ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ধর্মীয় সম্প্রীতির মাধ্যমে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধের শপথ

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

ধর্মীয় সম্প্রীতির মাধ্যমে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধের শপথ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ জঙ্গীবাদ রুখতে দেশে প্রথমবারের ধর্মীয় সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো। ধর্মের নামে জঙ্গীবাদ সৃষ্টির পথ রোধ করতেই এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ধর্মের যেসব বিষয়ের অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা সংবলিত একটি দলিল তৈরি হচ্ছে। এই দলিল সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে। এ ছাড়া প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জঙ্গীবাদের কুফল সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য প্রদানসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশে আইএস বা আল কায়েদার তৎপরতা থাকার যে প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে, তা চিরতরে নির্মূল করতেই সরকার এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের পর হত্যায় দায় স্বীকার করে আইএস ও আল কায়েদার নামে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এসব বিবৃতি প্রকাশের পর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠীর তৎপরতা রয়েছে বলে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া হত্যাকা-ের তদন্তে এ রকম কোন তথ্য প্রমাণ মেলেনি। তদন্তকারীরা বলছেন, বাংলাদেশকে জঙ্গী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বেও কাছে তুলে ধরতেই এমন অপচেষ্টা চলছে। এমন অপচেষ্টা রুখতেই নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সেই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার দেশের সকল ধর্মের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ধর্মীয় সম্প্রীতি সম্মেলন। তাতে যোগ দেন বিভিন্ন ধর্মের কয়েক হাজার সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বাংলাদেশ যখন শান্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন একটি মহলের সহ্য হচ্ছে না। তারা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র করছে। হত্যাসহ নানা অরাজকতা সৃষ্টি করছে। শান্তি বিনষ্টের প্রয়াস চালাচ্ছে। মানুষ হত্যা করে আইএসের নাম দেয়া হচ্ছে। আমরা কোন ঘটনায় আইএসের সংশ্লিষ্টতা পাইনি। তাহলে আইএস আসে কোথা থেকে?’- প্রশ্ন করেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, দু-একজন বিপথগামী তাদের আইএস মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, কিন্তু তা হবে না। তাদের বলব, এ ভ্রান্ত মতবাদ ছেড়ে আসল পথে ফিরে আসুন। কিছু একটা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে বলা হচ্ছে, আইএস করেছে। যত হত্যা সব নাকি আইএস করেছে। এগুলোকে বাংলাদেশের মানুষ পছন্দ করে না। আমরা সব পেশার ও ধর্মের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। তিনি আরও বলেন, মানুষ মেরে আমাদের দেশের অগ্রযাত্রাকে থমকে দেয়ার জন্য এ ষড়যন্ত্র। তবে ভয়ের কিছু নেই, আমাদের পুলিশ বাহিনী সচেষ্ট আছে। সবাই সহযোগিতা করলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, আর নাম দেয়া হচ্ছে আইএসের। আমাদের এই আলেম-ওলেমারা বসে আছেন, একজনও বলেন না যে তারা আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা তো একজন আলেম-ওলেমা একটা মাদ্রাসা একটা মসজিদে আমরা আইএসের অস্তিত্বের কথা শুনিনি। জঙ্গীবাদ দমনে সচেতনতা তৈরির জন্য পুলিশের সাম্প্রতিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট অডিটরিয়ামে এই সম্প্রীতি সম্মেলনে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক ও ঢাকার পুলিশ কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়াও উপস্থিত ছিলেন। গত শনিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী নিজের বাড়ির কাছে খুন হওয়ার পর সোমবার ঢাকার কলাবাগানে হত্যা করা হয় সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয়কে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গী দল আইএস রেজাউল হত্যা এবং আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা বাকি দুটি হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করেছে বলে খবর দিয়েছে জঙ্গী তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী একটি ওয়েবসাইট। