ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

প্রদর্শনী ॥ জলতরঙ্গ জলকেলি

প্রকাশিত: ০৪:২২, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

প্রদর্শনী ॥ জলতরঙ্গ জলকেলি

অদেখাকে দেখা, অস্পৃশ্যকে স্পর্শ করার কাজটি সহজবোধ্য নয়। হয়ত তা অসম্ভবই। তবুও সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার সাধনা সৃজন ও মননশীল মানুষেরা করে আসছেন প্রাচীনকাল থেকে। নিরবধিকাল তা চলবেও। একজন শিল্পী দক্ষতা ও সচেতন সংবেদনশীলতায় তৈরি করেন স্বপ্নময় পরিসর, যা আমাদের দৃষ্টিকে ভাবতে শেখায়, অনুভূতির জানালা খুলে দেয়, গভীরতায় নিমগ্ন হয় আনন্দ-বেদনা এবং ক্রমশই আবিষ্কৃত হয় দৃশ্যমান শিল্পের সত্য। একটি নির্বাক চিত্রের মধ্যে নিহিত হাজার হাজার গল্প। প্রতিটি চিত্রই যেন শুধু সময়ের গল্প বলে যায়। একজন শিল্পী পৃথিবীর রঙ থেকে জীবনের সুর খোঁজেন, সন্ধান করেন আত্মাকে। তাই তো নবীন ও প্রবীণ বয়সের দশজন শিল্পীর জলরঙে আঁকা ৪৪টি ছবি নিয়ে গ্যালারি কায়ায় ‘ওয়াটার রাইমস-৩’ শিরোনামে দলীয় চিত্র প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। জলরঙের ছবির সীমানা বিস্তারের সময় এসেছে। স্বচ্ছ পটভূমির ওপর বানভাসি বর্ণমায়া সৃষ্টির প্রক্রিয়া নিয়ে দুই ধরনের কাজ হয়। এ রকমের কাজে প্রশিক্ষণ অনুশীলনের চরম প্রকাশ ঘটে। সাধারণত ছাত্র এবং সদ্য উত্তীর্ণ শিল্পীর জলরঙের ছবি এমন হয়। আরেক ধরনের কাজে পরীক্ষা চলে। জলরঙের স্বচ্ছতা ও বর্ণ সুষমার সঙ্গে আবহ ও অবয়বকে যথাযথ রূপ দিতে হয়। প্রবীণ শিল্পীদের কাজে যেমন মুন্সিয়ানা পরিলক্ষিত হয় তেমনি নবীন শিল্পীদের কাজে সে ছাপ পাওয়া যায়। শিল্পী কারু তিতাসের চিত্রকলায় পরিলক্ষিত হয় প্রকৃতি ও আবহমান বাংলার নানারূপ। শিল্পীর উচ্ছ্বাস, অভিব্যক্তি, শুদ্ধতা, বেদনা, স্মৃতি আর একাকিত্ব এসবই যেন তাঁর এক প্রকৃতি ও জীবনের প্রতিফলন। ‘মাই বিউটিফুল বাংলাদেশ-৩৭ এবং ৩৮’ শিরোনামের ছবি দুটিতে আবহমান বাংলার অতিপরিচিত সেই দৃশ্যাবলী চোখে পড়ে। পানিতে ভাসমান নৌকার বহর, পাশেই জনপদ। আঁকাবাঁকা ছোট নদীতে গরুর গাড়ি পার হওয়ার দৃশ্য, চারদিকে বিস্তীর্ণ ভূমি সঙ্গে সবুজের আভা। এ যেন চিরচেনা সেই বাংলার মুখ। শিল্পী আনিসুজ্জামানের চিত্রপটে ধরা পড়েছে জলজ জীবনের বিভিন্ন গল্পকথা। রঙ আর রেখার নমিত ব্যবহারে তিনি সাজিয়েছেন তাঁর চিত্রপট। তাঁর ছবির জগৎ যেন নৌকার এক নিরবচ্ছিন্ন মিছিল। কখনও ঘাটে ভিড়ানো নৌকার সারি, কখনও জালসহ নৌকা, কখনও ভাসমান নৌকা, কখনও সবুজ ঘেষা প্রকৃতির মাঝে জলের ওপর ভাসমান নৌকা। একটি অথবা একজোড়া অথবা তারও অধিক। নৌকার মাধ্যমে জীবনের গতিশলতার রূপ তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই তো চিত্রে পরিলক্ষিত হয় জল আর জীবনের নানা