ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষ সতর্কতা জারি, পাস-পারমিট বন্ধ ॥ উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি

এক মাসে সুন্দরবনে চারবার আগুনে তোলপাড়

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

এক মাসে সুন্দরবনে চারবার আগুনে তোলপাড়

বাবুল সরদার, বাগেরহাট থেকে ॥ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনে এক মাসের মধ্যে চতুর্থ দফায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। বার বার একই রেঞ্জে আগুল লাগার কারণ অনুসন্ধানে বন বিভাগের পাশাপাশি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও তদন্তে নেমেছেন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও কাজ করছে। বন মন্ত্রণালয়ের ৬ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন এবং চাঁদপাই রেঞ্জে পাস-পারমিট বন্ধ করে বিশেষ ‘সতর্কতা’ জারি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-৬ খুলনার কমান্ডিং অফিসার (সিও) খন্দকার রফিকুল ইসলাম সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তিনি এখানে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন। জনকণ্ঠকে তিনি জানান, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের একই রেঞ্জের একই স্টেশনে বার বার আগুন লাগার বিষয়টি অত্যন্ত রহস্যজনক। এটি উদ্বেগের বিষয়। তাই সরেজমিন সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় খতিয়ে দেখার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এদিন প্রশাসন ও বন বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম জানান, স্পর্শকাতর এ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। বাগেরহাটের পুলিশ সুপার মোঃ নিজামুল হক মোল্লা জানান, অগ্নিকা-ের ঘটনায় বন বিভাগের দায়ের করা দুই মামলার আসামিদের গ্রেফতারে জোর অভিযান চলছে। এদিকে, এক মাসে চতুর্থ দফায় বুধবার পঁচিশ নম্বর কম্পার্টমেন্টের তুলাতলা এলাকায় লাগা আগুন বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিটের নিরন্তর চেষ্টার পর বৃহস্পতিবার বিকেলে নিয়ন্ত্রণে আসে। চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক বেলায়েত হোসেনের ভাষায়, আগুন সম্পূর্ণ নিভে গেছে। স্থানীয় দুর্বৃত্তরা এবারও সুন্দরবনে আগুন দিয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মানিকুজ্জামান বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও মোঃ সাইদুল ইসলাম জানান, ক্ষয়ক্ষতির সঠিক হিসাব এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হচ্ছে। নাশকতায় এ আগুন ॥ গত ১৩ ও ১৮ এপ্রিল সুন্দরবনে আগুন দেয়ার অভিযোগে স্থানীয় কয়েকজন দুর্বৃত্তকে আসামি করে বন বিভাগ পৃথক দুটি মামলা করে। ওই মামলার আসামিরা ক্ষুব্ধ হয়ে নাশকতায় এ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করেছেন বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মোঃ জহির উদ্দিন আহমেদ। এ আগুনের ঘটনায় সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের এসিএফ বেলায়েত হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিশেষ সতর্কতা ॥ এক মাসের মধ্যে সুন্দরবনে চতুর্থ দফা আগুন লাগার ঘটনায় বনের চাঁদপাই রেঞ্জজুড়ে ‘বিশেষ সতর্কতা’ জারি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায় সব ধরনের পাস (পারমিট) বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) জহির উদ্দিন আহম্মেদ আরও বলেন, বার বার আগুনের ঘটনায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে চাঁদপাই রেঞ্জে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এই রেঞ্জের সব এলাকায় জেলে, বাওয়ালি, মৌয়াল এবং সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকারও সংরক্ষিত করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ বিশেষ সতর্কতা জারি থাকবে বলেও জানান তিনি। মধু আহরণে আগুনÑ বনমন্ত্রী ॥ এদিকে বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মনে করেন, মধু আহরণকারীদের অসতর্কতার কারণে সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগছে। বৃহস্পতিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মধু আহরণ করতে গিয়ে আগুন জ্বালাতে হয়। এখন শুষ্ক মৌসুমে বনের ঝরা পাতাগুলো আরও বেশি শুষ্ক থাকে। এ কারণে শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগছে। উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি ॥ অপরদিকে, সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগার ঘটনায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বৃহস্পতিবার বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শেখ মোঃ তৌহিদুল ইসলাম জানান, মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (আইন) মোঃ মোজাহেদ হোসেনকে। কমিটির সদস্য সচিব বন বিভাগের সিএফ জহির উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, কমিটিতে বন বিভাগ, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ছাড়াও জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের প্রতিনিধি রয়েছেন। আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগার কারণ উদ্ঘাটন ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা শীঘ্র ঘটনাস্থলগুলো পরিদর্শনে যাবেন বলে জানান তিনি। মাছের বিল ও ভূমি দখলে বার বার আগুন ॥ তবে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার একাধিক সূত্র জানায়, লোভনীয় মাছের বিল দখল এবং ভূমি দখলের সুদূরপ্রসারী কৌশলের অংশ হিসেবে দুর্বৃত্তরা বার বার নাশকতার আগুন দিচ্ছে। শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউপি চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির শরণখোলা রেঞ্জের সভাপতি আসাদুজ্জামান মিলন জানান, সুন্দরবনের ধানসাগর স্টেশনের ওই এলাকায় বনে দশটি নিচু এলাকা রয়েছে। গ্রীষ্মকালে এখানে পানি থাকে না। কিন্তু বর্ষার শুরুতে পানি ভরে যায়। তখন এই বিলগুলোতে প্রচুর পরিমাণ কই, শিং ও মাগুরসহ দেশী মাছ পাওয়া যায়, যা খুব লোভনীয়। তাই মাছ ধরার সুবিধার্থে শুষ্ক মৌসুমে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। তার মতে, আট থেকে দশজনের একটি প্রভাবশালী চক্র বনের ওই বিল এলাকায় বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরা নিয়ন্ত্রণ করে। বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হাত করে তারা জেলেদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে সেখানে মাছ ধরার সুবিধা করে দেয়। ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আরও জানান, ভোলা নদী শুকিয়ে যাওয়ায় নদীর চর এখন দখল হয়ে গেছে। কতিপয় প্রভাবশালী ওই চর দখলে রেখেছে। তিনি ওই চর উদ্ধার করে পরিকল্পিত বনায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। পাশাপাশি বনের ওপর থেকে চাপ কমাতে বনসংলগ্ন বাসিন্দাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের দাবি করেন।
×