ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অবসরে যাওয়া দুই বিচারপতির ১৬৮ রায়ের পুনঃশুনানি হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

অবসরে যাওয়া দুই বিচারপতির ১৬৮ রায়ের পুনঃশুনানি হচ্ছে

আরাফাত মুন্না ॥ অবসরের পরে লেখা সাবেক প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনে ৭টি এবং আপীল বিভাগের অবসপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ১৬১টি রায় গ্রহণ করেননি সুপ্রীমকোর্ট। এই ১৬৮টি মামলাই পুনঃশুনানি হচ্ছে বলে সুপ্রীমকোর্ট সূত্র জানিয়েছে। গত ২৬ এপ্রিল এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় সুপ্রীমকোর্ট। প্রধান বিচারপতির এই সিদ্ধান্তকে নজিরবিহীন বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট এক বিচারপতি। সূত্র জানায়, এই মামলাগুলো আগামী সোমবারে আপীল বিভাগের দুটি বেঞ্চে কার্যতালিকায় পুনঃশুনানির জন্য রাখা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের ১ নম্বর বেঞ্চে ১০৭টি এবং বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্্হাব মিয়ার নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের ২ নম্বর বেঞ্চে ৬২টি মামলা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব মামলায় রায় ঘোষণার পর আবারও পুনঃশুনানির উদ্যোগ নেয়ায় বিচারপ্রার্থীদের বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হবে মনে করেন আইনজ্ঞরা। তারা বলেছেন, নিষ্পত্তিকৃত এসব মামলার শুনানিতে বিচার প্রার্থীদের যেমন অর্থের অপচয় হবে, তেমনি আদালতের গুরুত্বপূর্ণ সময়ও নষ্ট হবে। এদিকে, বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এই ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধান বিচারপতি প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে এই ধরনের নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পৃথিবীর কোন দেশেই এ ধরনের নজির নেই। তিনি বলেন, এর আগে যত বিচারপতি অবসরে গেছেন সবাই অবসরের পরেই অসমাপ্ত রায়গুলো সম্পন্ন করেছেন। আমিও এর ব্যতিক্রম কিছু করিনি। তিনি আরও বলেন, প্রধান বিচারপতি জনকণ্ঠের আদালত অবমাননার মামলার পর থেকেই আমার ওপর ক্ষিপ্ত। বিচারপতি মানিক আরও বলেন, আমি বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় তিনি এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেননি। আমি অবসরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে লন্ডন চলে যেতে পারি উল্লেখ করে মামলার ফাইল ফেরত দিতে বলেন। আমি সে বিষয়ে চিঠি দিলে, অবসরের পর রায় লেখা যাবে না বলে নতুন ফর্মুলা দেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনী ও সংবিধান পরিপন্থী। তিনি আরও বলেন, ওনার (প্রধান বিচারপতি) এসব প্রতিহিংসামূলক কর্মকা-ের ফলে সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে। এখন যদি এই মামলাগুলো পুনঃশুনানি হয়, তাহলে বিচারপ্রার্থীদের আবার আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে, টাকা খরচ করতে হবে, অন্য সকল কাজ বাদ দিয়ে শুনানির দিন আদালতে আসতে হবে। নিষ্পত্তিকৃত মামলার জন্য আবারও দুর্ভোগ, এটা কেমন ন্যায় বিচার, প্রশ্ন বিচারপতি মানিকের? গত বছরের ১৬ জানুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন। এর পর তার কাছে থাকা ৭টি মামলার রায় লেখেন তিনি। অন্যদিকে ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর আপীল বিভাগ থেকে অবসরে যান বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। অবসরে যাওয়ার সময় ১৬১টি মামলার রায় লেখার দায়িত্ব ছিল এই বিচারপতির। এসব মামলা তার অবসরে যাওয়ার আগেই আপীল বিভাগ বিভিন্ন সময়ে শুনানি গ্রহণ সম্পন্ন করে। পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত আদেশও জানিয়ে দেন। শুধু পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার কাজ বাকি ছিল। অবসরের পরেও প্রায় প্রতিদিনই তিনি রায় লিখছিলেন। আর এমনই এক পরিস্থিতিতে বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গত ১৭ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বাণীতে অবসরের পরে রায় লেখাকে সংবিধানপরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করেন। ওই বাণীতে তিনি বলেন, ‘কোন কোন বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন। আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের পর দীর্ঘদিন সময় ধরে রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধানপরিপন্থী। অবসরের পর রায় লেখা বেআইনী বলার ব্যাখ্যায় বিচারপতি সিনহা তার বাণীতে বলেন, ‘কোন বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বিধায় তার গৃহীত শপথও বহাল থাকে না। এরপর গত ২২ জানুয়ারি মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভায় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার পর আর কোন রায় লিখতে দেয়া হবে না। আমাদের দেশে অতীতে এ রকম রায় দিলেও এখন থেকে আর এ সুযোগ দেয়া যাবে না।’ প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনার এক পর্যায়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর রায় লেখার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেন প্রধান বিচারপতি। এমনকি তার অফিস কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয় প্রধান বিচারপতির নির্দেশে। এরপর বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বসার কক্ষে পূর্ণাঙ্গ রায়গুলো হাতেই লেখেন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক গত ৮ ফেব্রুয়ারি ৬৫টি মামলার রায় ও আদেশের কপি হাতে লিখে জমা দেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তিনি আরও কিছু রায় লিখে জমা দেন। বিচারপতি মানিক তার কাছে আর কোন মামলায় রায় লেখার কাজ বাকি নেই বলে তখন মিডিয়াকে জানান। এদিকে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আরও কিছু মামলার রায় লেখার অপেক্ষায় ছিল। আর যেসব রায় তিনি হাতে লিখে জমা দিয়েছেন, সেগুলোর অনেক লেখাই অস্পষ্ট। পাশাপাশি আপীল বিভাগের যে বেঞ্চ হতে এসব মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে, সেই বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা এখনও এসব রায়ে স্বাক্ষর করেননি। নিয়ম অনুযায়ী কোন মামলার রায় লেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতি রায়টি লেখার কাজ শেষ করার পর অন্য বিচারপতিরা তা দেখে একমত হয়ে স্বাক্ষর করেন। আর বেঞ্চের সব বিচারপতির স্বাক্ষর শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেটি রায় হিসেবেও গণ্য হয় না। এ ছাড়াও অবসরের পরে লেখা রায়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এখন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে প্রধান বিচারপতি সব মামলারই পুনঃশুনানির আদেশ দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রীমকোর্টের এক জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জনকণ্ঠকে বলেন, এসব মামলার পুনঃশুনানিতে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি বাড়বে। একই সঙ্গে উচ্চ আদালতেও মামলার জট বাড়বে। তিনি বলেন, এসব মামলা আবার শুনানিতে বিচারপ্রার্থীদের অতিরিক্ত টাকা খরচ হবে। এই আইনজীবী আরও জানান, এর আগে অন্য সব বিচারপতিই অবসর গ্রহণের পর রায় লিখেছেন। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ রায়ই অবসরের পর লেখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
×