গল্প। নদী আর নৌকা চিত্রপটকে পূর্ণতা দিয়েছে। সহজিয়া জীবনের দহন-পীড়ন ধরা পড়েছে শিল্পীর তুলিতে। চিত্রকর্মে বিধৃত হয়েছে আবহমান জলকেন্দ্রিক জীবনের ইতিহাস ও বাস্তবতা। জলজ বাহন নৌকা সে গল্পের সাক্ষ্য বহন করে। মোহনীয় ধূসর রঙ এবং ওয়াশের মাধ্যমে শিল্পী চিত্রপটে ফুটিয়ে তুলেছেন মায়াবী মূর্ছনা। চিত্রকর্মগুলো যেন উজান-ভাটির সুর তোলে দর্শক হৃদয়ে। দক্ষতা এবং দৃঢ়তায় রঙের ব্যবহার চিত্রপটকে জীবন্ত করেছে। তাঁর কাজের দিকে গভীরভাবে তাকালে দেখা যায়, কাজের বাখ্যানমূলক ক্ষমতা। পটভূমিতে তাঁর শিল্পভুবন উদ্ভাসিত। যতদূর যাওয়া যায় বাস্তবতার দিকে, তা কেবলই আমাদের কল্পনাকে নস্টালজিক করে। শিল্পী অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির বয়ান তুলে ধরেছেন নিজের ছবিতে। পুরানো স্মৃতিগুলো মনের আয়নায় যেভাবে ভেসে ওঠে তাঁর ছবিগুলো তেমন। চিত্রপটে নিজের মতো করে ভাষা বুনে যান শিল্পী সোহাগ পারভেজ। তার চিত্রের বিষয় অভিন্ন-চিরায়ত বাংলার রঙ ও রূপ। নদী, নদীর পাশে বেড়ে ওঠা জীবন, নিসর্গের অংশ হয়েই এঁকেছেন নিসর্গকে। তাঁর ছবিগুলো দেখলে সবুজের বুকচেরা মেঠো পথে হাঁটা হয়ে যায়। ছবিতে উজ্জ্বল রঙের প্রাধান্য বেশি। জলরঙের ছবিগুলোতে কলমে আউট লাইন টেনেছেন দারুণ দক্ষ হাতে। তাঁর ছবির জরুরী অনুষঙ্গ হয়ে বার বার ধরা দিয়েছে নদী ও নৌকা কেন্দ্রিক চিত্র। সোহাগের কাজ রিয়েলিস্টিক ও একই রকম ডিটেইল। জলরঙে আঁকা ছবির কলমে টানা আউট লাইন মুগ্ধ পাঠকের মতো পড়া যায়। ছবিতে স্থির প্রকৃতি যেমন আছে তেমনি দৃশ্যমান গতিশীলতাও আছে। জলরঙের আশ্রয়ে ছবি এঁকেছেন শিল্পী শাহানুর মামুন। তার রঙ-তুলির আঁচড়ে উপস্থাপিত হয়েছে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতির ভুবন। সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হয়েছে চিত্রপটে। প্রকৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটেছে যাপিত জীবনের। নিসর্গের বিভিন্ন মুহূর্তকে আলাদাভাবে মেলে ধরেছেন রঙের মাধ্যমে। তার ছবিগুলো মুহূর্তের কবিতার মতো। শিল্পী মোঃ কামরুজ্জোহার চিত্রপটেও ফুটে উঠেছে, চিরচেনা গ্রাম-বাংলার দৃশ্য। গ্রামের মেঠো পথ ধরে চলে যাওয়া গরুর গাড়ি, মাথায় বোঝা নিয়ে হেঁটে যাওয়া শ্রমজীবী মানুষ, রাস্তার দুই পাশে সবুজ ফসলের মাঠ। নদীতে পাল তুলে চলমান নৌকা, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, দূরের গ্রাম প্রভৃতি। ছবিগুলো দর্শক চোখকে প্রশান্তি দেয়। মন ভরিয়ে দেয়। শিল্পীর আঁকার ধরন বাস্তবতার কাছাকাছি। এক ধরনের ছায়ামূর্তি ও রেখাঙ্কনের মাধ্যমে অগ্রসর হয়ে প্রলেপে চিত্রচরিত্র তৈরি করেছেন। প্রাচ্য ঘরানার জলরঙে আঁকা শিল্পী গোপাল চন্দ্র সাহার ছবিগুলো। ভেজা ওয়াশ পদ্ধতিতে আঁকা বলে তাঁর ছবিগুলো নরম ও