ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সিরাজুল এহসান

অবরুদ্ধ সময়ের বয়ান

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

অবরুদ্ধ সময়ের বয়ান

গত শতাব্দীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানী সৈন্যদের মদদে ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতৃত্বে গঠিত আলবদর বাহিনী এদেশে। এই ইসলামী ছাত্রসংঘই স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে আবির্ভূত হয়-এ কথা সর্বজনবিদিত। অবশ্য কয়েকটি প্রজন্মকে মিথ্যায় বিভ্রান্ত করে ভিন্ন ইতিহাস শেখানো হয়েছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই আলবদর বাহিনী মূলত টার্গেট করে দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে। এই হত্যাযজ্ঞের মূল নক্সা করে অবশ্য পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী; উদ্দেশ্য বাঙালীকে মেধাশূন্য করা। ভবিষ্যতে যাতে এ জাতি আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। এদের নৃশংসতার একটি দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। “মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ বলেছিলেনÑ ‘হানাদার পাক বাহিনীর সহযোগী আলবদররা পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের পর যখন পালিয়ে যায় তখন তাদের হেডকোয়ার্টারে পাওয়া গেল এক বস্তা বোঝাই চোখ। এ দেশের মানুষের চোখ। আলবদর খুনীরা তাদের হত্যা করে চোখ তুলে বস্তা বোঝাই করে রেখেছিল।”...“মওলানা তর্কবাগীশ আরও বলেছিলেন, ‘খুনীদের নামে এই বাহিনীর নাম দেয়া হলো আলবদর বাহিনী। এ কি কোন মনঃপূত নাম? যে বদর যুদ্ধ ছিল আদর্শের জন্য, ইসলামের প্রথম লড়াই, সেই যুদ্ধের সঙ্গে কি কোন সংযোগ এই নৃশংসতার মধ্যে ছিল? হানাদারদের সহযোগী এই বদরবাহিনী শুধু ইসলামের শত্রু নয়। এরা হলো জালেম।”...উদ্ধৃত অংশটুকু নেয়া হয়েছে মুনতাসীর মামুনের ‘১৯৭১ অবরুদ্ধ দেশে প্রতিরোধ’ গ্রন্থ থেকে। ইতিহাসের সত্য বিকৃত করার ষড়যন্ত্রে যে মহলটি উঠে পড়ে নেমেছে তাদের বিরুদ্ধে যারা সরব, মাঠে নেমেছেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট- মুনতাসীর মামুন তাদের মধ্যে অগ্রগামী। বর্তমান প্রজন্মের কাছে চমকে যাওয়া, শিউরে ওঠার মতো অনেক ঘটনা রয়েছে গ্রন্থটিতে। দুটি দীর্ঘ গবেষণা ও অনুসন্ধানীমূলক নিবন্ধের সমন্বয়ে রচিত এ গ্রন্থ। অবরুদ্ধ দেশে প্রতিরোধের নানা মাত্রিক ঘটনার বিবরণ রয়েছে গ্রন্থনামীয় প্রবন্ধে। প্রগতিশীল, বাম শক্তির মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা অথচ বড় অবদানের কথাও রয়েছে এ অংশে। ‘প্রতিরোধ’ নামে একটি পত্রিকা যা পরে ‘স্বাধীনতা’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল অবরুদ্ধ সময়ে। সেই সাহসী ভূমিকার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের কথা জানতে এ গ্রন্থের শরণাপন্ন হতে হবে। একাত্তরে ঢাকা বা ঢাকার নিকটবর্তী অঞ্চলে কত প্রাণহানি ঘটেছিল, ঘরবাড়ি-সহায় সম্পদ জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী তার সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন। একটি এলাকার পরিসংখ্যানে যে তথ্য মেলে তাতে স্পষ্ট হয়ে যায় সারাদেশের হিসাব। কিছু নির্যাতিতা নারীর নাম ও বয়স সংযোজিত হয়েছে গ্রন্থটিতে। যারা পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা পাশবিকতার শিকার হয়েছিলেন। এ বীরাঙ্গনারা আমাদের গর্ব। পাকিস্তানী সৈন্যরা কত নীচ-পিশাচ আর বর্বর ছিল তার উদাহরণ মেলে আশুগঞ্জের একটি ঘটনায়। মাত্র ১০ বছর বয়সের এক বালিকাকে ধরে আনা হয় ক্যাম্পে বলাৎকারের জন্য। স্বাভাবিক কারণেই তার বয়স উপযুক্ত নয়। কিভাবে ওই পশুরা পাশবিকতা চালিয়ে মেয়েটিকে হত্যা করেছিল তা পাঠ শেষে সহৃদয়বান পাঠক অশ্রু সংবরণ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। আবার বন্দী নারী-পুরুষকে প্রকাশ্যে শারীরিকভাবে মিলিত হতে বাধ্য করে উভয়কে ব্যভিচারের দায়ে শরীরের গোপনাঙ্গে অত্যাচার করে হত্যার বীভৎস ঘটনা পড়ে পাঠক শিউরে উঠবেন। এমনই অনেক ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হবেন পাঠক। এ প্রজন্ম জানতে পারবে স্বাধীনতার জন্য তার পূর্বসূরিদের সর্বোচ্চ ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা। মানুষ হয়ে মানুষের ওপর বর্বরতম হওয়ার চাক্ষুষ ঘটনা বর্ণনা রয়েছে এ গ্রন্থে। যা করেছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যাদের কাছে ভূ-লুণ্ঠিত তারা যদি গ্রন্থটি পাঠ করেন তবে নিজের বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে করে অনুতপ্ত হবেনÑ এ গ্রন্থ পাঠ শেষে এমন কথা দৃঢ়ভাবে বলা যায়। অনন্যা প্রকাশনী এমন একটি তথ্যবহুল ও ইতিহাসাশ্রয়ী গ্রন্থ প্রকাশ করে নিজেদের দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটি ধন্যবাদ আশা করতে পারে। চমৎকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। বইটি সমাদৃত হবে, হবে পাঠকপ্রিয় এমন বিশ্বাস করার কারণ আছে।
×