ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পুনর্বাসনের অপেক্ষায় ওরা আনন্দে;###;সরকারের উদ্যোগ ব্যর্থ করতেও তৎপর একটি মহল

ঢাকার ক্যাম্পগুলোতেই মাসে অপচয় ১০ কোটি টাকার বিদ্যুত

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

ঢাকার ক্যাম্পগুলোতেই মাসে অপচয় ১০ কোটি টাকার বিদ্যুত

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আদালতের রায়ে উর্দুভাষী অবাঙালীদের ক্যাম্পগুলোতে একদিকে বইছে আনন্দের বন্যা, অন্যদিকে শুরু হয়েছে নতুন ষড়যন্ত্র। ক্যাম্পের বাসিন্দরা দীর্ঘ সময় পর যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। উর্দুভাষী অবাঙালীদের পুনর্বাসনে সরকারের নেয়া উদ্যোগের ফলে ক্যাম্পবাসীদের মধ্যে আনন্দের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে ঢাকার ক্যাম্পের বাসিন্দারা। ক্যাম্পবাসীরা নিজের ঠিকানায় বসবাসের স্বপ্ন বুনছেন। ক্যাম্পে আনন্দের জোয়ার বইলেও ক্যাম্পের বাইরে বসবাসকারী উর্দুভাষী অবাঙালীদের মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। তারা সরকারের পুনর্বাসনের উদ্যোগ ভেস্তে দিতে ক্যাম্পগুলোতে তৎপর থাকা এনজিও এবং ক্যাম্পের নেতাদের নিয়ে ষড়যন্ত্রে মেতেছে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে জোরালো অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণ হওয়া মাত্রই তাদের আইনের আওতায় আনার কড়া নির্দেশ জারি করেছে সরকার। ক্যাম্পবাসীদের প্রতিক্রিয়া ॥ মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের ক্যাম্পগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে উচ্চস্বরে গান বাজছে। ছেলে মেয়েরা ইচ্ছামতো সেজে এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়াচ্ছে। সবার মুখেই হাসি। পরিচয় দিয়ে কারণ জানতে চাইতেই খুশিতে আত্মহারা উর্দুভাষী অবাঙালীরা। জানালেন তাদের খুশির কথা। তাদেরই একজন ত্রিশ বছর বয়সী শাহিদা বেগম। কোলে একমাত্র পুত্র সন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজিয়ে গল্প করছিলেন মায়ের দোকানের সামনে। মা পান বিড়ি সিগারেটের দোকানে বসে আছেন। মেয়ের হাতে ছোট ছোট দুই খিলি পান দিলেন। তা আয়েস করে চোখ বন্ধ করে চিবুচ্ছিলেন শাহিদা। জানতে চাইতেই শাহিদা বলছিলেন, আরে এখন আর দুঃখ কিসের! আর মাত্র কটা দিন। তারপরই নিজেদের ঠিকানা হবে। সরকার আমাদের মেনে নিয়েছে। দেশের হাইকোর্ট আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। আমাদের পুনর্বাসন করার রায় হয়েছে। খুশি হবো না! বহু বছরের ক্যাম্পের কষ্টের জীবনের অবসান ঘটছে। এর চেয়ে আনন্দের কি হতে পারে। আপনারাও মানুষ। আমরাও মানুষ। আপনাদের সঙ্গে মিলে মিশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকব। পাকিস্তান যাওয়ার ইচ্ছে হয় কিনা? জানতে চাইলে অনেকটা যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, আমি এ দেশে জন্মেছি। আমি এ দেশের নাগরিক। আমার জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। পাকিস্তান যাব কেন? প্রশ্নই আসে না। পাকিস্তানের মতো একটি অস্থির দেশে যে যেতে চায়, সে নেহায়েতই বোকার স্বর্গে বাস করে। তাকে পাকিস্তানেই পাঠিয়ে দেয়া উচিত। পাকিস্তানে হরহামেশাই জঙ্গী হামলা হচ্ছে। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। হত্যার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না নারী ও কোমলমতি শিশুরাও। শুধু শুধু আমি নই, ক্যাম্পের যাকে জিজ্ঞাসা করবেন, সেই বলবে বাংলাদেশে থাকব। অনেকের সঙ্গে কথা বললে তারাও বাংলাদেশেই বসবাসের কথা জানান। তারা পাকিস্তানে যেতে নারাজ। ক্যাম্পে নানাভাবে সরকারের অর্থের অপচয় ॥ উর্দুভাষী অবাঙালীদের বসবাসের ক্যাম্পগুলোর সার্বিক দায়িত্বে রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ক্যাম্পগুলোতে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্যাম্পের আশপাশের জায়গায় যত্রতত্রভাবে ঘর তুলে বসবাস করছে ক্যাম্পবাসীরা। বাড়তি জনসংখ্যার কারণে পানি ও বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে গেছে। ক্যাম্পগুলোতে ব্যবহৃত পানি ও বিদ্যুতের জন্য সরকারকে কোন প্রকার বিল পরিশোধ করতে হয় না। এজন্য ক্যাম্পের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি পানি ও বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ দিয়ে থাকেন। এতে করে প্রতিমাসে শুধু ঢাকার ক্যাম্পগুলো থেকেই অন্তত ১০ কোটি টাকার বিদ্যুত অপচয় হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী বিষয়ক সেলের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, অনেক উর্দুভাষী অবাঙালীদের অনেকেই ভোটার। তাদের সঠিক পরিসংখ্যান কত তা জানাতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের বলা হয়। ভোটারদের আলাদা তালিকা করে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়। কারণ যেসব উর্র্র্দুভাষী অবাঙালী ভোটার তারা বিদ্যুত ব্যবহার করলে সরকারকে বিদ্যুতের বিল দিতে হবে বলেও চিঠিতে বলা হয়েছে। পুনর্বাসনের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমি ॥ মোহাজের ওয়েল ফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন সূত্রে সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী দেশের ৩৮টি জেলায় মোহাজেরদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারীভাবে প্রায় ৩৪ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ ও ক্রয় করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৭ জেলায় ২ হাজারের বেশি, চট্টগ্রাম বিভাগের ৭ জেলায় ২৫০ একরের বেশি, রাজশাহী বিভাগের ৫ জেলায় ৬শ’ একরের বেশি, রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ১৭ হাজার একরের বেশি, খুলনা বিভাগের ৮ জেলায় ৫ হাজার একরের বেশি, বরিশাল বিভাগের ২ জেলায় প্রায় ৯ একরের বেশি ও সিলেট বিভাগের ১টি জেলায় ৬ হাজার একরের বেশি জমি সরকারীভাবে অধিগ্রহণ ও ক্রয়কৃত অবস্থায় আছে। সরকারের উদ্যোগ ॥ সম্প্রতি দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে ক্যাম্পগুলো কি পরিমাণ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত তার প্রকৃত হিসাব জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। কয়েকটি জেলা এ সংক্রান্ত তথ্য দিয়েছে। তবে ঢাকা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, মেহেরপুর ও সিলেট জেলার তরফ থেকে ক্যাম্পের জায়গা সংক্রান্ত কোন তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েনি। মন্ত্রণালয় দ্রুত এসব জেলা প্রশাসককে ক্যাম্পগুলো কি পরিমাণ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত তা জানাতে তাগিদপত্র দিয়েছে। চলতি বছরের প্রথম দিকে মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে ঢাকার ক্যাম্পের বাসিন্দাদের রাজধানীর পার্শ্ববর্তী স্থানে স্থানান্তর সংক্রান্ত এক চিঠি দেয়া হয়। তাতে বলা হয়, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে উর্দুভাষী অবাঙালীদের ২৪ হাজারের বেশি পরিবারে লক্ষাধিক সদস্য রয়েছেন। তাদের প্রতিটি পরিবারকে পুনর্বাসন করতে তিন শতাংশ হারে ৭শ’ ২৬ একর জমির প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মোহাজের পুনর্বাসনের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমি থেকে অবাঙালীদের সুবিধামতো জেলায় পরিবারভিত্তিক জমি বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। উর্দুভাষী অবাঙালীদের বসবাসের বহুতল ভবন নির্মাণের নক্সা হস্তান্তর ॥ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে উর্দুভাষী অবাঙালীদের পুনর্বাসনের জন্য স্বল্প জায়গার ওপর বহুতল ভবন নির্মাণের একটি প্রস্তাবও দেয়া হয় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এলকন বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানির তরফ থেকে বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণের একটি নক্সাও দেয়া হয় ওই প্রস্তাবের সঙ্গে। প্রস্তাবপত্রে আবাসিক ভবনের পাশাপাশি হাসপাতাল, স্কুল ও ক্লিনিকসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণের কথাও রয়েছে। মন্ত্রীর বক্তব্য ॥ এ ব্যাপারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীরবিক্রম) জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বসবাসরত উর্দুভাষী অবাঙালীদের পুনর্বাসনের বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। এজন্য নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। সরকারের উদ্যোগ ভেস্তে দিতে নানা অপতৎপরতা ॥ হাইকোর্টের রায়ের পর ক্যাম্পে বসবাসরত বাসিন্দাদের মধ্যে আনন্দ বয়ে যাচ্ছে। তবে ক্যাম্পের বাইরে থাকা উর্দুভাষী অবাঙালী পরিবারগুলোতে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। কারণ হাইকোর্টের রায়ে ক্যাম্পের বাইরে থাকা উর্দুভাষী অবাঙালীদের উচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে প্রায় আড়াইশ পরিবার ক্যাম্পের বাইরে বিভিন্ন প্লটে বসবাস করছেন। এমন রায়ের পর প্লটের দখল বুঝে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্লট সংশ্লিষ্টরা। এজন্য ওইসব পরিবারের সদস্যরা এবং কতিপয় উর্দুভাষী অবাঙালী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ কিছু এনজিওকে সঙ্গে নিয়ে সরকারবিরোধী অপতৎপরতা শুরু করেছে। যাতে সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে। কারণ সরকার পুনর্বাসন করলে এনজিও ও উর্দুভাষী নেতাদের অবৈধ রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। মাঠে মারা পড়বে এনজিওগুলোর কোটি কোটি টাকার বিদেশী ফান্ড আনার প্রক্রিয়া। এ কারণে জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামার চেষ্টা করছে এনজিও, উর্দুভাষী কতিপয় নেতৃবৃন্দ ও ক্যাম্পের বাইরে থাকা উর্দুভাষী অবাঙালীরা। এনজিও এবং উর্দুভাষী নেতাদের বক্তব্য ॥ এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন অনেক এনজিও এবং উর্দুভাষী অবাঙালী নেতারা। এ ব্যাপারে নন লোকাল রিলিফ কমিটির জোনে জেনেভা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান গোলাম জিলানী জনকণ্ঠকে বলেন, হাইকোর্টের রায় ক্যাম্পে বসবাসরতদের জন্য ভাল হয়েছে। তবে যারা ক্যাম্পের বাইরে রয়েছে তাদের বিপক্ষে গেছে। কারণ এখানে অন্তত আড়াইশ পরিবার জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ার কারণে ক্যাম্পের বাইরে বিভিন্ন প্লটে ক্যাম্প বানিয়ে বসবাস করছে। তাদের রায়ের প্রেক্ষিতে উচ্ছেদ করা হবে। তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। তারাও বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রধারী। এনজিওর কাছ থেকে কোন সুবিধা না পাওয়ার দাবি করে মিরপুরের উর্দুভাষী অবাঙালীদের উর্দু স্পিকিং পিপলস ইউথ রিহাবিলিটেশন মুভমেন্টের সভাপতি সাদাকাত খান ফাক্কু জনকণ্ঠকে বলেন, তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন। তিনি কোন সময়ই বেশি টাকার মালিক ছিলেন না। এখনও তার সেভাবে কোন অর্থ সম্পদ নেই। তবে হাইকোর্টের রায় খুব বেশি সন্তোষজনক হয়নি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যেসব পরিবার ক্যাম্পের বাইরে বসবাস করে, তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সুরাহা হয়নি। তাদের ভবিষ্যত কি? তবে হাইকোর্টের রায়কে সাধুবাদ জানিয়েছেন উর্দুভাষী অবাঙালীদের আরেকটি সংগঠন মোহাজির ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অসি আহমেদ। তিনি হাইকোর্ট অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে রায় দিয়েছেন। রায়ে ক্যাম্পের বাসিন্দারা মহাখুশি বলে মন্তব্য করেন।
×