পেলব মনে হয়। আলো-ছায়ার কুশলী প্রয়োগে-বর্ণের নমিত স্বভাবের ভেতর হঠাৎ আলোর বিচ্ছুরণের বৈপরীত্য গোপালের কাজগুলোকে করেছে মনোহর। যেমন ঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাদার তেরেসার প্রতিকৃতি দর্শক দৃষ্টিকে মুগ্ধতা দেয়। রঙ রেখা আর বুনটের মাধ্যমে শিল্পী আরাফাত করিমের চিত্রপটে ধরা দিয়েছে বাংলার চিরচেনা রূপ। রেলস্টেশনের পাশে গড়ে ওঠা ছোট ছোট দোকান, কেনাবেচারত কাঁচাবাজারের দৃশ্য। নদীর ঘাটে বটগাছের নিচে ব্যস্ত মানুষের জটলা, দূরে নীল আকাশ। বাস্তবধর্মী ছবির সঙ্গে শিল্পী এখানে নিজস্ব কৌশল প্রয়োগ করেছেন। আলো-ছায়ার উপস্থিতিকে সচেতনভাবে উপস্থাপন করেছেন। তার সবকটি ছবিতেই এই আলো-ছায়ার উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। সঙ্গে রেখার আঁকাবাঁকা, আড়াআড়ি উলম্ব ব্যবহার তৈরি করেছে বিভাজন। ফলে ছবির মধ্যে দ্বিধাহীনভাবে যেমন স্বপ্নের সমাবেশ তৈরি হয়েছে, তেমনি বাস্তব এসে ভিড় করেছে সরাসরি। শিল্পী সৈকত হোসেনও নিখুঁতভাবে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতিকে তুলে ধরেছেন তার চিত্রপটে। রঙ ও তুলির খেলায় প্রাণময় হয়ে উঠেছে চিত্রপট। ছবিতে আলো-ছায়ার উপস্থিতি, মাটির রঙের কাছাকাছি রঙ, এর সঙ্গে সবুজাভাব আঙ্গিনা, নির্মাণের ভঙ্গি এসব কিছু তার ছবির বিষয়ের সঙ্গে এক হয়ে গেছে। বাংলা নিসর্গের ঋতু বৈচিত্র্যের নিবিড়ে জড়িয়ে থাকা জনজীবনের ছবি আঁকিয়ের দলে সৈকত হোসেন প্রতিশ্রুতিশীল এক নবীন। সৃষ্টিশীল একজন মানুষের মনোজগতের ভাবনা ও আলোড়ন বিম্বিত হয় তার সৃষ্টির ভেতরে। পুরানো টিনের ঘর, উঠোনে গাছ, গাছের নিচেই মহিষ, দুই পাশে প্রকৃতি, মাঝখানে বহমান জলের ধারা। গাছের ছায়া পড়েছে জলের ওপর, খেজুর গাছের নিচেই ফসলের মাঠ। বাড়ির উঠোনে খড়ের গাদা, সামনে জলভর্তি পুকুর, সোনালী রোদ উকি দিচ্ছে সেই জলে। এমনই সব পরিচিত দৃশ্য দেখা যায় শিল্পী দিদারুল হোসেন লিমনের ছবিগুলোতে। করেছেন পরিশালিত রঙ ও রেখার ব্যবহার। আলো-ছায়ার ব্যবহারে দক্ষতার পরিচয় মেলে। ছবিগুলো আবেগ ছাপিয়ে যায় দর্শক চিত্তে। শিল্পের আছে এক নিজস্ব ভাষা। ওই ভাষাতেই ভাবনা ব্যক্ত করে শিল্পী তৈরি করেন নিজের শৈলী। শিল্পী শেখ ফাইজুর রহমানের চিত্রের সামনে দাঁড়ালে এমনটিই মনে হয়। রঙের মিছিলের পূর্ণতা ও বিচিত্র বিন্যাসে জেগে ওঠেছে তার চিত্রতল। তার ছবির জরুরী অনুষঙ্গ হল নদী, নৌকা ও জাহাজ। আর বর্ণময় জটিলতায় তা ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষতার সঙ্গে। জলের ওপর ভাসমান নৌকা ও জাহাজ, কাঠের সিঁড়ি আড়াআড়ি রেখার মাধ্যমে এঁকেছেন। তাই তো চিত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করলে, দৃষ্টি একদিকে না থেকে বর্ণময় জটিলতায় বিভিন্ন দিকে হারিয়ে যায়।
×