ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

রণাঙ্গনে বীর মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

রণাঙ্গনে বীর মুক্তিযোদ্ধা

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাত্রির দুর্যোগের ঘনঘটায় সারা বাংলা কেঁপে ওঠে। ২৬ মার্চে আসে স্বাধীনতা ঘোষণার সেই স্মরণীয় ক্ষণ। এরপর থেকে দীর্ঘ ৯ মাস চলে মুক্তিযুদ্ধের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। ১৬ ডিসেম্বরে বাংলা মায়ের অকুতভয়, দামাল ছেলেরা স্বাধীন মাটিতে উড়াল বহুকাক্সিক্ষত বিজয় পতাকা। ৩০ লাখ শহীদের রক্তঝরা ইতিহাস, দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হানিতার রক্তাক্ত দলিলে রঞ্জিত আমাদের প্রত্যাশিত এই স্বাধীনতা। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ এক বলিষ্ঠ নারী ব্যক্তিত্ব মালেকা খান আজও মুক্তিযুদ্ধের এক সাহসী প্রতিনিধি। নীরবে, নিঃশব্দে নিঃস্বার্থভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে। প্রচারবিমুখ এই অনন্য নারী মুক্তিযুদ্ধের স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে তাঁর দায়িত্ব এবং কর্তব্যনিষ্ঠাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের শুধু অর্জনই নয়, অনেক, কিছু হারানোর ব্যথায় আমরা কাতর, বেদনাঘন অনুভবে শোকার্ত। তাই যুদ্ধ জয়ের পরবর্তী কাজটা ছিল আরও কঠিন, দুরূহ এবং সমস্যাশঙ্কুল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের বিপর্যস্ত অবস্থা, অসংখ্য স্বজন হারানো পরিবারের আর্তনাদ, আরও তীব্রভাবে মা-বোনের সম্ভ্রম হানিতার করুণ আকুতি। সেই সন্ধিক্ষণে বিপন্ন মেয়েদের পাশে এসে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন এই নির্র্ভীক নারী মালেকা খান। এসব লাঞ্ছিত নারীদের বাঁচাতে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে সাধ্যমতো সবধরনের কর্মসূচী তিনি নিয়েছিলেন। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও এই নির্র্ভীক নারী মালেকা খান পেছনে ফিরে তাকাননি। অকুতভয় সেনানির মতো বীরদর্পে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অসহায়। আহত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত নারীদের পুনর্বাসের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বিজয়ের মাসে কবি সুফিয়া কামাল এবং কয়েকজন বিশিষ্ট নারীকল্যাণ কর্মীর উদ্যোগে অসহায় নারীদের উদ্ধার ও পুনর্বাসের কার্যক্রম শুরু করা হয়। পরবর্তীতে গঠন করা হয় কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা। মালেকা খান ছিলেন এ সংগঠনের পরিচালক। সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে তিনি সক্রিয় এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গার্লস গাইড এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারা বাংলায় যে গণজোয়ার তৈরি হয় সে জায়গা থেকে নারী অধিকারের ব্যাপারটিও সামনে চলে আসে। এরই ফল বদরুন্নেসা আহ্মেদের সহযোগিতায় মেয়েদের জন্য মালেকা খান সিভিল ডিফেন্সের প্রশিক্ষণ শুরু করেন। ১৯৭১ সালে নিগৃহীত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সোনার গাঁ’ প্রকল্প। এতেও মালেকা খানের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত জোরালো। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী-রাঞ্ছনার বেদনাদায়ক স্মৃতিচারণ করে আজও মালেকা খান অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেন। কি করেছেন তার চেয়ে ও বেশি কষ্ট দেয় যা করতে পারেননি। মালেকা খানের হাত দিয়ে নিগৃহীত, নিপীড়িত, অসহায় নারীদের জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় সেখান থেকেই আমরা অনুমান করতে পারি সাধারণ মানুষের প্রতি কি পরিমাণ দায়িত্ব ও মমত্ববোধ তাঁর ছিল। এই সহানুভূতিশীল, মানবিক নারী আজও আমাদের প্রাণিত করে, উদ্বুদ্ধ করে। মানুষের প্রতি দরদী হতে শেখায়। এক আলাপচারিতায় তিনি তাঁর এসব কার্যক্রম উল্লেখ করতে গিয়ে যা করতে পারেননি তার জন্য বেদনায় কাতর হয়ে ওঠেন। যুদ্ধাহত নারীদের জন্য তাঁর গৃহীত পদক্ষেপগুলো আমাদের সবার জানা দরকার। ১. ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ হাজারেরও বেশি নারী অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়। ২. অসংখ্য নারী তাদের নিজের বাড়িতে ফিরে যায়। ৩. অর্ধশত শিশুকে দেশের বাইরে দত্তক দেয়া হয়। ৪. পাঁচশ’ নারীকে পেশায় সম্পৃক্ত করা হয় এবং অনেক আহত নারীকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কৃত্রিম পা সংযোজন করা হয়। ৫. বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেয়া হয় যুদ্ধাহত অনেক নারীকে মা-বাবা হারা সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। ৬. আয়মূলক কর্মসূচীর উদ্যোগ নেয়া হয় এবং দক্ষ কর্মী তৈরির জন্য সুষ্ঠু প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা ছিল। যুদ্ধাহত নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবটি মালেকা খান মোটেও পছন্দ করেননি। যথাযথ মর্যাদা দিয়ে লাঞ্ছিত নারীদের সসম্মানে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে তাদের মেনে নেয়ার দাবি ছিল তাঁর। স্নেহশীল, মানবিক এবং কল্যাণময়ী বেগম সুফিয়া কামালের প্রতি তাঁর আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন আমরা মালেকা খানের চারিত্রিক ঔদার্যের ব্যাপারে অবহিত হই। তিনি মনে করতেন, বেগম সুফিয়া কামালের মতো নারী নেতৃত্ব সমানে না থাকলে এসব পদক্ষেপ নেয়া আসলেই কঠিন হতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাটি খুঁড়ে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে ২৪ জন সেনা মুক্তিযোদ্ধার দেহাবশেষ উদ্ধার করেন মালেকা খান এবং তাঁর নারী সহযোগীরা। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ভাঙ্গাসেতু, বিপর্যস্ত রাস্তাঘাটের মোকাবেলা করে এ কাজ করা আসলেই দুঃসাধ্য ছিল। মালেকা খানের নেতৃত্বে তাঁর সহযোগীরা সে কাজ করলেও চিরশায়িত সে সব সেনাদের পাশে নিবেদিত এসব নারীকর্মীর কোন নাম খোদাই করা নেই। আছে এক সেনাকর্তার নাম যার সঙ্গে এ কাজের কোন সম্পর্কই নেই। তবে এসব কল্যাণমুখী কাজ করেই তিনি খুশি। কোন প্রতিদানের আশা নয়। এ ধরনের মহতী কাজের অংশীদার হতে পেরে তিনি তৃপ্ত এবং অনেকাংশেই সার্থক। স্বাধীন হওয়ার পর দেশকে যথার্থ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তিনি উপেক্ষিত এবং অবহেলিত খাতগুলোর দিকে বেশি নজর দেন। সেই ভাবনা থেকে শিল্প এবং বাণিজ্য খাতের প্রতি তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। এ খাতকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন সাহসী পদক্ষেপ নিতে পিছপা হননি। শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ী চেম্বারের প্রথম নারী প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। কিন্তু ব্যবসা এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর অর্থ আয়ের কোন সম্পর্ক ছিল না। হস্ত এবং কুটির শিল্পের উদ্যোক্তা সভাপতির আসনও অলঙ্কৃত করেন। পুষ্প সাজানোর শিল্পেও তাঁর অবদান নেতৃত্বের শীর্ষে। জনহিতৈষী, নির্লোভ, নির্মোহ এই নারী ব্যক্তিত্ব অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকারী কোন উচ্চপদে আসীন হননি। শিল্প-বাণিজ্যের সফল উদ্যোক্তা হয়েও তাকে শিল্পপতি কিংবা ব্যবসায়ী হতে হয়নি। নিরলসভাবে কাজে জড়িত থেকে একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করতে চেয়েছেন মাত্র।
×