ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ সফলতার পরিচয় দিয়েছে ॥ জাতিসংঘ

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ সফলতার পরিচয় দিয়েছে ॥ জাতিসংঘ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের করা প্রক্ষেপণ ৭ দশমিক ০৫ হবে না বলে মনে করছে জাতিসংঘ। বলা হচ্ছে, চলতি ২০১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ আর আগামী ২০১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৭ শতাংশে পৌঁছাবে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বিশ্ব মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার হারাতে পারে বাংলাদেশ। তাছাড়া ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ না বাড়া এবং উৎপাদনশীলতা কমায় এমনটা আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে এর আগে বিশ্বব্যাংক ও এডিবিসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থারগুলোর প্রক্ষেপনেও বলা হয়েছে, প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচেই থাকবে। সংস্থাটির ইকোনমিক এন্ড সোশ্যাল সার্ভে অব এশিয়া এন্ড দ্য পেসিফিক ২০১৬-এর প্রতিবেদনে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁও-এ আইডিবি ভবনে ইউএন অফিস সম্মেলন কক্ষে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি রবার্ট ওয়াটকিনস, ইউএনএসকাপ-এর ইকোনমিক এ্যাফেয়ার্স অফিসার ড. শুভজিৎ ব্যানার্জী এবং ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে অংশ নেন জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও ইউএন এসকাপের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি ড. শামসাদ আকতার। আলোচনায় অংশ নেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জগুলোর কথা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, এগুলো হচ্ছে প্রবৃদ্ধির সুফল সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে সমানভাবে পৌঁছানো, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুত ও জ্বালানির ঘাটতি পূরণ,পোশাক খাতের বাইরে রফতানি বহুমুখীকরণ, পোশাক শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক কর্মকা- বহুমুখীকরণ, দক্ষমতা উন্নয়ন ইত্যাদি। তাছাড়া বাংলাদেশে ননপারফর্মিং লোন বেশি হচ্ছে, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) কার্যকর বাস্তবায়ন ইত্যাদি। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ অংশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। ২০১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে, যা ২০১৪ সালে ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। যদিও তৃতীয় কোয়ার্টারে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জিডিপিতে ব্যক্তিখাতের ভোগ কমার লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। কিন্তু পরিবারভিত্তিক ক্রয় ক্ষমতা কিছুটা স্বাভাবিক ছিল। এর পিছনে অন্যতম বিষয় ছিল সহনীয় মূল্যস্ফীতি, রেমিটেন্স বৃদ্ধি, সরকারী খাতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে দেখা যায়, যা মোট রফতানির ৮০ শতাংশ, ইউরোপের মন্দা ও তুলনার দাম কমে যাওয়ায় কিছুটা কম ছিল। ২০১৫ সালে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিন্মমুখী ছিল, যা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এটি হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রা নীতি এবং বিনিময় হারের স্থি’তিশীলতার জন্য। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে বিশ্ব বাজারের দ্রব্যমূল্য কম হওয়ার সুবিধা। প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় শুভজিৎ ব্যানার্জী বলেন, অর্থবছর ২০১৬-তে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান ভাল হবে এবং অভ্যন্তরীণ ভোগ বাড়বে। সরকার ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। আমরা সেটি থেকে কিছুটা কম পূর্বাভাস দিয়েছি, কিন্তু অন্য উন্নয়নসহযোগীদের চেয়ে তা পজেটিভ। তবে আমরা মনে করি সরকারের পূর্বাভাসের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও ভাল। তিনি বলেন, বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমছে। এটা ভাল। কিন্তু দারিদ্র্য হার অনেক বেশি কমানোর সুযোগ রয়েছে। বৈষম্য বাড়ছে। এ বিষয়ে সরকারকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির সুফল সমানভাবে পৌঁছাচ্ছে না। