ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গোলাম সারোয়ার

বিএনপির রূপকল্প এবং বাস্তবতা...

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৩০ এপ্রিল ২০১৬

বিএনপির রূপকল্প এবং বাস্তবতা...

বিএনপির জাতীয় সম্মেলন নিয়ে পুরো জাতি আগ্রহে ছিল। এই সম্মেলনকে সরকারী দল ব্যর্থ বলবে এটাই স্বাভাবিক। এই সত্য মেনে নিয়েও পুরো জাতি আশায় ছিল চোরাবালি থেকে দলটি বেরিয়ে আসবে। অবশ্য ভেতরে ভেতরে সরকারী দলেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা যে ছিল না তা নয়। সরকার সবচেয়ে বেশি যে জায়গাটি নিয়ে চিন্তিত ছিল, তা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হ্যাক ও অর্থ চুরি এবং জ্বালানির দাম নিয়ে সরকারের মুনাফা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিএনপি ওই দুটো নরম জায়গাতে হাত না দিয়ে হাত দিল রূপকল্প ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণায়। পরিহাস হলোÑ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনের পর বহু বিএনপি নেতা-কর্মী তাচ্ছিল্য করে বলছেন, খালেদা জিয়াও বোধ হয় সরকারের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে! তাদের ক্রোধের কারণ আছে। প্রায় নয় বছর ক্ষমতা থেকে বাইরে থাকা দলটি ভুল রাজনীতি, আগুন সন্ত্রাসের দায় ইত্যাদি নিয়ে আজ উদভ্রান্ত। নেতা-কর্মীরা মামলা হামলায় দিশাহারা। তারা গ্রামে-গঞ্জে ভাল নেই। গত বছরের লাগাতার অবরোধের সময়ের আগুন ও ধ্বংস সন্ত্রাসের দায়ে সাধারণ মানুষের সহমর্মিতাও তারা এখন আর পাচ্ছে না। এই অবস্থায় তারা এসেছিল কোন জাদু মন্ত্রের বাণী নিয়ে ফিরে যাবে। ফিরে যাবে পুনর্গঠিত একটি দল নিয়ে। একটি ভবিষ্যত আশা নিয়ে কিন্তু তারা পেল একটি রূপকল্প। যে রূপকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে বিএনপিকে আগে ক্ষমতায় যেতে হবে। কিন্তু বাস্তব জ্ঞান খরচ করলেই এটি ভাবা সোজা যে ক্ষমতার দৌড়ে বিএনপি এখন বহু দূরে। বলা যায় বাইশ হাজার মাইল দূরে। দেশবাসী সবাই কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি করে না। এর বাইরের লোকও আছে। তারাও আশা করে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল। এতে করে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা হয়। চেক এ্যান্ড ব্যালেন্স থাকে। বলা অন্যায় হবে না, রাষ্ট্রে এখন চেক এ্যান্ড ব্যালেন্স নেই। এখন চলছে কে কত বড় আওয়ামী লীগার তার প্রতিযোগিতা। নতুনদের ব্যাপারটি সবসময়ই বেশি থাকে। তাই নতুন আগত আওয়ামী লীগারদের দাপটে পুরনোরাও কোণঠাসা। এক একজন জনপ্রতিনিধি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। তার কাছে জবাবদিহিতা চাইবে এমন সাহস অন্তত এ মুহূর্তে কারও নেই। ভিন্ন মত এতটা অসহনীয় যে, নিজ দলের কেউ গঠনমূলক সমালোচনা করলেও রক্ষা নেই। সবাই তার ওপর নিষ্ঠুরভাবে হামলে পড়বে। এই অবস্থার নাম হলো ভারসাম্যহীনতা। ভারসাম্যহীনতা প্রকৃতি আইনে কোন কিছুর জন্যেই ভাল কথা নয়। একটি উদীয়মান রাষ্ট্রের জন্যে তো নয়ই। না হলে যে উন্নয়ন হচ্ছে তা টেকশই হবে না। মানে টিকবে না। এই অবস্থায় বিএনপি একটি সম্মেলন করার সুযোগ পেল। বিএনপির নেতারা অবাক হয়ে দেখল তাদের ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচীর বিষয়ে কোন দিক-নির্দেশনা নেই। তাদের নেত্রী যে রূপকল্প দিলেন সেই রূপকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে বিএনপিকে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জিতে ক্ষমতায় যেতে হবে। তার