ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদেরও এগিয়ে আসতে হবে হত্যার নিন্দায় ॥ জাতিসংঘ

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদেরও এগিয়ে আসতে হবে হত্যার নিন্দায় ॥ জাতিসংঘ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, অধ্যাপক, মানবাধিকার কর্মী, পুরোহিত হত্যার ঘটনায় সরকার এখন প্রবল বিদেশী চাপে রয়েছে। একের পর এক হত্যাকা- ঘটতে থাকায় বিদেশীদের উদ্বেগও সরকারের উচ্চপর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে ইউএসএইড কর্মী জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকা-ের পর দেশে-বিদেশে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েছে। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এই চাপ এখন অনেক বেশি। দোষীদের গ্রেফতারের পাশাপাশি দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা। এ ছাড়া বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংস ঘটনায় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের নিন্দা জানানো উচিত বলে মনে করছেন বিদেশী কূটনীতিকরা। এদিকে বৃহস্পতিবার জুলহাস মান্নানসহ দু’জনকে হত্যায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে চরমপন্থার বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। ইউএসএইড কর্মী জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যার পরে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েছে। অতীতে বিভিন্ন হত্যাকা-ের পরে বেশ কয়েকটি দেশ থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হলেও এবার সেটা আরও বেড়েছে। বিশেষ করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছেন, তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করে ঘটনার দ্রুত তদন্ত করে বিচার দাবি জানিয়েছে। এ ছাড়া এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, সিপিজে, আইফেক্স ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোও প্রতিবাদ জানিয়ে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও হত্যার খবর অতীতের চেয়ে বেশি প্রচার হচ্ছে। জুলহাস মান্নান মার্কিন দূতাবাসে কর্মররত ছিলেন। এ ছাড়া মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের একজন কর্মী হওয়ার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই হত্যার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকেও তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সরকার থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দোষীদের গ্রেফতারের জন্য আশ্বস্তও করা হয়। বিদেশী কূটনীতিকদের অভিমত, ভিন্নমতের মানুষকে হত্যার অর্থ হলো মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত। এই হত্যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমনভাবে হত্যা মত প্রকাশ ও মানবাধিকারের প্রতি চরম আঘাত। জুলহাস মান্নান, মাহবুব রাব্বী তনয়, অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী, সাধু পরমানন্দ রায়, নাজিমুদ্দিন সামাদ, অভিজিত রায়, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ, রাজীব হায়দার, ফয়সাল আরেফিন দীপন প্রমুখ হত্যার ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়। ভিন্নমতের মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে তারা। বিদেশীদের কূটনীতিকরা বলছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশে মানবাধিকার, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সুশীল সমাজের সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছেন। দোষীদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছে তারা। বিদেশী কূটনীতিকরা জানান, বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার ঐতিহ্য রয়েছে। তবে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব হত্যাকা- সেই ঐতিহ্য ম্লান করে দিচ্ছে। বাংলাদেশে দুই মানবাধিকারকর্মীর পর নৃশংস হামলার ঘটনায় তারা বলছেন, এটা শুধু দুজন সাহসী মানুষের ওপর নয়, এই দেশের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হামলা। দ্রুত ও ব্যাপক তদন্ত নিশ্চিত করতে সব ধরনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা। মত প্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার রক্ষায় ঘুরে দাঁড়াতে পুরো সমাজের জন্য এখনই সময়। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিন্স বলেছেন, বাংলাদেশে অসহিষ্ণুতা থেকে সহিংসতা বেড়েই চলেছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠদের সঙ্গে যাদের মতের অমিল রয়েছে তারাই এর শিকার হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাও এ ধরনের একটি ঘটনা ছিল। রবার্ট ওয়াটকিন্স বলেন, সব মানুষেরই সন্ত্রাস এবং বৈষম্যহীন পরিবেশে বাঁচার অধিকার রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংস ঘটনায় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের নিন্দা জানানো উচিত বলে জাতিসংঘ মনে করে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের সহিংসতা আরও বাড়াবে বলে মন্তব্য করেছেন রবার্ট ওয়াটকিন্স। এদিকে বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবৃতি, জুলহাস মান্নানসহ দুজনকে হত্যায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) পার্লামেন্টের দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির প্রধান জিন ল্যামবার্ট। উগ্র সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজকে এক হয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন এই ইউরোপীয় রাজনীতিক। ঢাকায় ইইউ দূতাবাস জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের কাছে নাগরিকের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে নিশ্চিত করার আহ্বানও জানান ল্যামবার্ট। বিবৃতিতে ল্যামবার্ট বলেন, ইইউ পার্লামেন্টের দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির প্রধান হিসেবে আমি সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটা হত্যাকা-গুলোর বিষয়ে গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা জানাই। বিশেষ করে সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক পত্রিকা রূপবানের সম্পাদক জুলহাস মান্নানসহ দুজনকে হত্যার জন্য। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ লেখক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যা করছে। এভাবে এ মাসে একজন আইনের ছাত্র ও ইংরেজী বিভাগের শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে। জিন ল্যামবার্ট বলেন, আমরা জুলহাস এবং অন্য নিহত ও আহত ভুক্তভোগীদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করি। যারা এ ধরনের বর্বর ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদের ধরে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
×