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার সুফল নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের কাছে যাচ্ছে না। সেটি না হলে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও এর প্রকৃত সুফল মিলবে না। তবে সরকারকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। যেমন ইউএস ইন্টারেস্ট রেট বাড়ছে। তাই এর একটি প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশে অর্থনীতি এখন পর্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু সবসময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে কিন্তু এফডিআই আসছে না, অথচ বাংলাদেশেল জন্য এফডিআই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান এবং ব্যাপক শহরায়ন হচ্ছে, এটি ভাল কিন্তু সরকারের জন্য এর ব্যবস্থাপনা একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। মানসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে এটি অন্যতম বাঁধা হিসেবে দেখা দেবে। সরকার কর রাজস্ব আদায়ের দিকে নজর বাড়াতে হবে। সরকার ট্যাক্স পলিসি এবং ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে যাচ্ছে এটি ভাল দিক। তবে আয়কর আদায়ের দিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, কৃষি খাত হয়ত প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম নিয়ামক হবে না, কিন্তু তারপরও কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। কেননা কৃষি খাত বাদ দিয়ে কোন কিছু করা যাবে না। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রতিবেদন বিষয়ে বলেন, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ উপকৃত হচ্ছে। তেলের দাম কম আছে এবং দ্রব্যমূল্য কম হওয়ায় আমদানিতে দাম কম পাচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশেল মূল্যস্ফীতি খুব বেশি আন্তর্জাতিক বাজার নির্ভর। বর্তমান পরিস্থিতি তাই বাংলাদেশের জন্য শুভকর। কিন্তু অন্যদিকে রেমিটেন্স কম আসছে। মানুষ ভাবছে বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। স্বল্প মেয়াদে এ ভাবনা ঠিক। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর খারাপ প্রভাব পড়বে। কেননা বিশ্ব পরিস্থিতি বর্তানে খুবই জটিল অবস্থায় রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা নিতে হবে। আগামী বাজেটে অবশ্যই কিছু উদ্যোগ নিতে হবে সেগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে কোন সমস্যা দেখা দিলে তা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন ভাল। তবে তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ এখনও গরিব রয়েছে। মাত্র দেড় শ’ টাকায় তাদের সংসার চালাতে হয়। এমন যদি অবস্থা হয়, তাহলে উন্নয়ন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। শ্রমিকদের উৎপাদন শীলতা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভাল। কিন্তু এলডিসি দেশগুলোর তুলনায় কম। বাংলাদেশে একজন শ্রমিক যা উৎপাদন করে তাই এই অঞ্চলের ৪০ শতাংশ। যতই প্রবৃদ্ধি বারানো হোক না কেন, মানুষের হাতে বিশেষ করে শ্রমিকদের হাতে টাকা আসবে না। কিন্তু বিশ্ব পর্যায়ে চিন্তা করলে দেখা যায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা অনেক কম। মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি সহনীয়। তবে আঞ্চলিক ভিত্তিতে দেখলে দেখা যাবে যেখানে মূল্যস্ফীতি ৩ শতাংশ, বাংলাদেশে সেখানে ৬ শতাংশ। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ব্যাপক শহরায়ন হচ্ছে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান ঘটছে। কিন্তু তারা কোন ইন্স্যুরেন্সের আওতায়ই নেই। যেকোন সময় তাদের অবস্থা নিচের দিকে চলে যেতে পারে। বাংলাদেশে উন্নয়নে মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে হবে। গবেষণা, সুজনশীলতা বাড়াতে হবে, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্ব বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে হবে। কেননা বাংলাদেশের শিক্ষা বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। সরকারী ক্রয় মানসম্মত করার পক্ষে মত দিয়েছেন দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, মানসম্মত সরকারী ক্রয় বাড়াতে হবে। সরকারী ব্যয় যা হচ্ছে তার কোন প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ছে না। তিনি বলেন বিভিন্ন খাতে সরকারী ব্যয় বাড়লেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে কাক্সিক্ষত ব্যয় বাড়ছে না। সামাজিক নিরাত্তার আওতায় অতিদরিদ্ররা আসলেও আগামীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেও এর আওতায় আনতে হবে। তার মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবাসহ বিভিন্ন সেবা সঠিকভাবে পাচ্ছে না। সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেছে চলতি অর্থবছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যেই থাকবে।
×