মানে এ মুহূর্তে হয় বিএনপির নেতৃত্ব কোন অজ্ঞাত উৎস থেকে অতি রহস্যময় কোন সংকেত পেয়ে থাকবেন কিংবা তারা স্বপ্নিল রোমান্টিসিজমে ভুগছেন। রূপকল্পে খালেদা জিয়া বললেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। মানে প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অবসান ঘটানো হবে। এটি করবেন তিনি নিজে গদিতে গেলে। তার মানে নিজের ক্ষমতা নিজে কমাবেন। অনেকটা নিজের জান নিজে কবজ করার মতো ব্যাপার! নিজে যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন সে কথা ভাবেননি। কিন্তু মানুষ অবাক হয়ে দেখল নিজ দলেই তিনি এবং তাঁর বড় ছেলের জন্যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার ব্যবস্থা পাকা রেখেছেন যেন যে কোন নেতা-কর্মীকে নিয়োগ-বিয়োগ দেয়া যায়। যিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী হলে ক্ষমতা কমানোর অঙ্গীকার করেন তিনি নিজ দলের ক্ষুদ্র গ-ির ভেতরেই কাউকে বিশ্বাস করতে পারলেন না! আমরা অবাক হয়েও আর অবাক হই না যে, রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজেদের ছাড়া অন্যদের গ-মূর্খ ভাবেন। আমরা নিজেরাও মনে করি, ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দলের সাংসদরা প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবের বাইরে কিছু বলতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ কাজ দিতে পারত। এটি একটি পুরনো ধারণাও বটে। নব্বই দশকের যুগপদ আন্দোলনের সময় এটির কথাও ছিল। কিন্তু আমরা মনে রাখব, ক্ষমতায় গিয়ে খালেদা জিয়া সেই বেদবাক্য ভুলে গেলেন। যে বাক্য তিনি এখনও বলছেন। কিন্তু ধারণাটি মজার। এই ধারণা মতে, কোন আইন দলীয় কারণে যদি নিম্নকক্ষে পাস হয়, সেটা উচ্চকক্ষে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে। উচ্চকক্ষ গঠিত হবে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে। নিয়ম হবে, দুইকক্ষ একমত না হলে কোন আইন পাস হবে না। একইভাবে রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেবেন। এখানে প্রধানমন্ত্রীর কোন হস্তক্ষেপ থাকবে না। এগুলো ভাল। কিন্তু আমরা জানি, যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ। ‘এক নেতা এক পদ’ ধারণাটিও ভাল। কেন্দ্রীয় নেতারা একজন একাধিক পদ আঁকড়ে থাকেন। এতে নেতৃত্ব বিকশিত হতে পারে না। তাছাড়া, একজন অনেক পদে থাকলে তাঁর পক্ষে সব কাজ ভালভাবে করাও সম্ভব হয় না। ধারণা ভাল হলেই হবে না। তার বাস্তবায়ন হতে হবে। বিএনপি একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। তাদের কত বছর লাগবে একজন মহাসচিব দিতে! অবাক করা ব্যাপার হলো ষষ্ঠ সম্মেলনেও মির্জা সাহেব ভারমুক্ত হলেন না। বিএনপিতে চেয়ারপার্সন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদের পর দলের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ হলো মহাসচিব। সেটা অবশ্য দীর্ঘ পর ভারমুক্ত হয়েছে। দলের কয়েকটি পদে দায়িত্বপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা হয়েছে বটে তবে পুরো কমিটি এখনও ঘটেনি। তখন এই কথা বলতেই হয় দল হিসেবে বিএনপি এখনও পরিবারের বলয় থেকে বের হয়নি। অবশ্য শেষমেশ গত সপ্তাহে মির্জা সাহেব দীর্ঘদিন পর ভারপ্রাপ্ত থেকে ভারমুক্ত হলেন। যিনি গণতন্ত্রের জন্যে অহর্নিশি পাগল প্রায় তাঁর দলেই গণতন্ত্র নেই, এই ব্যাপারটি সম্মেলনে আমন্ত্রিত বিদেশী যারা বুঝলেন না, তাদের কথায় গুরুত্ব দিয়ে লাভ নেই। সুতরাং সে প্রসঙ্গ বলতে হয় না। আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে ক্ষমতার মালিক নিজ দেশের জনগণ। বিদেশের কেউ এসে এ যুগে কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে এই চিন্তা সুদূরপরাহত। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো এই মানের একটি রাষ্ট্রের বেলায়। বাংলাদেশ এখন যদু-মধু-কদু কোন আফ্রিকান দেশ নয় যে, বিদেশীরা এসে সুন্দর বনের সব বাঘের লেজ ছিঁড়ে ফেলবে। আর ভারত বিরোধিতার রাজনৈতিক বেলুন যেমনÑ ফুটো হয়ে গেছে তেমনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, মিথ্যা দিয়ে রাজনীতি এসব বুদবুদও সব ফেটে যাবে। সত্য আর সুন্দর রাজনীতি আজ সমাগত। আমরা তবুও বিশ্বাস করি, ব্যক্তির হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পুঞ্জিভূত হলে সংকট বাড়ে। এ কথা জাসদসহ বিভিন্ন সংগঠন আগেও বলেছে। আমরা বলব আওয়ামী লীগ এই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেও আপনারা নিয়মতান্ত্রিক দাবি জানান। অন্তত তাতেও ক্ষমতায় অন্য কারও উপস্থিতি অনুভূত হবে। কোন খসড়া, কমিটি, চিন্তা ছাড়া হঠাৎ এক সকালে উঠে এই রকম কথা বললে মানুষ গুরুত্ব দেবে না, হাসবে। অতীতে এমাজ উদ্দীন সাহেব বিপথে চালিত করে আপনাদের বহুবার হাসির পাত্রে পরিণত করেছে। এবার একটু ভাবুন। বিএনপি স্বীকার করে না যে, জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করে ফেলার সময়টাতেও তারা একনায়কতান্ত্রিকতা দূর করেনি। বরং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা আরও কী করে নিরঙ্কুশ করা যায়, সেই ব্যবস্থা করেছিল। আমাদের মনে আছে, ১৯৯১ সালে বিএনপি বাহাত্তরের সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত করে, যেখানে মন্ত্রিসভাকে রিক্ত করে নির্বাহী ক্ষমতা ব্যক্তিকে দেয়া হয়েছে। বরং সেরের ওপর সোয়া সের হলো তারা দলত্যাগ সংক্রান্ত গণতন্ত্রবিরোধী ৭০ অনুচ্ছেদকে আরও কঠোর করেছিল। বলতেই হবে ১৫তম সংশোধনীতে আওয়ামী লীগ সেটুকু বাদ দিয়েছে। খালেদা জিয়া বয়সের কথা তুলেছেন। তাঁরও উচিত হবে অবসরের একটা সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করা। প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা হ্রাস করার কথা বললেন। আবার সেই কাউন্সিলেই কোন দ্বিধা ছাড়াই বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও নির্বাহী কমিটির বাকি পদগুলো নির্বাচনে একক ক্ষমতা ও সর্বময় কর্তৃত্ব নিজ হাতে রেখে দিলেন। এর চেয়ে একনায়কসুলভ জগতে আর কি আছে! এই প্রশ্নের একটা উত্তর লাগবে। জনগণ এখন আর বোকা নয়। সংবিধান ও আইনের পরিবর্তন করবেন বলেছেন। পাইকারি কথা বাদ দিয়ে খুচরাভাবে বলতে হবে কোন্ কোন্ বিধান আপনারা বাদ দিতে চান। সুশাসনের জন্যে বর্তমান বিধানও তত বাধা নয়। বাঁধা হলো ব্যক্তির মন। তবে আমরা দেখলাম এখনও দলটিতে কোন হোমওয়ার্ক নেই। সরকারে না গিয়ে মানুষের আয় বাড়ানোর স্বপ্ন হাস্যকরই শোনায়! দল শাসনে একনায়কত্ব চলবে, আর দেশ শাসনে একনায়কত্ব ঘুচিয়ে বহুত্ববাদ চলবে, এটা এক নির্মম রসিকতা! এতকিছুর পরেও বলা যায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইন সভার ধারণা ভাল। তবে সব ভাল নির্ভর করে ব্যক্তির মনের ওপর। কারণ মনে যদি ভাদ্র মাস থাকে তাহলে উচ্চকক্ষেও দলীয় লোকে ভরে যাবে। সেই দলিলও পৃথিবীতে আছে ভূরি ভূরি। নিউজিল্যান্ড ৯৬ বছর পরে ১৯৫০ সালে দ্বিকক্ষ থেকে এক কক্ষে গেছে এই কারণে যে উচ্চকক্ষে রাজপরিবারের বাছাই করা ব্যক্তিদের সমাগম ঘটে। রাজপরিবার না থাকলেও রাজকীয় পরিবারের এখনও অভাব নেই জগতে। লেখক : ব্যাংকার মড়ষধসংধৎধিৎনফ@মসধরষ.পড়স
×