ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

পাঠ প্রতিক্রিয়া ॥ আত্মখুনের স্কেচ

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

পাঠ প্রতিক্রিয়া ॥ আত্মখুনের স্কেচ

সৌম্য সালেক কবিতা লিখছেন একদশক ধরে। আর এই দীর্ঘদিনের চর্চায় তাঁর বড় প্রাপ্তি হলো নিজের স্বরটি খুঁজে পাওয়া। এমন অনেকেই আছেন যারা বিশ-পঁচিশ বছর ধরে চেষ্টারত আছেন, যারা নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে উপস্থাপন করতে পারেননি। সে-হিসেবে সৌম্য সালেক তরুণ হলেও নিজের কবিতার আলাদা একটি জগৎ নির্মাণ করার সফলতা অর্জন করেছেন। আর এ প্রাপ্তি কোন অংশেই কম নয়। এবারের বইমেলায় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আত্মখুনের স্কেচ’ প্রকাশিত হয়েছে। একথা স্পষ্ট যে, তিনি অনেকটা সময় অপেক্ষা করে বুঝে শুনেই তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশে ব্রতী হয়েছেন। আর এ কারণেই এ গ্রন্থের কবিতাগুলো যে বাছাইকৃত ও বিশেষ তা সহজেই বলা যায়। ‘আত্মখুনের স্কেচ’-এ মোট ৪৪টি নানা স্বাদের ও বৈচিত্র্যের কবিতা রয়েছে। বইটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে আরেক কবি সৈকত হাবিব লিখেছেন, ‘...এই কবি প্রথম কাব্যগ্রন্থেই অনেকখানি ‘পৌঢ়ত্ব’ লাভ করেছেন; জীবনের গূঢ়জটিল সৌন্দর্য ও বিবমিষা, সময়ের দ্বৈরথ, পৃথিবীতে মানুষের অর্জন ও অবমাননা, ঘৃণা ও হত্যা ব্যবসার চেহারা এ বয়সেই গভীরপাঠ করেছেন।’ এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা পাঠ করতে গিয়ে সৈকত হাবিবের এমন কথাগুলোর সত্যতা পাওয়া যায়। আবার মিথ ও গল্পের পরিমিত ব্যবহার সৌম্য সালেকের কবিতাগুলোর উপস্থাপনকে ব্যতিক্রমও হয়েছে। তাঁর অধিকাংশ কবিতার ভেতরেই একটা গল্প পাওয়া যায়। ফলে এ ধরনের কবিতাগুলো নির্মাণশৈলীকে বশ করে সহজেই পাঠক অনুভূতিকে স্পর্শ করতে সক্ষম। আবার ‘আত্মখুনের স্কেচ’-এর কিছু কবিতা আছে নির্মাণধর্মী। এ ধরনের কবিতাগুলো উপলব্ধিতে আসে বার বার পঠন-পাঠনের পর। কিন্তু এটাও সত্য প্রথম পাঠেই এ ধরনের কবিতা হৃদয়ে বাজে, কিন্তু ভাব যেন ধরেও ধরা দেয় না। এমন নির্মাণ আমাদের বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’র কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বৈশিষ্ট্যের বাইরেও কয়েকটি কবিতা এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে বইয়ের নাম কবিতাটির কিছু অংশের পাঠ নেয়া যেতে পারে : ‘ছিঁড়ে গেছে গাঁথনি, খিলান চাক ভেঙ্গে মধুÑনখে পিঠে বৃন্তে ধূলিতে রোদ ও রাগিণীর জ্বরে পাথর ছুঁয়েছে বুক দুলতে লাগে হাওয়াই ভেসেল...।’ সৌম্য সালেকের কবিতাগুলো পাঠ করলে অনুভব করা যায় যে, তিনি আরবি ও ফার্সি সাহিত্যে একনিষ্ঠ পাঠক। বিশেষত ফার্সি সাহিত্যের প্রচলিত অনেক মিথ ও উপস্থাপনের করণকৌশল আমরা তাঁর কবিতায় দেখতে পাই। অবশ্য এ কথাটি তিনি তাঁর কবিতা ‘নগর রাখাল’-এ স্বীকারও করেছেন। তাঁর উক্তি-‘তার চেয়ে বই খুলি- খেয়ে আসি ফার্সি কবিতার শরাব, ঘুরে আসি প্রাচীন গ্রিস, হরপ্পা নগর’। এ কাব্যের দুটি বিশিষ্ট কবিতার কথা বলতে গেলে ‘মানুষ গল্প করে’ ও ‘কালো মায়ের গল্প’ কবিতার কথা বলতে হয়। ‘মানুষ গল্প করে’ কবিতায় মানুষের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যে ভর করে কবি লিখেছেন- ‘তুমি একটা হাটুরের গল্প শোনাও যার পদধ্বনি বাতাসে মিশেছে মৃদু সুরে/তুমি একটা পাহাড়ের গল্প শোনাও যার নিরল প্রপাত কেউ শোনেনি-/ দেখেনি কখনো সেই মৌসুমকলা-বিরল বাহার/তুমি সেই বালিকার গল্প শোনাও-সিন্ধুবোধিনী যারে নিয়ে গেছে ঠোঁটে করে/টারশিয়ারি যুগে-/নগরে পতন লাগে-মানুষ গল্প করে...।’ সৌম্য সালেকের কবিতায় আত্মখনন যেমন স্পষ্ট, তেমনি জাগ্রত সামগ্রিক সমাজে পেতে রাখা সরব দৃষ্টি। অনিষ্ট অথবা অনাচার, মধু অথবা বিষ, বর্বর অথবা স্পর্শী-মানবিকতা তাঁর কবিতাজগৎকে ছুঁয়ে গেছে বারবার। ঊষার লিরিক, আত্মখুনের স্কেচ, নগর রাখাল, হাঁটতে শিখেছি বলে, স্বর ও সিক্তনাদ, উজানী মাহফিলের নাচ, বুকের হেরেম খুলে, বিগত মুদ্রার বিক্ষোভ-এ গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতা। কিছু বানান প্রমাদ, দু-একটি কবিতা ছাড়া ‘আত্মখুনের স্কেচ’ সুখপাঠ্য হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। ‘আত্মখুনের স্কেচ’ প্রকাশিত হয়েছে প্রকৃতি প্রকাশনী থেকে। জিলানী আলমের শিল্পকর্ম অবলম্বনে প্রচ্ছদ করেছেন দেওয়ান আতিকুর রহমান। ৫৬ পৃষ্ঠা বইটির মূল্য ধরা হয়েছে ১৩৫ টাকা।
×