাবরেজিস্ট্রার অফিস .৪৪ একর, খাদ্যগুদাম ৩.০০ একর, জেলা মৎস্য অফিস .২৫ একর, সিভিল সার্জনের কার্যালয় .৫০ একর, ছিন্নমুকুল ১.০২ একর, আরডিআরএস ২.০০ একর, গণপূর্ত বিভাগ ৮.০০ একর, মোট ২.১৬ একর জায়গা নিয়ে আছে, বাকি জায়গা আছে অবৈধ দখলদারদের কাছে, উল্লেখিত দফতর ও প্রতিষ্ঠানসমূহ পার্শ্ববর্তী বর্ণিত জায়গা দখল করে থাকলেও অনেকের নামে কোন জায়গা বরাদ্দ নেই। কোন প্রতিষ্ঠান বা দফতর বরাদ্দের চেয়ে বেশি জায়গা দখল করে আছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ৩০২.৪৫ একর জমির মধ্যে প্রায় ১৬০ একর দখলদারদের হাতে চলে গেছে। অভিযোগ রয়েছে স্থাপনা ছাড়া বাকি জায়গা ও পুকুরগুলোতে আবাদ ও মাছ চাষে যে আয় হচ্ছে তা বৃহৎ অংশ সরকারী কোষাগারে জমা হচ্ছে না। এগুলো কার পকেটে যাচ্ছে তার কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েক প্রভাবশালী ব্যক্তি কলেজ মোড় এলাকার জায়গা দখল করে কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে হস্তান্তর করার অভিযোগ রয়েছে।
×