ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হাবিবা আক্তার পিংকি

সমবায়ী রবীন্দ্রনাথ ও পল্লী উন্নয়ন

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

সমবায়ী রবীন্দ্রনাথ ও পল্লী উন্নয়ন

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ও সৃজনশীল প্রকাশনা পারিজাত থেকে ২০১২ সালের বইমেলায় ‘সমবায়ী রবীন্দ্রনাথ ও পল্লী উন্নয়ন’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে। বইটির লেখক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক ড. আনোয়ারুল করীম। এই খ্যাতিমান গবেষকের আরও একটি বই ‘বাউল সাহিত্য ও বাউল গান’-এর ওপর আলোচনা লিখেছি সাময়িকীতে তা ছাপা হয়েছে। গবেষক হিসেবে ড. করীমের বিশ্বজোড়া নাম। তার এ বইটি রবীন্দ্রনাথের একটি ব্যতিক্রম মনীষা সম্পর্কে মননশীল গবেষণা। বাংলা গবেষণা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন চিন্তা নিয়ে খুব কম লেখা আছে। বিচ্ছিন্নভাবে মৈত্রেয়ী দেবীসহ কেউ কেউ লিখেছেন। বিচ্ছিন্নভাবে পতিসর, শাহজাদপুর, শিলাইদহ নিয়ে রবীন্দ্র ভাবনা সম্পর্কে কেউ কেউ লিখেছেন, কিন্তু ড. করীম রবীন্দ্রনাথের সমবায় আন্দোলন ও পল্লী উন্নয়নের ওপর এ বইতে আমাদের সমৃদ্ধ গবেষণা উপহার দিয়েছেন। ড. করীমের এ বইটি পড়লে কবি, কর্মী ও পল্লীভাবুক বরীন্দ্রনাথের সমন্বিত প্রতিভার সম্যক রূপ দেখা যাবে। ড. করীমের মূল্যবান গবেষণামূলক দুটি বইপড়ার সময় উপলব্ধি করেছি, তার গদ্য হৃদয়গ্রাহী। এত বড় প-িত তিনি, অথচ নীরস প-িত্য দিয়ে গদ্যকে ভারাক্রান্ত, দৃষ্পাঠ্য করে তোলেননি। একজন সাহিত্যচর্চাকারী হিসেবে লক্ষ্য করেছি, ড. করীম মূলতই রবীন্দ্র গবেষক। রবীন্দ্র রচনাবলীর শুষ্ক পাতাগলবদ্ধরণ না তিনি রবীন্দ্রমনীষা মসৃণ করেছেন। তারই অনায়াসে প্রকাশ করে। যেমন ‘বাউল ও বাউল সাহিত্য’ তেমনি ‘সমবায়ী রবীন্দ্রনাথ ও পল্লী উন্নয়ন’। গবেষণায় অনায়াস ভঙ্গি বজায় রাখা যায় না ড. করীম আগাগোড়া তা রক্ষা করেছেন। ড. আনিসুজ্জামানের গবেষণার এই গুণ পেয়েছি। ১৩৬ পৃষ্ঠার এ বইটি ৪টি অধ্যায়ে সমাপ্ত। প্রতিটি অধ্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য থাকলেও একটি অপরটির সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন না হলে পড়ে কোন আনন্দই পেতাম না। ব্যাপক পঠন পাঠনের ফসল এ বইটি। দেশ-বিদেশের এবং সমকাল ও অতীতের খ্যাতিমান প-িতদের লেখা পড়েছেন, সেই আলোকে ভারতবর্ষের পল্লী সমাজের একটি। ইতিহাস তুলে ধরেছেন বারবার কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের প্রসঙ্গ এনেছেন। প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ গ্রন্থগুলোতে এবং তাও খ্রিস্টপূর্ব আমলে সমবায়ের অস্তিত্ব ছিল, সমবায় আন্দোলন হয়েছিল, তার অনুপুঙ্খ তথ্য তুলে এনেছেন। যুগে যুগে পল্লী গঠনের, পল্লী সংস্থাবর, পল্লী বিকশিত হওয়ার রূপটি উপস্থাপন করেছেন। এরপর পল্লী ও সমবায় সম্পর্কে রবীন্দ্র অবদানের ইতিহাস বিশ্লেষণ করেছেন। বইটির সংক্ষিপ্ত, ভূমিকায় ড. করীম বলেছেন, ‘আমাদের দেশে সমবায় নিয়ে এক সময় পিসি রায় ভেবে ছিলেন। তারপর আখতার হমিদ খান কুমিল্লায় সমবায় চেতনার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নীবরে এ বিষয়টিকে ভেবেছিলেন এবং তার কর্মক্ষেত্রে সমবায় ভাবনার সকল বাস্তবায়ন ঘটেছিল অনেকের কাছে তা অজানা ছিল।’ ড. করীমের লেখার ওপর ভিত্তি করে জোর দিয়ে বলা যায় বাঙালীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথই প্রথম সমবায় সিস্টেম গড়ে তুলেছিলেন। সমবায় ব্যাংক এবং কৃষিব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরুস্কারের সমুদয় টাকা কৃষিব্যাংকে জমা রেখেছিলেন। ড. করীম এ কথা জানাতে ত্রুটি করেননি যে, একটা স্বদেশিক চিন্তা থেকে রবীন্দ্রনাথ পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় চিন্তা করেছেন। তিনি যেমন রবীন্দ্র বাউল ছিলেন, তেমনি চাষাদেরও আপনজন ছিলেন। একটি লেখায় মিত্রেয়ী দেব বলেছেন যে, পল্লীর জন্য, বাংলার কৃষকদের জন্য যা ভেবেছেন কবি তাকেই বাস্তবে রূপ দেবার চেষ্টায় মেতেছেন। ড. করীমও এই সাক্ষ্য তুলে ধরেছেন তার সমগ্র বইটিতে। কৃষকদের সরল সুদে ঋণ দেবার মহৎ উদ্দেশে পতিসরে কৃষিব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কৃষির উন্নতির লক্ষ্যেই কবি তার ছেলে ও জামাইকে আমেরিকায় ডিগ্রী আনার জন্য পাঠিয়েছিলেন তাদের এক চিঠিতে বলেছিলেন, যাদের অন্নে আমাদের জীবন পুষ্ট হয়, তোমাদের বিদ্যা যেন তাদের কাজে লাগে। রবীন্দ্রনাথের সমাজে কখনও কংপ্রেসীরে মতো রাজনীতি ঠাঁই নিতে পারেনি, মহাত্মাগান্ধীর স্বরাজ আন্দোলনের ফাফা দিনটি সম্পর্কেও কবি সচেতন ছিলেন। কবি মনে প্রাণে কামনা করতেন গ্রামের আত্মনির্ভরশীলতা ড. করীম এ বইয়েও দেখিয়েছেন। যে, রবীন্দ্রনাথ কবিমন ও তৎষ্ণদীপ্ত মনীষা দিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন, এক সময় ভারতের পল্লীগুলো ছিল অর্থনীতিতে, সমাজনীতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারা ছিল স্বাধীন। তারা তাদের সহজাত মেধা দিয়ে পল্লীকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাদের অন্ন তারাই ফলাত, তাদের বস্ত্র তারাই তৈরি করত, তাদের গৃহ তারাই নির্মাণ করত। তাদের রাজত্বে তারাই ছিল রাজা। তারা রাজদরবারে ঋণ দিত না। সুলতানরা মোঘল সম্রাটরা ভারতের পল্লীর যুদ্ধে শোষণের হাতুড়ি চালায়নি। ভারতের স্বয়ংসম্পূর্ণ পল্লীকে তছনছ করে দিয়েছে ইংরেজ সরকার। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার কৃষকদের সর্বনাশ করেছে, রবীন্দ্রনাথ তা লক্ষ্য করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এও জানতেন ইংরেজরা বাংলার তাঁতশিল্পের ধ্বংস করেছিল। তাঁতীদের আঙুল পর্যন্ত কেটে দিয়েছিল। তাই রবীন্দ্রনাথের বুকে গভীর আবেগ জেগে ছিল কৃষকদের আত্মনির্ভরশীল করার। বিভিন্নভাবে তিনি সমবায় গড়ে তোলার মাধ্যমে, কৃষকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ঘটিয়ে, গ্রামের বুক থেকে সাম্প্রদায়িকতা ও অন্ন বিশ্বাস দূর করে গ্রামীণ কৃষকদের জাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ড. করীম ঠিকই বলেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন পল্লীর কাদামাটিতে দেশের প্রতিভা, মেধা, আবেগ, জ্ঞান, বিদ্যা যেন সংযুক্ত হয়। তিনি এও দেখিয়েছেন যে, কবির সহজাত কবিত্বশোভন-মানবিক ও সংবেদন ম-িত অনুভূতি থেকে পল্লী উন্নয়নের ভাবনায় মশগুল ছিলেন। সেই প্রেরণা থেকে গজদান, মিনারের সিংহদারে ঠেলে কৃষকের পর্নোকুটিরে গেম ত্রাস ছিলেন। তাদের মতে, অন্ন তুলে দিতে চেয়েছিলেন, পরনে বস্ত্র দিতে চেয়েছিলেন, শিক্ষা-চিকিৎসা দিতে চেয়েছিলেন ড. করীম এই তথ্যও দিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথ নিজে হোমিও চিকিৎসক ছিলেন। দরিদ্র-চাষাদেরই চিকিৎসা করতেন তিনি। হয়ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রবীন্দ্রভক্ত হিসেবে রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায়ই বলেছিলেন, ‘আমি মোটা ভাত মোটা কাপড় দিয়ে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই।’ এমন সমৃদ্ধ একটি বই উপহার দেয়ার জন্য ড. আনোয়ারুল করীমের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
×