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বুধবারও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশে আইএসের তৎপরতা নিয়ে কথা বলেন। সরকারের আগের ভাষ্যের ধারাবাহিকতায় সম্প্রীতি সম্মলনেও এ দেশে আইএসের মতো জঙ্গী দলের তৎপরতার কথা নাকচ করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের এখানে কী আছে? আমাদের এখানে কিছু ‘হোমগ্রোন’ জঙ্গী রয়েছে। তারা নানা ধরনের প্রচেষ্টা নানাভাবে চালিয়েছে। এখনও মাঝে মাঝে চালায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার পরও এ দেশের মানুষের নতি স্বীকার না করার কথা মনে করিয়ে দিয়ে কামাল বলেন, এখন দু-একটা মানুষ হত্যা করে, তাদের আইএস মতামত এখানে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তা আমরা কোন দিনও হতে দেব না। কাজেই যারা এ কুকর্মে নিয়োজিত আছেন, তাদের বলব- এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে সঠিক পথে আসেন। পঞ্চগড়ের মন্দিরে হামলা চালিয়ে পুরোহিত হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার জঙ্গীরা তাদের ‘ভুল বুঝতে পেরেছে’ দাবি করে মন্ত্রী বলেন, আগে মানুষ পুড়িয়ে, বাস পুড়িয়ে, শ্রমিক মেরে একটা প্রচেষ্টা চলছিল। এখন হঠাৎ করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। আমাদের অগ্রযাত্রাকে থমকে দেয়ার জন্য এই প্রচেষ্টা। পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেন, যারা শুধু দেশ নয়, বিশ্ব নিয়ে চিন্তা করেন, তাদের বলব, এখানে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আছে। মায়ের চেয়ে মাসির কান্না, মাসির মায়া বেশি- সেটাও আমরা দেখেছি। জুলহাস মান্নান হত্যার তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার আগ্রহের বিষয়ে ইঙ্গিত করে পুলিশ প্রধান বলেন, বাংলাদেশে সরকার, পুলিশ, প্রশাসন থাকার পরও অনেক দেশ ‘মায়া কান্না’ দেখিয়ে ‘কাছে আসতে’ চায়, যেমনটা সিরিয়া, ইরাকের মতো দেশে ঘটেছিল। শহীদুল হক বলেন, আমরা যে দেশে বসবাস করি, আমার দেশের ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি দেশের প্রত্যেকটা নাগরিকের শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। যারা এই দেশে বসবাস করে, তাদেরও সেই শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। যে সমাজ যে জিনিস সমর্থন করে না, পছন্দ করে না, সেখানে যদি কৌশলে বহির্শক্তি দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তখনই সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, আমি কী বলতে চেয়েছি- তা আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। বাংলাদেশে গত দুই-আড়াই বছরে যত জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ তার ‘৮০ শতাংশ’ উদ্ঘাটন করে দোষীদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে বলে পুলিশ প্রধান দাবি করেন। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ছয়জন জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। আরও ২৩ জঙ্গীর ফাঁসির রায় হয়েছে, যেগুলো উচ্চ আদালতে আপীলে রয়েছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা এবং তাতে জামায়াত-শিবিরের জড়িত থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ধর্মীয় নেতাদের সামনে তিনি বলেন, এসব ঘটানোর উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে সরকারকে ‘বেকায়দায় ফেলা’। ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ইদানীং বিশ্বে রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত ফায়দা হাসিলের জন্য ধর্মের অপব্যবহার হচ্ছে, যা হিংসা, বিদ্বেষ, বিশৃঙ্খলা ও উগ্রবাদের প্রসার ঘটাচ্ছে। এই উগ্রবাদের কারণে সারা বিশ্ব বিভীষিকাময় হয়ে উঠছে। আর বিশ্বয়ানের আবহে বাংলাদেশের মাটিতেও উগ্রবাদ ও জঙ্গীবাদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। উগ্রবাদের কারণে মনুষত্ববোধ যাতে বিপন্ন না হয়, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোগিতা, উদারতা ও আস্থার পরিবেশ যেন নষ্ট না হয়- সে বিষয়ে ধর্মীয় নেতাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলেন তিনি। শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলেন, বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। তাই এক লাখ মাওলানার স্বাক্ষর নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭৬ হাজার মাওলানা জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সই করেছেন বলে জানান তিনি।
×