ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাহবুবা সুলতানা মনি

আমরা সচেতন হই

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

আমরা সচেতন হই

প্রয়োজনে আরও কঠোর আন্দোলনে নামবে সারা বাংলাদেশ, লংমার্চ করব আমরা দেশব্যাপী, তবুও ‘তনু’ হত্যার বিচার আদায় করে ছাড়ব আমরা যে কোন কিছুর বিনিময়ে- দু’দিন আগেও ঠিক এতটাই জোরালো সংকল্প নিয়ে আমরা রাজপথে নেমেছিলাম। কাউকে ছোট করে বলছি না, ‘জাস্টিস ফর তনু’ আন্দোলনের আমিও একজন সক্রিয় আন্দোলনকারী ছিলাম, সক্রিয় বলতে শুধু সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় নয়, রাজপথেও ছিলাম। আজ আমিও যেন স্তিমিত হয়ে গেছি বাকিদের মতো। আরও একবার ভুলে যেতে বসেছি আরেকজন ইয়াসমিনকে। এভাবেই আমাদের সমাজে দিনে দিনে এক একজন ইয়াসমিন, তনু তথাকথিত পশুদের সাময়িক লালসার শিকার হবে? আর আমরা দু’দিন আন্দোলন করে থেমে যাব? ভুলে যাব ওদেরকে? তনু চলে যাবার পর অনেকেই অনেক মন্তব্য করেছেন এই ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে। কেউ বলেছেন, রাষ্ট্রের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায় যদি এই ধরনের ঘটনা ঘটে তাহলে আমরা কোথায় নিরাপদ? সত্যিই তো, আমরা কোথাও নিরাপদ নই, বিশেষ করে মেয়েরা, একদমই নিরাপদ নই। কেউ আবার বলেছেন, যে মেয়ে হিজাব পরা সত্ত্বেও নাটক করে বেড়ায়, গান গায়, মঞ্চে নাচে, সেই মেয়ে আর কত ভাল হবে? এই কথাটাও ফেলতে পারছি না। তাইই তো, যে মেয়ে হিজাব পরে সে কেন নাটক করবে, কেন গান করবে, কেন সংগঠন করবে? সে তো শুধু চুপচাপ কলেজ আর বাসায় যাতায়াত করবে। সমাজ, দেশের প্রতি তার তো কোন দায় নেই, তাই না? আচ্ছা, কে বলেছে বলুন তো, একটা মেয়ে হিজাব পরলেই আর কোন সামাজিকতা বা সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবে না? আমরা কেন আমাদের চিন্তা কেন এত সঙ্কীর্ণ করে ফেলছি দিন দিন? কেন পর্দার মানটাকে অসম্মান করছি আমাদের নিচ ভাবনার সামনে? কোন মেয়ের সঙ্গে এই ধরনের অমানুষিক ঘটনা ঘটলেই আমরা একদল মানুষ আছি যারা কয়েকদিন খুব প্রতিবাদ করি, ধিক্কার জানাই আর একদল মানুষ আছি যারা মেয়েটার চাল-চলন নিয়ে কথা বলতে শুরু করে দেই। ‘নিশ্চয়ই মেয়ের চাল চলন ভাল ছিল না‘, ‘বেপর্দায় চললে এই হবে’, ‘আমাদের সমাজ দিন দিন অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে’, ‘আজকালকার মেয়েগুলো যেমনে চলে, ছিঃ’- এই জাতীয় কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে ওই মেয়েটাকে অপরাধী করে তুলি। আমরা দুটো দলই খুব অসহায়। কারোরই ওই অসহায় মেয়েটা বা মেয়েটার পরিবারের জন্য কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। একদল সহানুভূতি জানাই, আরেক দল দায়ভার এড়িয়ে গা-বাঁচিয়ে চলি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন আমাদের গা-বাঁচিয়ে দায়সারাভাবে কাটাব বলুন তো? সত্যি যদি একটি মেয়ে নির্যাতিত হওয়ার পেছনে তার পোশাকই দায়ী হবে, তবে কেন তনুর সঙ্গে এমনটা হলো? ওই মেয়েটা তো আর আমাদের মতো বেপর্দায় চলত না? একটা চার বছরের মেয়ে যখন একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের লালসার শিকার হয়, তখন কি সত্যিই মেয়েটার পোশাক দায়ী থাকে, নাকি ওই বিকৃত লোকটার নোংরা মানসিকতা? আমাদের বোধহয় আরেকটু সচেতন হবার সময় চলে এসেছে। এই সচেতনতা শুধু আমাদের তরুণদের মানসিকতা, চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতার উৎকর্ষের জন্য নয়। আমাদের নিজেদের চিন্তাভাবনার মধ্যেও আনতে হবে পরিবর্তন। আরেকটু উদার হয়ে ভাববার সময় এখনই। ১. ছেলেমেয়েদেরকে পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গাটা বোঝানো উচিত ছোটবেলা থেকেই। ২. একটা ছেলে যদি ছোটবেলা থেকে এটা দেখেই বড় হয় যে তার পরিবারের মেয়েদের কোন সম্মানই দেয়া হচ্ছে না, তবে সেও বড় হয়ে মেয়েদের সম্মান করবে না, বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। আমাদের শুধু নিজেদের জায়গা থেকে একটু উঠে দাঁড়াতে হবে, ঘুরে দাঁড়াতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে। জানি বিষয়টা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব তো নয় বলুন? আমাদের এই সচেতনতাই হয়ত বদলে দেবে কালকের পৃথিবী। আর কালকের সেই নতুন পৃথিবীটাই আমাদের স্বপ্নের পৃথিবী হবে। দোষ আসলে পোশাকের নয়, আমাদের মানসিকতার, দৃষ্টি-ভঙ্গির। আমরা একটু চেষ্টা করি, নিশ্চয়ই পাল্টে যাবে আশপাশের এই নোংরা মানুষগুলোর নোংরামি। তাহলে হয়ত আর কখনও টেলিভিশন কিংবা পত্রিকার শিরোনাম হতে হবে না কোন তনুকে। কোন ধর্মই মেয়েদের অসম্মান করা শেখায় না, মেয়েদের সম্মান করাই মানবধর্ম।
×