ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

কোথায় আস্থা কোথায় ভবিষ্যত?

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৩০ এপ্রিল ২০১৬

কোথায় আস্থা কোথায় ভবিষ্যত?

রানা প্লাজার ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর সারাদেশে শোকের যে ছায়া পড়েছিল সেটাও আর সবকিছুর মতো একসময় মিলিয়ে গেছে। কি এক অদ্ভুত সময়। আজব এক সমাজ আমাদের। জানি না কবে থেকে শুরু তবে এটা এখন খুব স্বাভাবিক এক প্রক্রিয়া। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর নাওয়া-খাওয়া ভুলে মাঠে নেমে পড়া মিডিয়া বছরের কোনদিন কোন কারণে কোন অবসরে বা ব্যস্ততায় এ ঘটনায় নিহত আহত কিংবা বেঁচে মরে থাকা মানুষগুলোর কথা বলেনি। যখন ঘটনা ঘটেছিল মনে হচ্ছিল মিডিয়া জান দিয়ে দেবে। বিশেষত টিভি চ্যানেলগুলো। তাদের কর্মীবাহিনী একটা উপকার নিঃসন্দেহে করেছিল। সারাদেশে এমনকি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশীদের রাতের ঘুম টুটিয়ে দিয়েছিল। ঘটনার ভয়াবহতা আর বেদনার দিকটা মানুষের কাছে প্রকাশ্য করে তুলেছিলেন এরা। শোককে শক্তিতে পরিণত করার ব্যাপারে এদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। সঙ্গে এটাও বলব যতগুলো টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন পতিত রানাপ্লাজার সুড়ঙ্গ বেয়ে কথা বলতে মুখিয়েছিল তার সঙ্গে একটি করে বিস্কুটের প্যাকেট বা পানির বোতল থাকল আটকে পড়া মানুষগুলো আরও একটু স্বস্তি ও জীবন খুঁজে পেত। তার পরিবর্তে আটকে পড়া আক্রান্ত গার্মেন্টস কর্মীদের দিয়ে কথা বলিয়ে নেয়াই ছিল এদের মূল উদ্দেশ্য। তারপর যথারীতি তারা তা ভুলে গেছে। ভুলে গেছে বলা অন্যায়। তুলে রেখেছে একটি বিশেষ দিনের জন্য। সে দিনটির বর্ষপূর্তিতে আবার আমরা মিডিয়ার কল্যাণে রানা প্লাজার নৃশংসতম দুর্ঘটনার দুঃসহ স্মৃতিতে ফিরে গিয়েছিলাম। এ ঘটনা ভুলে থাকা কোন স্বাভাবিক মানুষ বা জাতির কাজ নয়। জোর করে ভুলিয়ে রাখলেও এর এফেক্ট বা প্রভাব আমাদের কোনদিন ছেড়ে যাবে না। মনে পড়ে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর বিদেশের বাজারে বাংলাদেশ কতটা বিপদের মুখে পড়েছিল। মানবিকতা আর মানবাধিকারের নামে জেগে থাকা সংগঠন আর পোশাক নির্মাতা সংগঠনগুলোর চোখে আমরা তখন অপরাধী। তাদের পোস্টারে কাপড়ের সিলে মার্কায় রক্তের ছাপ। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প একটি রক্তখেকো শিল্প এমন সেøাগানে আমরা প্রায় কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিলাম। সে জায়গাটা এখনও সেভাবে ঠিক করা যায়নি। এখনও লড়াই করছে পোশাক শিল্প। তারপর ও দায়ী সেই রানার বিচার বা শাস্তির কোন খবর নেই। হয়ত কোন কারাগারে সে রাজার হালে আছে। অথবা ছাড়াই পেয়ে গেছে সবার অজান্তে। কেউ জানে না জানতেও চায় না। কারণ এর ভেতর ঘটে গেছে আরও অনেক ঘটনা। আরও কত রক্ত কত মৃত্যু কত অঘটন। সবকিছু যখন উল্টো যাকে বলে আপ সাইড ডাউন তখন কে আর মনে রাখে রানা প্লাজার কাহিনী। এটাই এখনকার বাংলাদেশ। সরকারের যাবতীয় উন্নয়ন বা আন্তরিকতা কে কাঁচকলা দেখিয়ে বড় হয়ে উঠেছে অনিরাপত্তা অনিরাপদ জীবন। মানুষ এখন প্রশ্ন করছে এই উন্নয়ন দিয়ে তারা কি করবে? এই জিজ্ঞাসা অযৌক্তিক নয়। সবকিছুর একটা সীমা থাকে। এদেশে আগে কোনদিন এভাবে মানুষ খুন হয়নি। এভাবে পানির মতো রক্তধারা বয়ে যায়নি। যুদ্ধবিগ্রহ বা কোন সংকটকালের কথা আলাদা। অযথা শান্তিপূর্ণ সময়ে ক’দিন পর পর এভাবে মানুষকে কুপিয়ে মারা চাপাতি আক্রমণ কোনদিন দেখা যায়নি বাংলাদেশে। খোদ রাজধানীতে দিনদুপুরে ঘরে ঢুকে অফিসে ঢুকে মুক্তমনের বা প্রাগ্রসর মানুষদের হত্যা করার পরও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বলেন আমরা নাকি খুনোখুনিতে এখনও উন্নত দেশের সমপর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি। কেউ লুকিং ফর শত্রুজ কেউ ভবন ধাক্কা দিয়ে ফেলার কথা বলে বিরক্তি উৎপাদনের পাশাপাশি নিজেদের সরকারের ইমেজের বারোটা বাজাতেও কসুর করেননি। মেধার মগজ গড়াচ্ছে রাজপথে আর দায়িত্ববানরা বললেন এদেশে নাকি জঙ্গীর অস্তিত্ব নেই। এখন শুরু হয়েছে আইএস আছে কি নেই তাই নিয়ে কূটতর্ক। আছে কি নেই, সেটা জেনে আমজনতার কি লাভ? আমরা যারা বাংলাদেশের বাইরে বসবাস করি সব দেখি শুনি আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। আইএস থাকলে লাভ না থাকলে লাভ সেটা হয়তো রাজনীতির জন্য বিবেচ্য হতে পারে। জনগণের তা দিয়ে কি করবে? অথচ এই বিষয়টা যতবার সামনে আসে বা এ নিয়ে তারা যতবার কথা বলেন ততবার লাশ পড়ে। এটা এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার। তারপরও কেন তাকে টেনে আনা? গত কয়েকদিনে রেজাউল করিম, সাধুবাবা, কলাবাগানের জোড়াখুনে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও আমাদের ঘুম হারাম করে তুলেছে। মানুষ বড় ক্লান্ত আর দিশেহারা। এভাবে চলতে পারে না। সরকারের কাজ দেশ জনতার নিরাপত্তা বিধান করা। এত ছোট একটি দেশে সবদিক থেকে এত বৈচিত্র্য তাকে মেনেই চলতে হবে। এ সরকার তা করেনি। একশ্রেণীর মানুষের উগ্র চেতনাকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে সরকার খাল কেটে চাপাতির কুমির ডেকে এনেছে। সবাই মিলে বাঁচতে হলে জাতীয় সমঝোতার বিকল্প নেই। সে কাজ ও ভোটের রাজনীতি এক নয়। আজ দেশে রাজনীতি বলতে আসলে আর কোন কিছু নেই। এখন যা আছে তার নাম ভোগ ও প্রতিশোধ। এর মাশুল হিসেবে যারা জান দিলেন বা দেবেন তাদের রক্ত কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। একদিকে জঙ্গীবাদের সঙ্গে আপোস, সমাজে তার বিস্তার ও বিকাশে সহায়তা আরেক দিকে চেতনার নামে হুঙ্কার। এই গোঁজামিল আসলে জামায়াত-বিএনপিকেই শক্ত করে তুলছে। মাঠে না থাকার পরও তারাই নিয়ামক। এদেশের পুরনো ও বলশালী দলটি যদি এমন ভুলে বারবার পা পিছলায় বা আপোসের নামে দিশেহারা পথে চলতে থাকে পরিণাম হবে ভয়াবহ। তাদের জানতে হবে হয় সমঝোতার জাতীয় রাজনীতি নয়ত কামাল পাশার ডু অর ডাই। মাঝামাঝি থাকলে এভাবে মানুষ মরবে। মরতে মরতে মারতে মারতে খুনের সমাজ খুনী জাতিতে পরিণত হব আমরা। তারুণ্য একদিন এদেশকে আবার কোন পরিচয়ে কিভাবে দেখতে চাইবে কেউ কি তা বলতে পারবে আসলে? রানা প্লাজা থেকে কলাবাগান, অতঃপর কি? এটাই এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
×